"মা আমি পারবো না টাকা দিতে, আমার দুইটা ছেলে, এটা কেন তোমার মানে থেকে না। এই মাসেই বড় ছেলেটার সেমিস্টারের ফিস দিতে হবে, ছোট ছেলেটার বার্থডে এর প্রোগ্রাম করবো একটা রেস্টুরেন্টে। কারো কাছে টাকা চাওয়ার আগে তার পরিস্থিতিটা একটু চিন্তা করতে পারো না? তুমি এত স্বার্থপর কেন? "
নিজের ছেলে শফিকের মুখে আজকে এই  কথাগুলো  শুনে  রাহেলা  বেগম  স্তব্ধ হয়ে  গেলো । হাত থেকে  মোবাইলটা   মাটিতে পড়ে গেলো। মায়ের নেওটা ছেলেটা যে কিনা উচ্চঃস্বরে কোনদিন মায়ের সাথে কথা বলে নি আজ মাকে বলে তার মা স্বার্থপর। রাহেলা বেগম টাকাটা নিজের জন্য চাননি, চেয়েছিলেন তার ছোট মেয়ে শফিকের ছোট বোন শাহানার জন্য । শাহানার চার দিন আগে  একটা  ছেলে  হয়েছে। ছেলেটা প্রিম্যাচুর হওয়ায়  ডাক্তাররা NICU তে ভর্তি করাতে বলেছেন কোন  সরকারী হাসপাতালের NICU খালি না থাকায় শাহানার স্বামী একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করাতে চেয়েছিলো । প্রাইভেট  হাসপাতালের  NICU তে ভর্তি  করতে  হলে  অ্যাডভান্স  করতে  হবে ৫০০০০  টাকা । শাহানার  কেরানী  স্বামীর কাছে  এই পরিমাণ  টাকা না  থাকায় রাহেলা বেগম  তার  ছেলের  কাছে টাকা চেয়েছিলেন। 

  তার ছেলে  ইঞ্জিনিয়ার ।গাড়ি আছে, ফ্ল্যাট আছে।তার ছেলে কি করে বোনের এমন বিপদ দেখেও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে। তার ছেলে এমন ছিল না, নিশ্চয়ই বউ না করেছে। তার ছেলে বিয়ের পর থেকেই বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে। সারাদিন পুত্রবধূকে গালি দিতে  থাকা রাহেলা  বেগমের মনে পড়ে না আজ থেকে ২০  বছর আগে তার গর্ভবতী ছোট ননদ যখন ভাইয়ের বাসায় থাকতে এসেছিলো তখন উনি খুব বিরক্ত হয়েছিলেন । তার
স্বামী ছোট বোনের  জন্য  একবার ডিম, দুধ, ফলমূল কিনে আনতে   রাহেলা বেগম তার স্বামীকে বলেছিলেন, "তুমি  রাজা না, তোমার বোনও  রানী না, অযথা টাকা নষ্ট করবা না, মানুষের কি আর বাচ্চা হয় না। " তার ছোট  ননদকে  যখন   উপজেলা স্বাস্থ্য  কমপ্লেক্সের  ডক্টরেরা কোন প্রাইভেট হাসপাতালে C-section এর জন্য নিয়ে যেতে বলে, রাহেলা বেগম তার স্বামীকে  বলেন, " প্রাইভেট হাসপাতালে নিলেই c section করবে, c সেকশন এ  অনেক খরচ, হাজার হাজার মহিলার নরমালি বাচ্চা হচ্ছে তোমার বোনেরও হবে । তুমি  খামোখা টাকা নষ্ট করতে যেও না। সামনের মাস থেকে ছেলেকে প্রাইভেট টিউটর দিতে হবে। " বউ পাগল রাহেলা বেগমের স্বামী ছোট বোনের c section করাতে রাজি হয় না।
সারারাত নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করে ভোরে তার ছোট ননদ পেটে বাচ্চা নিয়ে মারা যায়।

শাহানা বাড়িতে  তার চার দিনের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ভাইয়া কিছু টাকা দিলেই সে তার ছেলেকে NICU তে ভর্তি করাতে পারতো, তার ছেলেটা হয়তো বেঁচে যেত। বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় তার ছেলেটা মারা যাবে। ভাইয়া তো ভাইয়ার সব চকোলেটে তাকে দিয়ে দিতো ।আজ কেন কিছু টাকা দিলো না । নিশ্চয় ভাবি দিতে দেয়নি । ভাবিকে  মনে মনে তিরস্কার করতে থাকা শাহানার মনে পড়ে না ৫ বছর আগে শাহানা তার স্বামীর ঘাড় থেকে মা বাবা মরা ছোট বোনকে তাড়াতে তার স্বামীকে বাধ্য  করেছিলো  একজন ধুরুনদর  ব্যবসায়ীর  সাথে  তার  ছোট  বোনকে  বিয়ে
  দিতে । শাহানার  ননদ  ঢাকা  ইউনিভার্সিটিতে  চান্স পেয়েছিলো । ভাই ঢাকায় রেখে পড়াতে রাজি হলেও শাহানার অগ্নিদৃষ্টির কাছে হার মানে।

মা বার বার শফিককে ফোন করেই যাচ্ছে । শফিক বার বড় ফোন কেটে দিচ্ছে ।মা এত অবিবেচক কেন? মা কি জানে না তার একটা জীবন আছে, একটা সংসার আছে।
বোনকে কেন সে টাকা দিতে যাবে? সে কি তার বোনের বাবা নাকি?
শফিকের কাল সকালে অফিস ট্যুরে যেতে হবে তাই বড় ছেলেকে বলতে হবে আগামীকাল ছোট ছেলেটাকে স্কুল ড্রপ করে দিতে।
শফিক তার বড় ছেলেকে এই কথাগুলো বলার সাথে সাথে ছেলে তেড়ে এসে বললো, " তোমার কি কোন কমন সেন্স নেই, তুমি জানো কাল মাইশার বার্থডে, আমরা কাল ভোরে মাওয়া যাব। আমি পারবো  না তোমার ছেলেকে ড্রপ করতে।" কথাগুলো বলেই সে ঘরের দরজা জোরে আটকে দিলো। শফিক হতবিহবল হয়ে যায়। কি স্বার্থপর তার ছেলে। দিন রাত গার্লফ্রেন্ড  নিযে পড়ে থাকে । মা বাবা ভাইয়ের জন্য কোন ফিলিংস নেই ।মনে মনে ছেলেকে বকা দিতে দিতে শফিকের মনে পড়ে যা যে সে আজ তার বোনের ছেলেকে বাঁচাতে মাকে টাকা দেয়নি।

আমরা মানুষ জাতটাই মনে হয় এরকম। নিজে কার থেকে কি পাইনি মনে থাকে কিন্তু কাকে কতটা দেইনি সেটা মনে থাকে না । ১০  বছর  আগে  কে  আমাকে কি দিলো না
মনে থাকে  কিন্তু ১০ মিনিট আগে আমি যে কাউকে ফিরিয়ে দিয়েছি সেটা মনে থাকে না। আমরা সবাই অধিকারের ব্যাপারে প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী হলেও কর্তব্যের ব্যাপারে আমাদের আমনেশিয়া  আছে।  যে  অপরাধের  জন্য নিজেকে বেকসুর খালাস দেই, সে একই অপরাধের জন্য অন্যকে যাবজ্জীবন দেই । যে জুতা পড়ে নিজের দুই কদম হাটতে কষ্ট হয়, সেই জুতা কেন অন্য কেউ পড়ে দুই মাইল হাটতে পারে না সেটা নিয়ে কটাক্ষ  করি । যে কষ্ট আজ আমি পাচ্ছি সেই একই কষ্ট আমি কাউকে দিয়েছি কিনা সেটা মানে পরে না । এটা যেন পোড়া পাতিলের পোড়া করাইকে তিরষ্কার করা । ইংরেজিতে একটা কথা আছে Sinners judging sinners for sinning differently.

যে ব্যবহার কেউ আমার  সাথে করলে কষ্ট পেতাম সে ব্যবহার যদি আমরা কারো সাথে না করতাম তাহলে দুনিয়াটা বদলে যেত।

সমাপ্ত