স্যার,আপনি এত বেহায়া কেন.?
ছাত্রীর মুখে এমন কথা শুনে একটু বিচলিত হলাম না,,কারণ আমি তো এমনই,একটা বেহায়া..!
আবার বইয়ে চোখ ডুবিয়ে দিলাম,,সে আবার কিছু বলতে চেয়েও বলল না,,হয়তো বুঝেছে বলে কোনো লাভ হবে না..!
একটু পর বাসার কাজের বুয়া ছোট একটা প্লেটে করে দুই টা টূস বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো,,এরা মনে হয় এক প্যাকেট বিস্কুট শুধু স্যারদের জন্য কিনে রাখে, ,পরে প্রতিদিন সেখান থেকে দুই টা করে বিস্কুট দান করে..!এখানে দান বলার একটা বিশেষ কারণ আছে..সেটা বলা যাবে না..!
প্রিয়ন্তী কে লিখতে দিয়ে আমি বিস্কুট খাওয়া শুরু করলাম,,কামড় দেওয়ার সাথে সাথেই ট্রসস ট্রসসস করে আওয়াজ হচ্ছিল, বিস্কুটের এই আওয়াজ আমার খুব ভালো লাগে তাই ইচ্ছা করেই আরেকটু শব্দ করে খাচ্ছি,,প্রিয়ন্তী মুখ তুলে আমার দিকে আবার তাকালো,বিড় বিড় করে বলল...অসহ্য..!যদিও আমি শুনেছি,,তবুও না শোনার ভান করেই রয়ে গেলাম..!
পড়ানো শেষ ..!রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোয় হাটছি..!এই সময় টায় প্রতিদিনই আমাকে হাটতে হয়,,রিক্সা ভাড়া বাচানোর জন্য..!প্রতিদিনের মত আজকেও সেই কুকুরটা এলো,একদম পা ঘেষে হাটছে,,আর বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে, ,মনে মনে হয়তো বলছে,,'ব্যাটা,একটা বিস্কুট দিবি তাও এতো ভাব নেয়া লাগে..?',প্যান্টের প্যাকেট থেকে লুকিয়ে রাখা একটা টুস বিস্কুট বের করে কুকুরটা কে দিলাম,,মুহুর্তে সে খেয়ে শেষ করে ফেলে,,ছোট বিস্কুট খেতে আর কয় মিনিট লাগবে,,বরাবরের মতো আজকেও সে খুব চুপচাপ হাটছে,আর আমি আজকের ঘটে যাওয়া গল্প শোনাচ্ছি..!
হাটতে হাটতে বাসায় চলে আসি..!কুকুরটা দুই বার ঘেউ ঘেউ করে ঘুরে চলে যাচ্ছিল,,আর আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলাম,,এটাও একটা চাকরি, একটা টুস বিস্কুটের বিনিময়ে বাসায় পৌছে দেওয়া..!
পরদিন দুইবার বেল বাজিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছি,,মিনিট পাচেক হয়ে গেছে,এখনো দরজা খুলে নি,,আরেকবার বেল চাপতে যাবো ওমনি দরজা খুলে গেল,,আজকে হঠাৎ প্রিয়ন্তী নিজেই দরজা খুলে দিল,,তাই হাসি লুকিয়ে রাখতে পারলাম না,,মুচকি হাসি দিলাম,,সে একরাশ বিরক্তি ছুড়ে দিয়ে হন হনিয়ে চলে গেল..!
প্রিয়ন্তীর এমন আচরণের একটা কারণ আছে,,সেটা আমি নিজেই..!
প্রথম যেদিন ওকে পড়াতে আসলাম সেদিনও সে ই দরজা খুলে দিয়েছিল..!তবে সেদিন তার মুখ জোরে ছিল সদ্য ফোটে ওঠা গোলাপের পাপড়ির ন্যায় মিস্টি হাসি,,যে হাসিতে মুহুর্তে যে কোনো ছেলে জ্ঞান হারাবে,,তবে আমার কিছুই হয় নি,কারণ আমি যে মধ্যবিত্ত ..!আমাকে সবকিছু দেখতে নেই..!তাছাড়া আমি ওকে পড়ারে এসেছি প্রেম করতে না..!
প্রথম দিন পড়াতে চাইলেও সে পড়ে নি,,এক ঘন্টা সময় বিভিন্ন গল্প করেই পার করেছে আর আমি নির্বাক দর্শকের মত সব শুনেছি..!সেদিনও বুঝি নি ও কি চায়..?
পরদিন থেকে পড়ানো শুরু করি,,কিন্তু মেয়েটা একদম পড়তে চাই তো না,,ওর বান্ধবীরা কয় টা করে প্রেম করে,,প্রেমিক কে নিয়ে কবে কোথায় ঘুরতে গিয়েছিল এসব গল্প করতে চায় তো...!আর আমি বার বার মানা করে তাকে পড়াতে চাইতাম..!সে মন খারাপ করে বসে থাকতো,আর আমি মনে মনে হাসতাম..!
দশম দিন..! আজকেও প্রিয়ন্তী নিজেই দরজা খুলে দিল ,আজকে ওকে অন্য রকম লাগছিল..!আর লাগবেই না কেন..?টুকটুকে লাল শাড়ি,খোপায় জবা ফুল,ঠোটে গাঢহ লিপস্টিকে একদম নব বধু মনে হচ্ছিল,,এসব কিছুই আমার গায়ে মাখালাম না,চুপচাপ বললাম 'পড়ার টেবিলে আসো..!!
সে চমকে গেল..! চোখ দুটি ছোট করে চেহারা ফ্যাকাসে করেছিল,,মনে মনে হইতো ভেবেছিল "আমি তার রুপের প্রশংসা করবো.."!ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আবার মনে মনে হাসলাম..!
বই হাতে নিয়ে, পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম..."আজকে এভাবে সেজেছো কেন??
সে অভিমানী সুরে বলল.."আপনার জানা লাগবে না.."
আর কিছু বলিনি..!হইতো ভেবেছিল ..""আরো গোটা কয়েক প্রশ্ন করবো, আর সে বাধ ভাঙা উল্লাসে তার উত্তর দিবে..!কিন্তু আমি আর কোন প্রশ্ন করিনি..!
সেদিন সে একবারো বই হাতে নেয় নি..!!সে বলেছিল,"স্যার আমি যদি বলি আপনাকে ভালোবাসি তবে আপনি কি উত্তর দিবেন..?"আমি এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেয় নি..!আধ ঘন্টা বাস্তব আর আবেগ বুঝানোর পর যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ,,"কি বুঝেছো??চিৎকার করে ""না....বলে বইগুলো টেবিল ছুড়ে দিয়ে হন হন করে চলে যায়..!সেদিনও আমি মনে মনে হেসেছিলাম,,খুব,,খুব হেসেছিলাম..!
এরপর থেকেই সে বদলে যায়..!বসন্ত শেষ না হয়েই গ্রীষ্মের আগমণ ঘটে,,সদ্য গজিয়ে ওঠা ফুলের কুড়ি গুলি গ্রীষ্মের প্রখর রোদের পুড়ে ছার খার হয়ে যায়..!আর আমি চোখে মণি থেকে হয়ে যায় দু চোখের বিষ..!প্রতিদিন নানা ভাবে খোটা দিয়ে কথা বল্লেও চুপচাপ সহ্য করতাম,,কারণ আমি তো মধ্যবিত্ত, টিউশনির এই বেতন মাস শেষে আমাকে সস্থির হাসি হাসাবে..!মাঝ মাসে চলে গেলে কি বেতন দিবে..??
বন্ধুদের বলেছিলাম একটা চাকরি দেখতে আর সেটা পিয়ন বা দারোয়ানের হলেও সমস্যা নেই..!তাও তো প্রতিদিন এই টুস বিস্কুট আর ছাত্রীর কাছে বেহায়া কথা টা শুনতে হবে না..!
আজকে টিউশনি শেষ বেতন পেয়েছি, ,টাকা হাতে নিয়ে এক মিনিট ও দাড়ায় নি,,ভাবছি আজ কুকুরটা কে বিরিয়ানি খাওয়াবো..!শুকনো টুস বিস্কুটে হয়তো মুখে অরুচি ধরে গেছে..!!কুকুরের সামনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দিয়ে আরেক প্যাকেট বিরিয়ানি আমি খাচ্ছি..আর মধ্যবিত্তের টিউশনির গল্প করছি,,আচ্ছা কুকুরটা কি আমার কথা বুঝতে পারে ..?? হয়তো পারে ..!!কারন শেষ কয়দিন বাসার কাজের বুয়া টা আর বিস্কুট বা পানি কিছুই দিয়ে যেতো না,,হয়তো প্রিয়ন্তীর নিষেধ ছিলো..!
রাস্তায় হাটার সময় কুকুরটা যখন বার বার আমার দিকে তাকাতো আর আমি তখন নির্লজ্জের মত ওকে বলতাম ""সরি রে..!আজকে ওরা বিস্কুট দেয় নি..!!ওর মাঝে কোনো পরিবর্তন আসতো না,,চুপচাপ প্রতিদিনের মতই হাট তো,,আমি বাসায় পৌছানোর পর দুই বার ঘেউ ঘেউ ডেকে চলে আসতো...!আর আমি চোখ মুছতাম.........!!!