.
বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অরুণা। ওর বড্ড ইচ্ছে করছে শাড়ি পড়তে। শাড়ির প্রতি অন্যরকম একটা দূর্বলতা কাজ করে ওর। কিন্তু ওর কোনো শাড়ি নেই। আগামীকাল রুদ্র'র সাথে দেখা করার কথা। অরুণার বড্ড ইচ্ছে করছে শাড়ি পড়ে গিয়ে রুদ্রকে চমকে দিতে। কিন্তু শাড়ি কোথায় পাবে এখন? এই শহরে তো রুদ্র ছাড়া আর কেউ নেই অরুণার। একটা শাড়ি কোথায় পাবে সে?
রুদ্রকে ফোন দিয়ে নরম গলায় বললো অরুণা, "জানো আমার না বড্ড শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছে। এত বেশি ইচ্ছে করছে যে, মন চাচ্ছে নিজের কিডনি বেচে শাড়ি কিনি।"
কথাটা শুনে রুদ্র'র চেহারা কেমন দেখালো বুঝতে পারলো না অরুণা। রুদ্র বললো, "কাল একটু তাড়াতাড়ি এসো।"
অরুণা নিশ্চুপ হয়ে গেলো একদম। তার শাড়ি পড়তে এতবেশি ইচ্ছে করছে রুদ্র কি শুনতে পায়নি সে কথা? তাকে অন্তত একবার সান্ত্বনা দিতে পারতো।"
রুদ্র বলল, "তুমি এতদূর আসতে পারবা তো একা?"
- "হু পারবো।"
- "তুমি কি কাঁদছ অরু? কিছু হয়েছে তোমার?"
- "না,কাঁদছি না। কাল কখন আসবো? তোমার পরীক্ষা তো সকাল ১০ টায়।"
- "আমি তোমাকে সকাল ৮ টায় আমার হলের গেটে দেখতে চাই।"
অরুণা'র গাল বেয়ে টপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু বুঝতে দিলোনা রুদ্রকে। শাড়ি পড়ার ইচ্ছেটার কথা চেপে গেলো ভেতরে। রুদ্র ফোন রেখে দিলে অরুণা বেশ কিছুক্ষণ বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদলো। এরকম ইচ্ছে কেন হয় ওর? ইচ্ছেরা কি জানেনা ওর সামর্থ্য নেই? চাইলেই ও হুট করে একটা শাড়ি কিনে পড়তে পারেনা। চাইলেই এক গোছা নীল চুড়ি হাতে জড়িয়ে ঘুরতে পারেনা ও। ইচ্ছেদের জানা উচিৎ ছিলো তার কার কাছে যাওয়া উচিৎ। সবার জন্য সবকিছু মানায় না।
অরুণা অনেক্ষণ ধরে কান্না করার পর উঠে রুমমেট আপুকে বলল, "আপু তোমার শাড়িটা একটু দিবা? কাল একটু পড়ে যেতাম।"
রুমমেট মেয়েটা মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বললো, "আমার সিল্ক শাড়ি পড়লে নষ্ট হয়ে যাবে। আমি নিজেই ওটা বিশেষ দিন ছাড়া পড়িনা। শাড়ি কিনতে পারো না? তোমার বিএফ কে বলতে পারো না একটা শাড়ি কিনে দিবে? বেকার হলেও গার্ল ফ্রেন্ডকে একটা শাড়ি কিনে দেয়ার সামর্থ্য নিশ্চয় ই তার আছে?"
কথাটা শুনে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো অরুণার। ওকে কিছু বললে সহ্য করে নিতো কিন্তু রুদ্রকে নিয়ে এভাবে বললে সহ্য করবে না ও। অরুণা শুধু রুদ্র'র ভালোবাসা টুকুই চায়,রুদ্র'র কাছ থেকে কোনো বস্তু পাবার আশায় সে ওকে ভালোবাসেনি। এভাবে অন্য কেউ কেন বলবে ওকে?
মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার মত অবস্থা হলো ওর। কাঁদতে কাঁদতে এসে ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে কিছু টাকা বের করলো। এই টাকা দিয়ে বাকি মাসের খরচ চালাতে হবে। এটা খরচ করে ফেললে আগামী কয়েকদিন হয়ত নুন দিয়েই ভাত খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছে যে বড্ড বেশি, শাড়ির জন্য এতটাই খারাপ লাগছে যে আর অন্যদিকে মনোযোগ নেই ওর। রাত হয়ে এসেছে। তবুও বেড়িয়ে পড়লো মার্কেটের উদ্দেশ্যে।
একটা শাড়ি, পেডিকোট আর ব্লাউজ কিনে নিয়ে মেসে ফিরল অরুণা। এখন মনটা একটু শান্ত হয়েছে। কম দামী হলেও নিজের বলতে একটা শাড়ি তো হয়েছে ওর। এটাই ঢের।
সারারাত ঘুমাতে পারলো না অরুণা। প্রিয় মানুষ টার সাথে দেখা হবে ভেবে ছটফট করতে করতে কখন যেন ভোর হয়ে গেলো। রুদ্র বলে দিয়েছে সকাল আট টার মধ্যেই ওর কলেজের গেটে থাকতে হবে। অনেক দূরের পথ, ভোরে ঘুমিয়ে গেলে যদি ঘুম না ভাঙে তাহলে আর যেতেই পারবে না। রুদ্র'র ছবিগুলো দেখতে দেখতে রাত পার করে দিলো।
আযান হওয়ার পরপর ই উঠে শাড়ি পড়ে নিলো অরুণা। চোখে মোটা করে কাজল দিলো, হাতে চুড়ি পড়ে চুলগুলো ছেড়ে দিলো। নিজেকে দেখেই নিজের মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। রুদ্রকে ফোন দিয়ে বললো, "আমি এখন বের হবো।"
- "আচ্ছা,এসো।"
- "আমি না শাড়ি পড়েছি।"
রুদ্র অবাক হয়ে বলল, "শাড়ি! আচ্ছা চলে আসো।"
- "আমার না শাড়ি পড়া ভালো হয়নি। আমি একা একাই পড়েছি।"
- "একা কেন? রুমমেট কে বলো পড়িয়ে দিবে।"
- "বলেছিলাম। আপু বলল,ঘুমাচ্ছি এখন উঠতে পারবো না। অনেক দেরিতে ঘুমাইছি।"
রুদ্র এক মুহুর্ত কি যেন ভাবলো। তারপর বলল,"তাহলে শাড়ি খুলে জামা পড়ে আসো।"
- "তুমি কি ভাবছো শাড়ি পড়া ভালো হয়নি? সেজন্য বলছো?"
- "তুমি এমনি তেই অনেক অগোছালো। তার উপর একা একা শাড়ি পড়েছো না জানি কেমন পাগলীর মত দেখাচ্ছে।খুলে রেখে আসো।"
অরুণার কান্না পেয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, "অনেক সাধ করে পড়েছি। পড়ে আসি না?"
- "না, শাড়ি খুলে রেখে আসো।"
- "আমার বড্ড ইচ্ছে করছিলো শাড়ি পড়তে। প্লিজ পড়ে আসি?"
- "বারবার এক কথা ভাল্লাগেনা। শাড়ি খুলে জামা পড়ে আসতে বলেছি। আসলে আসো আর না আসলে নাই। আমার পরীক্ষা আছে, এত রঙ নিয়ে আমি নাই।"
- "আচ্ছা, খুলে রেখে আসছি।"
ফোন কেটে দিলো রুদ্র। অরুণা এক টানে শাড়ি খুলে ফেললো। ওর তো কেউ নেই এ শহরে। কে শাড়ি পড়িয়ে দিবে? রুমমেট যদি না দেয় কিইবা করার আছে ওর? শাড়ি যেভাবে পড়েছে, তাতে খারাপ তো হয়নি। রুদ্র একবার দেখতে পারতো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো ওর। তাড়াতাড়ি জামা পড়ে বেড়িয়ে পড়লো রুদ্র'র কলেজের উদ্দেশ্যে।
কলেজের গেটে রুদ্রকে পেয়ে গেলো ও। কিছুক্ষণ কথা বলার পর রুদ্র পরীক্ষার হলে ঢুকে গেলো। রুদ্র'র মোবাইল আর ব্যাগ নিয়ে ফুটপাতে বসে রইলো অরুণা।
এমন সময় একটা মেসেজ এলো রুদ্র'র ফোনে, "unblocke o korlen na, apnar kono khobor o pacchi na. tension hoyna bolen?"
মেসেজ টা দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো অরুণা'র। মেসেজ বক্সে ঢুকে কিছু মেসেজ পড়ে ফেললো। অন্য একটা মেয়ের মেসেজ দেখে ওর মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছিলো। মেসেজ টা ছিলো এরকম, "তুই সবার আগে এসেই শাড়ির কুচির দিকে তাকাস কেন বলতো? এভাবে শাড়ি ঠিক করে দিস,পার ঠিক করে দিস কেমন লাগে বল? তোর মত কেউ হবেনা। কেউ মিথ্যে করেও বলবে না দেখতে সুন্দর লাগছে, কারো সাথে বের হলে তোকে খুব মিস করবো রে।"
মেসেজ দেখে কেঁদে ফেললো অরুণা। বান্ধবী'র শাড়ি ঠিক করে দেয়া যায় আর তার শাড়ির পার ঠিক করে দেয়া যেতো না? খুব কান্না পেলেও চুপচাপ বসে রইলো। হঠাৎ ই ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো ওর। মেয়েটিকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"আপনি কে আপু? রুদ্র'র সাথে কবে আপনার দেখা হয়েছে?"
মেয়েটি বলল, "সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করুন।"
- "সে তো স্বীকার করছে না, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করা। সে কবে আপনার শাড়ি ঠিক করে দিলো?"
- "সেটা জেনে আপনার কি দরকার?"
অরুণা রেগে বললো, "ঘরে একজনের শাড়ি ঠিক করে দেবে আবার বাইরে আরেকজনের শাড়ি ঠিক করে দেবে তা তো হয়না আপু। ও কার সাথে মেশে সেটা জানাটা আমার দায়িত্ব।"
মেয়েটার সাথে এটুকুই কথা হলো অরুণার। মেয়েটি প্রচণ্ড মেজাজ দেখিয়ে কল কেটে দিলো। অরুণা চুপচাপ বসে রইলো রুদ্র'র জন্য। পরীক্ষা শেষ হলে রুদ্র বেড়িয়ে এলে অরুণা মেয়েটির ব্যাপারে ওকে জিজ্ঞেস করলো। রুদ্র তার বান্ধবীকে কল দিয়ে কি কথা বলেছে শুনতে পেলোনা অরুণা। কিন্তু রুদ্র এগিয়ে এসে অরুণাকে বললো, "এই সাহস কই পাইলি তুই? আমার ফ্রেন্ড কে কল দেয়ার অধিকার কই পাইছিস?"
রুদ্র'র এরকম আচরণে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো অরুণা। কথা বলার মত শব্দ খুঁজে পেলো না। ও যত কষ্ট পেয়েছে তাতে মেয়েটাকে কল দেয়াটাই তো স্বাভাবিক। একটা শাড়ির জন্য গত কয়েকদিন ছটফট করেছে অরুণা। তবুও শাড়ি পড়ে রুদ্র'র সামনে আসতে পারেনি, সেখানে এরকম একটা মেসেজ দেখলে কষ্ট পাওয়ার ই কথা।
রুদ্র রেগে বললো, "তুই আমার জাস্ট গার্ল ফ্রেন্ড, বউ না। আমার ফোন চেক করার অধিকার কে দিয়েছে তোকে? গার্ল ফ্রেন্ড গার্ল ফ্রেন্ডের মত থাকবি। সবকিছুতে নাক গলানোর অধিকার তোকে দেইনি।"
অরুণা কাঁদতে কাঁদতে বললো, "আমি তোমাকে সবকিছু উজাড় করে ভালোবাসি, আমার দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। সেখানে একটা কলের জন্য তুমি এভাবে বললে আমাকে?"
- "হ্যা, কারণ তুই যা করেছিস সেটা ক্ষমার অযোগ্য। তোর জন্য আমার ওর সাথে ৪ বছরের ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট হইছে। তোর সাথে আমার কয়দিনের রিলেশন, আর ওর সাথে ৪ বছরের বন্ধুত্ব। তোর জন্য ও আমাকে ভূল বুঝেছে।"
অরুণা চোখ মুছে বলল, "এত ভালো বন্ধু অথচ আমাকে কখনো কেন তার কথা বলোনি? আর তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে নিজের প্রেমিকার কথা কেন বলোনি? আগে পরিচয় করিয়ে দিলেই সেও ভূল বুঝত না, আর আমিও কষ্ট পেতাম না।"
- "তুই চুপ থাক, আর কখনো আমার সামনে আসবি না। তোর মত মেয়েকে কোনো প্রয়োজন নেই আমার। তুই আমাকে একদম একান্তই তোর করে পেতে চাস। কিন্তু রুদ্র কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না।"
অরুণা'র কথা বলার শক্তিটাও নেই। সামান্য একটা ব্যাপার থেকে কিভাবে কি হয়ে গেলো! রুদ্র'র এ কোন রুপ দেখছে সে! নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না ওর। রুদ্র অনেক রাগ দেখিয়ে নিজের মত চলে গেলো অরুণাকে ফেলে। অনেক অনুরোধ করে, মাফ চেয়ে, হাত পায়ে ধরেও রুদ্রকে ফেরাতে পারলো না অরুণা। মানসিক ভাবে একটু কষ্ট পেয়ে মেয়েটাকে কল দিয়ে নাহয় একটা কথাই বলেছে, তার জন্য রুদ্র অরুণাকে ছেড়ে চলে যাবে? একটা সম্পর্ক কি এভাবে শেষ হয়?
হয়ত হয়। অরুণা এরপর থেকে অসংখ্যবার গিয়েছে রুদ্র'র কাছে। কিন্তু রুদ্র ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। একবার ভাবতেও চায়নি এই অসহায় মেয়েটার কি হবে? তার যে কেউ নেই রুদ্র ছাড়া, ওকে ছাড়া পুরো পৃথিবীটাই অন্ধকার হয়ে যাবে অরুণা'র। একমাত্র ওকে আকড়ে ধরেই বেচে আছে মেয়েটা। সামান্য একটা কারণে তার এরকম বদলে যাওয়া অবিশ্বাস্য লাগছে অরুণা'র কাছে। নিজেকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা আর। কিন্তু রুদ্র আসলেই কি কখনো ভালোবেসেছিলো অরুণাকে? ভালোবাসলে কি এভাবে ছেড়ে যাওয়া যায়?
সারাক্ষণ রুদ্রকে ফোন দিয়ে গালি শুনতে শুনতে নিজেকে নর্দমার মত লাগে অরুণা'র। যখন ই কল দেয়,রুদ্র অপমান করে ওকে। তবুও রুদ্র'র সামনে গিয়ে বারবার ক্ষমা চায়,কিন্তু রুদ্র বলেই দিয়েছে,"রুদ্র কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না। আমাকে ভূলে যাও তুমি।"
অরুণা'র দুঃখ গুলো শোনার মত ও কেউ নেই। ও শুধু রাতের পর রাত বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখে কাটিয়ে দেয়। চোখ ফুলে লাল রঙ ধারণ করে, তবুও ঠেলে কান্না বেড়িয়ে আসতে চায়। সবার জীবনে সবকিছু থাকেনা, সবকিছু সবাইকে মানায় না। অরুণা'র মত অসহায় মেয়েদের হয়ত ভালোবাসতেও মানায় না। সবটুকু উজাড় করে ভালোবেসেও বিনিময়ে এই পেতে হলো! এটাই অরুণা'দের ভাগ্য।
নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ভূলে গেছে অরুণা, কে আছে তার? কেউ নেই দুনিয়াতে। শুধুমাত্র নিজের জন্যই বাঁচতে হয় ওকে, আর তো আপন বলতে কেউ নেই। শুধু আছে একটা শাড়ি, মাঝরাতে যখন রুদ্রকে খুব বেশি মনে পড়ে তখন শাড়িটাকে বুকে জড়িয়েই ডুকরে কেঁদে উঠে অরুণা..