একটা বোবা ছেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে অনেকেই অবাক হয়েছে। কেউ কেউ ভাবছে কোনো লোভে পরে হয়তো আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি কেনো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা আমিই জানি। তাছাড়া এখন আমি আর আবেগের ঘোরে নেই তাই ভুল মানুষকে পছন্দ করার মতো ভুলটা আমি করবো না নিশ্চয়।
একদিন কাজিনরা সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন তারা আমাকে বিয়ের জন্য বোঝাচ্ছিলো। আমি তখনও বিয়ে করতে নারাজ। আমি বললাম যে দেখ কাউকে বিয়ে করে অন্যের কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে একা থেকে কষ্ট পাওয়া ভালো। আর তাছাড়া স্বামীর কথার আঘাতে প্রতি মূহুর্ত রক্তাক্ত হওয়ার চেয়ে রাস্তার মানুষের ছুড়ির আঘাত অনেক ভালো রে। আর তোরা এখন যা আমার ভালো লাগছেনা কথা বলতে। তখন এক ভাই বলে তুই আমার বন্ধুকে বিয়ে করে নে ছেলেটা বোবা,তোকে কিছু বলতে পারবে না আর বেচারাও একটা বউ পাবে। কথাটা বলে হা হা হা করে হেসে উঠলো ।
আমার ভাই কথাটা মজা করে বললেও আমার কাছে কিন্তু মোটেও হাসির কথা মনে হয়নি। তখন থেকেই মনে মনে ভাবতে লাগলাম একটা মানুষ কি কখনো শুধু কথা বলতে না পারার জন্য অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে? বোবা হওয়া তো কোনো অপরাধ না। আর যারা কথা বলতে পারে তারাই কি সবদিক দিয়ে সম্পূর্ণ মানুষ? রাকিব তো ওর মুখের কথা দিয়েই আমাকে খুন করেছিলো। রাকিবের কথা ভাবলেই আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে। কতোই না ভালোবাসতাম আমি রাকিবকে। রাকিবও তো খুব ভালোবাসতো। কতো মধূর স্মৃতি রয়েছে আমাদের দুজনের। কিন্তু রাকিবের দেওয়া আঘাতের কাছে ভালোবাসাটা একদম হেরে গেছে। হেরে গেছে আমাদের সম্পর্ক।
আমাদের সম্পর্কটা বাসায় মেনে নিতে চায়নি। উফফ কতো অপমানই না সহ্য করেছিলাম সবার। আমার আম্মু তো আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলো। কেউ আমার সাথে ঠিক করে কথাও বলতো না এই রাকিবের জন্য। খাওয়া দাওয়া,ঘুম ছেড়ে যখন আমার যায় যায় অবস্থা তখন আমার আম্মু সহ্য করতে না পেরে বললো যা তুই যা চাস তাই হবে। খুশিতে দৌঁড়ে গিয়েছিলাম রাকিবের কাছে। রাকিব ও খুশি হয়েছিলো। সেই দিনটা ছিলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেশি খুশির দিন।
রাকিবের মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা আগে থেকেই ভালো ছিলো। ওনি অনেক ভালো মানুষ। আমাকে নিজের মেয়ের মতোই আদর করতো। ওনি আমাদের বাসায় এসে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে গেলো।
রাকিবের মায়ের সাথে আমার দিনে ৫-৬ বার কথা হতো। এমনকি ভিডিও কলেও কথা বলতাম,ওনি রান্না করতো আমি দেখতাম। ওনি বলতো তুই আসলে আমি কিন্তু রান্নাবান্না থেকে ছুটি নিবো একদম।
সব অপেক্ষার শেষে বছরের প্রথম দিনে ১,জানুয়ারী আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের দিন সবাই এসেছিলো। রাকিবের মা ছেলের বউকে বরণ করার জন্য বাড়িতেই থেকে গেলো। ওনি আগের মানুষ তো ওনার ধারণা ছেলের বিয়ে দেখতে নেই। এসব কারণেই বাড়িতে ওনি একাই ছিলেন।
বিয়ের সব নিয়মকানুন শেষ হয়ে রাকিবদের বাসায় যেতে রাত ১০ টা বেজে যায়। গাড়ি থেকে নামার পরে দেখার কথা ছিলো আমার শ্বাশুড়ি বরণডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। কথা ছিলো ছেলের বউকে ঘরে নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। রাকিবের বাসা অন্ধকার। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। রাকিব আমাকে রেখেই দৌঁড়ে বাসার দিকে গেলো। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। সবাই দরজায় শব্দ করছে কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা।
আমিও আর বসে থাকতে পারলাম না। আমিও চলে গেলাম। আমি গিয়ে দেখি দরজা ভাঙার চেষ্টা চলছে। শেষ পর্যন্ত আমরা দরজা ভেঙেই ভিতরে ঢুকেছিলাম।
গিয়ে দেখলাম রাকিবের মা ফ্রীজের পাশে মেঝেতে পরে আছে। ভাবতেও পারিনি এমন কিছু হবে। ওনার গায়ে হাত দিয়েই বুঝতে পারলাম ওনি আর নেই। আর মায়ের হাত- পা ও শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। বুঝাই যাচ্ছে মা কমপক্ষে ৬ ঘন্টা আগে মারা গেছে। সারা বাড়ি কান্নাকাটিতে ভরে গেলো। আমি নিজেও নিজেকে সামলাতে পারছিনা। এতো আশা নিয়ে আসলাম এই বাড়িতে আর আসতেই হারিয়ে ফেললাম শ্বাশুড়িকে। আর ওনি তো আমার মায়ের মতো না, মা-ই ছিলো।
রাকিব আমার দিকে তাকিয়ে বললো তোর কারণে আমার মা মারা গেছে তুই একটা অলক্ষী। আমি এই কথা শোনে অবাক হলাম মায়ের লাশ সামনে রেখে এখন কিভাবে এসব কথা বলে রাকিব। আর বাড়ির সবাই আমাকে অলক্ষী,অপয়া বলছে। যে যা পারছে বলে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম রাকিবের মাথা ঠিক নাই যা বলার বলুক আমি চুপ থাকি।
মা মারা গেলে সবারই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে এটাই স্বাভাবিক। রাকিবের মনমেজাজ খারাপ দেখে আমার বাবা-মা এসেছিলো রাকিবকে স্বান্তনা দিতে। কিন্তু রাকিব আমার বাবা-মা কে যা ইচ্ছা তাই বলে অপমান করলো। আমি বাধ্য হয়ে মাকে বলেছিলাম প্লিজ তোমরা চলে যাও।তারা চলে গিয়েছিলো চোখ মুছতে মুছতে।
২ মাস হয়ে গেছে তখনও রাকিব আমার সাথে খারাপ ব্যাবহারই করে। আচ্ছা সে আমার সাথে তার কষ্ট প্রকাশ করতেই পারে কিন্তু খারাপ ব্যাবহার কেনো করে!
রাকিব আমাকে আমার নাম ধরে ডাকতো না। অলক্ষী বলেই ডাকতো। এমন অবস্থা হয়েছিলো আমাকে কেউ অনি বলে ডাকলে আমি চমকে যেতাম। অলক্ষী বলে ডাকলে বুঝতে পারতাম আমাকেই ডাকছে।
রাকিব আমার সামনে বসেই বিভিন্ন মেয়েদের সাথে ফোনে আলাপ করতো। উফফফফ সেসব কথা ভাবতে গিয়েও আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। রাকিবের পায়ে ধরেও বলেছি এমন করোনা আমার সাথে। রাকিব শোনেনি। রাকিব ইচ্ছামতো গালাগালি করতো আমাকে।
রাকিব আমার বাপ-মা তুলেও গালি দিতো। এটা আমি সহ্য করতে পারতাম না একদমই। তবুও সহ্য করেছি ১ টা বছর। আর সম্ভব না। রাকিব কথায় কথায় বলতো তোকে আমি ডিভোর্স দিবো। প্রথমে কষ্ট পেলেও পরে চিন্তা করলাম ডিভোর্স দেওয়াই ঠিক সিদ্ধান্ত হবে।
একটা মানুষ এর মন যদি শত নারীর দিকে থাকে সে কখনো বউকে দাম দেয়না। আর বাবা-মা কে কেউ গালি দিবে সেটা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। সে থাকুক তার মতো।
শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স হয়েই গেলো। আমি আছি আমার মতো একা। আমার জীবনের তিক্ত স্মৃতি নিয়ে আমি বেশ আছি। রাকিবও আছে তার মতোই। আজকাল নাকি সে আমাকে মিস করে তার বন্ধুদের কাছে শুনি। এসব শোনলে এখন হাসি পায়।
অনেক রাত কান্নাকাটির পরে আমি তাকে পেয়েছিলাম। তাকে পেয়েও কেঁদেছিলাম। তাকে হারিয়ে এখনো কাঁদি। জন্মই হইছে হয়তো কাঁদার জন্য।
ধ্যাত এসব অতীত নিয়ে ভেবে আর কি হবে। এখন বর্তমান নিয়ে একটু ভাবি। আমি আমার কাজিনকে আবার ডেকে আনলাম। বললাম যে তার ওই বন্ধুর সাথে দেখা করাতে। সে বললো ঠিক আছে তাকে বাসায় নিয়ে আসবো। আমার কাজিন তার বাবা-মাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছিলো।
আমার বাবা-মা কিছুটা রাগ নাফি বোবা দেখে কিন্তু ওনারা না করেনি।
নাফি ওর পরিবারের বড় ছেলে।তিন ভাই অার মাকে নিয়ে নাফির সংসার।বাবার মৃত্যুর পর ওরা তিন ভাই বাবার ব্যবসার দেখাশোনা করে।নাফি বোবা হওয়ার কারণে ও অার বিয়ে করেনি।বরং নাফি তার ছোট ভাই দুটোকে বিয়ে দিয়ে দেয়।
খুব চুপচাপ স্বভাবের ছেলে।নাফি।হৈ চৈ পছন্দ করেনা।ঘরে যতক্ষণ থাকে নিজের রুমে একাই পড়ে থাকে।নাফি ভাল ছবি অাঁকতে পারে।অবসর সময় পেলেই রং তুলি নিয়ে বসে যায়।
অামাকে যেদিন ওরা দেখতে অাসে সেদিনই অাংকটি পরিয়ে দিয়ে যায়।অামি সেদিন কেন যেন একবারের জন্যেও চোখ তুলে নাফির দিকে তাকাইনি।যতক্ষণ ওদের সামনে ছিলাম মনে হয় দম অাটকে ছিল অামার।
বাসর রাতে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবো অার অামার বর এসে মুখ তুলে ঘোমটা সরিয়ে অাদর করে বউ বলে ডাকবে এমনটা হবে না জেনেও অামি খাটের উপর নতুন বউ সেজে বসে অাছি।নাফি ঘরে ঢুকলো খুব জড়সড় হয়ে।ঘরে ঢুকতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো নাফি।বেচারা মুখে উহ্ শব্দটাও যে বের করা সম্ভব ছিল না।অামি দৌড়ে গিয়ে নাফিকে ধরে উঠালাম।নাফি বলতে না পারলেও সব শুনতে পারতো।অামি নাফিকে ধরতেই সে নিজেকে গুটিয়ে নিলো অনেকটা।
-অাপনি ব্যথা পান নি তো?
-ইশারায়া না সূচক মাথা নাড়লো।
-অাপনি খাটে বসুন অামি মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।
-হাত নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো নাফি ব্যথা পায়নি।
নাফি অারও কিছু বলতে চাইলো ইশারায়।কিন্তু অামি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি তার কথা।শেষে বেচারা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যেতে বললো ইশারায়।
বিয়ের ৬ মাস কেটে গেল দেখতে দেখতে।
বিয়ের প্রথম ৬ মাস অামার বুঝতে খুব কষ্ট হতো নাফির ইশারাগুলো।এখন কিছুটা হলেও বুঝি।যেমন ও কি খেতে পছন্দ করে।কোন রংটা তার পছন্দ।মাঝে মাঝে অামাকে বাইরেও নিয়ে যায় ছুটির দিনে।
একবার অামার খুব জ্বর হয়েছিল।নাফি সারারাত অামারে কপালে জলপট্টি দিলো।কোন খাবারই হজম হচ্ছিলো না।মুখ ভর্তি বমি কতবার করেছি হিসাব নেই।নাফি নিজের হাতে সেই বমি পরিষ্কার করেছে।কাজের বুয়া এমনকি অামার ছোট জা দুজনকেও কিছুই করতে দেয়নি।জ্বরের ঐ ৩/৪ টা দিনেই অামি বুঝেছি,অামি ভুল করিনি নাফিকে বিয়ে করে।স্বামী হিসাবে নাফি কতোটা অাদর্শ তা এই ছয় মাসেই অামি বুঝেছি।অামার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নাফি লক্ষ্য করতো।
এতোটা ভালবাসা নাফি অামায় দিবে যা অামি কল্পনা করিনি।
ভালবাসা কি কেবল বলে বুঝাতে হয়?কাজেও যে ভালবাসা প্রকাশ পায় তা নাফিকে জীবনে না পেলে বুঝতামই না।নাফির সেই নিষ্পাপ হাসি,মায়ায় ভরা মুখ,হাতের ১০ অাঙ্গুলের সেই অদ্ভূত ইশারা অামি যত দেখছি ততোই অাকৃষ্ট হচ্ছি।নাফি তার ভালবাসা দিয়ে অামার অতীত এভাবে ভুলিয়ে দিবে ভাবিনি কখনো।
অামার অার নাফির সংসারটা স্বয়ং পরিপূর্ণ হলো যেদিন অামার ছোট্ট মেয়ে পরী পৃথিবীতে এসেছিল।মেয়ের মুখ প্রথম দেখে নাফির চোখে মুখে যেমন অানন্দ অশ্রু বের হচ্ছিল তেমনি বুকে চাপা কষ্ট ছিল মেয়েকে "মা" বলে ডাকতে না পেরে।নাফি যখন খুব কষ্ট পায় তখন কাঁদার সময় ওর মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হয়।সে চাপা শব্দ মেয়েকে কোলে নেয়ার পর অামি শুনতে পেয়েছিলাম।বুঝতে পারছিলাম নাফির না বলা কথা।
জীবনে সুখি হতে হলে অাসলে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়না।প্রয়োজন হয় মনের মতো একটা মানুষের।মনের মতো মানুষ পেলেই জীবনের সব স্বাদ পূরণ করে সেই মানুষটা এক এক করে।
অাজ খুব গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে।চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে,তোমাদের ঐ ইট পাথরের প্রাণহীন,অনুভূতিহীন মানুষগুলোর চেয়ে,কথার অাঘাতে হৃদয় রক্তাক্ত করা মানুষগুলোর চেয়ে, অামার বোবা স্বামীই ভাল।যার ভালবাসার অনুভূতি মুখে বলে বোঝাতে হয় না।যে কেবল তার বোবা অনুভূতিগুলো কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করে।সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই চাওয়া,যুগ যুগ ধরে নাফির মতো স্বামির পাশে থেকে অামি যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।