আজ একটু অাগে একটি খুন করে অাসলাম। যাকে খুন করেছি সে এই সুন্দর পৃথিবীর অালো বাতাস কিছুই দেখেনি। আমার প্রিয় বান্ধবীর পেট থেকে শিশুটিকে কেটে টুকরো টুকরো করে বের করেছে এক মহিলা। মহিলা একটি হাসপাতালের নার্স। মহিলার খোঁজ পেতেও অনেক কষ্ট হয়েছে। কারো কাছে যখন এই বিষয়ে জানতে চাইতাম, প্রথমেই আগ্রহ নিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে দেখত আমার পেট উঁচু কি-না! তারপর জিজ্ঞেস করত কে করাবে? কার সাথে কী হয়েছে?
শেষে যখন নার্সের সন্ধান পেয়েছি তখন নার্স বললেন গার্ডিয়ানদের সাইন লাগবে কাগজে। রোগীর কোনো দুর্ঘটনা হলে নার্স দায়ী থাকবে না। অনেক বুঝিয়ে হাতে পায়ে ধরে আমি নিজে সাইন করে ওনাকে রাজী করিয়েছি।
শেলীকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে তার গর্ভের শিশুটিকে মেরে ফেলেছি আমরা।

গভীর অন্ধকার রাত। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই দুই চোখে ঘুম আসছে না। নিজেকে শুধু খুনী না, মহাপাপীও মনে হচ্ছে। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি এখনো বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। অথচ যে নিষ্পাপ শিশুটির কয়েক মাস পরেই এই পৃথিবীতে আসার কথা, তার গলা চেপে ধরে বলে দিলাম,  আ
আসবি না এই পৃথিবীতে। কলঙ্কের বুঝা মাথায় নিয়ে পৃথিবীতে আসার আগেই তোকে মরতে হবে। শেষে তাকে মেরেই দিলাম।

ছোটোবেলার বান্ধবী শেলী। এই শেলী অার আমার বন্ধুত্ব দেখে পুরো এলাকার মেয়েরা হিংসে করত। কোনো কিছুই গোপন করত না সে আমার কাছে। আর সেই শেলী কবে প্রেম শুরু করল! আমাকে একটিবার জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। যখন গর্ভবতী হয়ে দুই চোখে অন্ধকার দেখছিল, তখন আমার কথা মনে পড়ল। শেলী ভালোবাসত পারভেজ নামের এক ছেলেকে। অামি যতদূর জানি পারভেজ ছেলে খারাপ না। যথেষ্ট ভালোবাসত শেলীকে। কিন্তু যথেষ্ট ভালোবাসা নিশ্চয় বিছানা পর্যন্ত যাওয়া উচিত হয়নি। আর শেলীটাও আবেগে হোক বা ভালোবাসা বাঁচাতে হোক, আগে পিছে কিছু না ভেবে জীবনের মহা মূল্যবান জিনিসটি বিসর্জন দিয়ে বসে অাছে।
শেলী যখন বুঝতে পারে তার পেট উঁচু করে ভিতরে কেউ একজন জায়গা দখল দিচ্ছে। তখন ছুটে গিয়েছে পারভেজের কাছে। পারভেজ শেলীকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
শেলী আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে তার কাহিনী বলছিল।
"জানিস মিলি, আজ এতদিন পর পারভেজ আমাকে প্রশ্ন করে আমি কেন ঔষধ খাইনি। আমি কী করে মানুষের কাছে গিয়ে বলব যে আমি এই কাজ করেছি, আমাকে ঔষধ দেন। সে তো পারত একটা কিছু করতে, আমি কি এত কিছু বুঝি?
মনে মনে শেলীকে গালি দিয়ে বলছিলাম, "এত কিছু বুঝিস না। কিন্তু বিয়ের আগে কী করে প্রেমিকের সাথে বিছানায় শুইতে হয় সেটা ঠিকই বুুঝিস।" আমি জানি একটি মেয়ে হয়ে অারেকটি মেয়েকে এভাবে বলা উচিত হয়নি। আবার একদিক থেকে বলাটা উচিৎ । সে পাপ করছে।  তাকে শুনিয়ে কথাটা বলা উচিত ছিল।
শেলী আবার বলছে, "আমি পারভেজের পায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছি আমাকে বিয়ে করার জন্য। পারভেজ কী বলে জানিস মিলি? সে আমাকে বিয়ে ঠিকই করবে কিন্তু দুই বছর পর। পারভেজ অারো বলেছে, তার অার আমার ভালোবাসা মিথ্যে না। কিন্তু সমাজ আর তার বাবা মা'কে এমনটা সে কিছুতেই মানাতে বা বুঝাতে পারবে না।"
মনে মনে পারভেজকেও গালি দিচ্ছি। বাবা মা আর সমাজের কথা-ই যদি ভাববি, তাহলে প্রেমিকার দেহের প্রতি লোভ করার আগে সে ভাবনাটা কোথায় ছিল? বিয়ে করে নিতে পারলি না?

বাচ্চা নষ্ট করতে যত টাকা খরচ হয় সবই না-কি পারভেজ দিবে। হায়রে মানুষ। কেউ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেও একটি সন্তান পায় না। আল্লাহর দরবারে দিন-রাত কান্নাকাটি করে একটি সন্তানের আশায়। অার তারা অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করেছে।

আমি শেলীকে বলেছিলাম, "চল অামি অার তুই দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। বাচ্চাটাকে মারিস না শেলী। ও পৃথিবীতে অাসলে আমি অার তুই মিলে বড়ো  করে তুলব।"
শেলী প্রশ্ন করল, "পিতৃ পরিচয় কী দিবি?" বলেছিলাম, "যদি পরিচয় দিতে না পারিস তাহলে এতিমখানায় দিয়ে দিস। না হলে যারা সন্তানের জন্য কান্নাকাটি করে তাদের দিয়ে দিস। তবুও ওকে পৃথিবীতে অাসতে দে।"
শেলী আমার পায়ে ধরে বসে অাছে। "মিলি অামি পারব না, বাবা মা যদি জানে বাড়ি ছেড়েছি তাহলে এলাকায় মুখ দেখাতে পারবে না তারা।তারচেয়ে ভালো আমি আত্মহত্যা করব।"
ভেবে দেখলাম, আত্মহত্যা করলে শেলী ও তার পেটের বাচ্চা দু'জনই মারা যাবে। দুইটা মানুষকে একসাথে মরতে দেই কী করে? তাই তো শেলীকে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচাতে অামি এই জঘন্য পাপ করেছি।

দুই বছর পর শেলী আমাকে তার বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছিল। আমি বিয়েতে যাইনি। এতে যদি শেলী রাগ করে তবুও আমার কিছু করার নেই।
পারভেজের সাথেই শেলীর বিয়েটা হচ্ছে। হয়তো বছর দেড়েক পর ওদের কোল জুড়ে সন্তান অাসবে।
অথচ দুই বছর আগে যে সন্তানটি অাসতে চেয়েছিল, তাকে মেরে ফেললাম। আর এখন থেকে একটি সন্তানের জন্য কত-ই না অায়োজন চলবে। আমি ঘৃণা করি তোদের এই নোংরা মনের ভালোবাসাকে।

আজ এগুলো স্মৃতি। এক এক করে যুগ পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির কাটা, নদীর স্রোত, জীবন ধারা কিছুই অপেক্ষা করে থাকেনি কারো জন্য। এখন আমার
ছেলের বয়স দশ বছর। ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। আমার স্বামী একজন কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা।
আল্লাহ আমাদের অনেক অনেক সুখে রেখেছেন।
ওহ, বলতে মনে নেই। বিয়ের এত বছর পার হয়ে গেলেও শেলী আর পারভেজের কোল জুড়ে কোনো সন্তান অাসেনি। তারা এখনও সন্তানহারা। হয়তো প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে পছন্দ করে।