.
রাত তখন সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি।
অফিস শেষে লোকাল বাসে করে বাড়ি  ফিরছিলাম।
বউয়ের ইচ্ছা ছিলো ইলিশ মাছ খাবে। তাই এত রাত, ইলিশ মাছের সন্ধানেই পার হয়ে গেলো।
রাত ১১ টার সময় ইলিশ মাছ পাওয়াটা সহজ না। কিন্তু এই শহরে টাকা থাকলে ইলিশ মাছ কেন,বাঘের দুধ ও পাওয়া যায়।
যে বাসটায় উঠেছি,মোটামুটি লক্কর ঝক্কর মার্কা তৃতীয় শ্রেনীর বাস। অধিকাংশ যায়গায় রঙ চটে গেছে এবং সামনের কাচের বিরাট অংশ ফাটা।
উঠতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। কিন্তু কিছু একটা ভেবে উঠে পড়লাম।
সারাদিনের ক্লান্তিটা ঝেড়ে ফেলতে বাসের ছিটে গা এলিয়ে দিলাম।
যাক! আর চিন্তা নেই। কাল  অফিসে অফ ডে। কালকেই বউয়ের হাতে ইলিশ রান্না খাওয়া যাবে।
এদিকে শ্রাবণ মাসের আকাশকে আমি কোন দিনই বিশ্বাস করি নাই।
সারাদিন কাঠফাটা রোদ উঠলেও,এই মধ্যরাতে ঝরঝর করে ঝড়তে শুরু করলো।
ব্যাপারটা মন্দ না।
জানালার কাচে বৃষ্টির ফোটা এসে লাগছে। অপরদিকে হাল্কা একটা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। মুহুর্তেই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো।
ইলিশের ব্যাগটা রাস্তার ধাক্কায় সরে যাচ্ছিলো। ব্যাগটা ভালোভাবে সোজা করে নিতেই খিলখিল হাসির শব্দ কানে আসলো। যেন কয়েকটা কাচের চুড়ি একসাথে বেজে উঠলো।
আমি ঘাড় ঘুরালাম। পুরো বাসে আমি সহ মোট ৬ জন যাত্রী। চারজন আগে বসেছে। মাঝখানে আমি আর শেষে একটা মেয়ে।
মেয়েটার হাসিতেই মুগ্ধ হচ্ছিলাম।
এদিকে আমি বিবাহিত পুরুষ। অন্য কোন দিকে তাকানোর ইচ্ছা আমার নাই। তাই কিছু না বলে মাছ ঠিক করাতে মনোযোগ দিলাম।
হঠাৎ করেই আমাকে অবাক করে দিয়ে পিছনের মেয়েটা আমার পাশের ছিটে বসলো। আমি একপ্রকার চমকেই উঠলাম।
-ইলিশ মাছ নিচ্ছেন বুঝি?
বৃষ্টির শব্দ বেড়ে যাওয়ায় কথা শোনা যাচ্ছিলো না ভালোভাবে। তাই আমি বললাম,
-জ্বি?
এবার মেয়েটা আরেকটু কাছে আসলো। আমিও চেহারা দেখার সুযোগ পেলাম।
টানা টানা চোখ,লম্বা পাপড়ি,সরু নাক,বুদ্ধিদীপ্ত কপাল।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত সুন্দর মেয়ে আমি এ জীবনে কখনো দেখি নাই। নিঃসন্দেহে এই মেয়ে বিশ্বসুন্দরী এ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্য। 
কিন্তু ওই যে,আমি বিবাহিত পুরুষ।
কোনমতে তাকে অগ্রাহ্য করে বললাম,
-আপনি ওই পাশের ছিটে গেলে ভালো হয়।
মেয়েটা আবারও খিলখিল করে হেসে ফেললো। এবার নুপুরের শব্দ কানে ভেসে আসলো।
নড়েচড়ে বসে উত্তর দিলো,
-ইলিশ মাছ খাওয়ার ইচ্ছা নাই নাকি?
এবার আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। ছিনতাইকারী টাইপের কেও নয়তো?আমাকে ফাসিয়ে সবকিছু কেড়ে নিবে? এ শহরে কাওকে বিশ্বাস নেই।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
সে আবারও বলতে শুরু করলো,
-আপনি ইলিশ মাছটা সর্ষেবাটা দিয়ে রান্না করতে পারেন। কিংবা গরম তেলে চটচটে করে ভেজে গরম ভাতের সাথে ঘি দিয়ে খাবেন। তেলের মধ্যে অল্প একটু এলাচ দিবেন। সুগন্ধ ভালো আসবে।
আমি তার কথায় ভরসা পাচ্ছিলাম না। মাছের ব্যাগটা যতসম্ভব নিজের কাছে টেনে নিলাম।
-আর বড় সাইজের মাছ হলে টুকরা বেশি না করাই ভালো স্বাদ কমে যাবে। আপনি কি জানেন? ইলিশ মাছের কিছু অংশ হরিণের মাংসের সাথে তুলনা করা যায়?
এইবার সত্যি সত্যিই আমি ঘাবড়ে গেলাম। বেশ ভালো একটা ভেজালে পরে গিয়েছি।
তাকে পাশ কাটিয়ে অন্য ছিটেও বসতে পারছি না।
-আর কাচা ইলিশ মাছের স্বাদ তো অন্য রকম। কয়েক মাইল দূর থেকেই গন্ধ পাওয়া যায়।
এইবার আমি বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি? আমার মনের ভয় আরো ঘনীভুত হতে লাগলো।
কথা শেষ করেই সে একটা হাসি দিলো।
এক মুহুর্তের জন্য তাকে আর রূপবতী মনে হচ্ছিলো না। হাসিটা ভয়ংকর।
সেই সাথে তার সারা গা বেয়ে আভার মতো আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো সেগুলো এসে আমার মস্তিষ্কে আঘাত করছে।
আর কিছু মনে নেই আমার।
আমি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যাই।
আমার জ্ঞান ফেরে পরদিন সকালে হাসপাতালে।
আমি সেই বাসের হেল্পারের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছিলাম,
ওইদিন আমাদের সাথে কোন মেয়ে বাসে ওঠে নাই। আর আমার ইলিশ মাছের ব্যাগ নাকি জানালার সাথে ঝুলে ছিলো। ভিতরে মাছ উধাও।
পরবর্তীতে আমি মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে যোগাযোগ করি। তার ব্যাখাগুলো যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে।
তিনি আমাকে জানান,
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা আয-যারিয়াত এর ৫৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
" আমি জ্বিন এবং মানব জাতিকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি"
আর সূরা আর রাহমান এর ১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  বলেছেন,
"আমি জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি অগ্নিশিখা হতে".
ইমাম সাহেব আমাকে আরো যা যা জানান,তার সারমর্ম হচ্ছে, জ্বিন জাতিরা মানুষের রূপ ধারণ করতে পারে এবং এদের মধ্যে মেয়েরা অসম্ভব রূপবতী হয়।
আর জ্বিন জাতির প্রধান খাবার হচ্ছে মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবারের হাড় এবং গোবর। তাছাড়া জ্বিন জাতির মেয়েদের মাছের প্রতি অনেক আকর্ষণ।

আমার সাথে ওইদিন কি হয়েছিলো আমি জানি না। কিন্তু ইমাম সাহেবের সমস্ত ব্যাখা শোনার পর আমার বিশ্বাসযোগ্য ই মনে হয়েছে।
এ শহরে আসলে অনেক কিছুই ঘটে।বেশিরভাগই আমাদের লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সৃষ্টিকর্তাও আমাদের এর মধ্যেই পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন। কেও হয়তো এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবো,কেও হবো না।
দিনশেষে এই শহরের সবটুকুই রহস্য থেকে যাবে। হ্যা,রহস্য।
.