মাঝরাতে বাঁশির সুর শুনে বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে বাবার কাছে চলে গেল রাবেয়া।

- বাবা, তুমি কি বাঁশির সুর শুনতে পাচ্ছ?

- বাবা বললো, রফিক ছাড়া এমন বাঁশি তো কেউ বাজাতে পারে না। তাহলে কি রফিক বাড়িতে এসেছে?
- আমি নিশ্চিত এটা রফিক ভাই হবে। বাবা তুমি ভালো করে শুনে দেখো, ১৬ বছর আগে এভাবেই রফিক ভাই বাঁশি বাজাতো।

১৬ বছর। হ্যাঁ, দীর্ঘ ১৬ বছর পর আজকেই সন্ধ্যা বেলা গ্রামে এসেছে রফিক। ১৮ বছর বয়সে প্রথম যখন ঢাকা শহরে গেল তার ঠিক বছর খানিক পরে সে চলে গেছিল ইন্ডিয়া। পনের বছর যাবত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে আবারও নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে।

রাবেয়ার বাবা হঠাৎ করে যেন অতীতে ফিরে গেলেন। আজ থেকে ১৬ বছর আগে তার অনুরোধ রাখতেই রফিক গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। মা-বাবা মারা যাবার পর রফিক ছোটবেলা থেকে রাবেয়াদের বাড়িতেই বড় হয়েছিল। রাবেয়া তার থেকে দুই বছরের ছোট হলেও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের।
রফিক খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতো, তার বাঁশির সুরে গ্রামের সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। রাবেয়ার সেই কৈশোর জীবনে ছোট্ট মনের মধ্যে রফিক ঠাঁই পেতে থাকে দিনে দিনে।

রাবেয়ার বাবা বিষয়টা বুঝতে পেরেও প্রথমে কিছু বলেননি। তারপর যখন রফিকের এসএসসি পাশ করা হয়ে গেল তখন রফিকের বয়স ১৮ বছর।

রাবেয়ার বাবা মনোয়ার হোসেন একদিন রফিককে নিয়ে নদীর তীরে হাঁটতে গেল। তারপর সেখানেই রফিককে বললো,

- তুই আর গ্রামের বাড়িতে থাকিস না রফিক। তুই শহরে চলে যা, সেখানে গিয়ে একটা ভালো কলেজে ভর্তি হবি৷ তোর পড়াশোনার খরচ আমি ব্যবস্থা করে দেবো। তারপর জানাশোনা হয়ে গেলে কিছু টিউশনি খুঁজে বের করবি।

- আচ্ছা চাচা।

গোধূলির অমলিন বেলায় সেই নদীর তীর থেকে ফেরার পথে মনোয়ার হোসেন বলেছিলেন,

- রাবেয়া আমার একমাত্র মেয়ে রফিক। আমার অনেক স্বপ্ন তাকে ভালো একটা পরিবারে বিয়ে দেবো। তারপর বছর শেষে একবার মেয়ের শশুর বাড়িতে বেড়াতে যাবো আমি আর তোর চাচি।

আধো অন্ধকারে রফিক সেদিন তার চাচার কথা বুঝতে পেরেছিল। মা-বাবা হারিয়ে যেই চাচার কাছে এতদিন মানুষ হয়েছে সেই চাচা তার কাছে নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়েছে। কারণ সে জানে রফিকই পারে তার চাচার স্বপ্ন পুরন করতে। না না ভুল কথা, আল্লাহ না চাইলে কীভাবে স্বপ্ন পুরন হবে?
রফিক জানে তার মা-বাবা নেই। তার সঙ্গে বিয়ে হলে তার চাচা কোনদিন মেয়ের শশুর বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারবে না। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে দেখা তার চাচার স্বপ্ন পুরন হবে না তার জন্য।

রাবেয়ার সরল মনে আঘাত দিয়ে রফিক শহরে চলে গেল। যাবার সময় তার চাচা তার হাতে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো দিয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল,

" পনের ষোল বছরে গ্রামের মধ্যে আসিস না "

রফিক আর পড়াশোনা করতে পারলো না। কোনো একটা কারণে সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বছরের মধ্যে দালাল ধরে চলে গেল ভারতে। চাচার কাছে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল,

" চাচা আর টাকা পাঠানোর দরকার নেই। "

★★

বছর চারেক পরে মনোয়ার হোসেন একটা বড় এক্সিডেন্ট করে তার ডান পা হারায়। ২০ বছর বয়সী রাবেয়ার ৪৬ বছর বয়সী বাবা সারাজীবন এর জন্য বিছানায় পড়ে গেল। শারীরিক আরো কিছু সমস্যার কারণে কোনকিছু ভর দিয়েও আর বাহিরে বের হবার সম্ভাবনা রইল না।

সবেমাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া রাবেয়া তখন সংসারের দায়িত্বে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি গ্রামের স্কুলের কয়েকটা ব্যাচ টিউশনি করাতে শুরু করে। বাড়ির চারিদিকে জমিতে বিভিন্ন শাকসবজি দিয়ে আর মাস শেষে রাবেয়ার সেই টিউশনির টাকায় কোনভাবে চলে যাচ্ছিল সংসার।

অনার্স শেষ করে উপজেলার এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি নিল রাবেয়া। তারও বছর তিনেক পরে এলাকার চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়ে গেল।
মা-বাবার সংসারটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে পারলেও নিজের আর সংসার করা হলো না।

তার বাবা এক্সিডেন্ট করার পর তাকে একদিন রফিক এর এভাবে নিরুদ্দেশ হবার কাহিনী বলেছিল। সবকিছু শুনে রাবেয়া বলেছিল,

- আমাকে কোনদিন বিয়ে করতে বলো না বাবা। জীবনের সকল আদেশ আমি মাথা পেতে নেবো কিন্তু কোনদিন বিয়ে করতে বলো না।

এইতো গেল অতীতের কাহিনী। সত্যি সত্যি আজ ষোল বছর পরে রফিক হয়তো গ্রামের বাড়িতে এসেছে। মনোয়ার হোসেনের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।

- ৩২ বছর বয়সী রাবেয়া বললো, বাবা আমি যদি এখন এই রাতে রফিক ভাইয়ের কাছে যাই তাহলে কি তুমি রাগ করবে?

- কিন্তু এটা যদি রফিক না হয়? মাঝরাতে ঘরের বাহিরে যাওয়া কি ঠিক হবে? আর রফিক যদি সত্যি সত্যি আসতো তাহলে তো আমার সঙ্গে দেখা করতো তাই না রাবু?

- কিন্তু বাবা আমার মন বলছে এটা রফিক ভাই।

- সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর মা, কাল সকালে উঠে জানা যাবে রাতে কে বাঁশি বাজায়।

রাবেয়া চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। বাঁশির সুর বাজতে লাগলো অনবরত। রাবেয়া খুব ভালো করে জানে এটা রফিকের সুর, এই সুর রফিকের বাঁশি থেকে এসেছে।
রাত তিনটার দিকে বাঁশি বন্ধ হয়ে গেল। অপেক্ষায় থাকা রাবেয়া ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত আর ঘুমাতে পারলো না। আজানের পরে চারিদিকে যখন পরিষ্কার হতে শুরু করেছে তখনই বের হয়ে গেল। নামাজ পড়ে নিজের বাবার জন্য চা বানাতে গিয়ে থমকে গেল রাবেয়া।

বাড়ির উঠোনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে রইল রাবেয়া, মুখ থেকে সামান্য অস্ফুটে বেরিয়ে গেল " রফিক ভাই। "

চাচার এক্সিডেন্ট আর রাবেয়ার সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে নিজেকে দোষ দিতে লাগলো রফিক। সে এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে না গেলে রাবেয়াকে এতটা কষ্ট করতে হতো না। রাবেয়ার এই কঠিন জীবনের সঙ্গী হতে পারতো সে।
হঠাৎ করেই চাচার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল।
তার মন সেদিন ঠিকই বলেছিল, " সে চাইলেই তার চাচার স্বপ্ন পুরন করতে পারবে না, যদি আল্লাহ চায় তাহলেই সম্ভব হবে। "

১৬ বছর পর আজ রাবেয়ার মুখে অনেক হাসি। রফিককে শুধু সে একটা কথা বলেছিল,

" তোমার বাঁশির সুর এখনো সেই আগের মতো আছে রফিক ভাই। তুমি মানুষটাও কি আগের মতো আছো? "

রফিক সামান্য হাসি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, হাতে তার বাঁশি। তার চলে যাবার পানে তাকিয়ে রাবেয়া নিজেও তৃপ্তি করে হাসলো।
এই হাসির উদ্দেশ্য হয়তো প্রিয় মানুষকে কাছে পাবার আনন্দ। বয়স অনেকটা পেরিয়ে গেছে, তাতে কি? ভালোবাসার বয়স বাড়ে?