আজ আমাদের বাড়িতে বিচার বসবে। আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান থাকবেন বিচারে।  এলাকার মুরুব্বিরা এবং আমাদের নিকট আত্মীয় স্বজনরা।

ঠিক বিচার বলা যায় না এটা কে বন্টন করা যাকে বলে আরকি। আমি বিশ বছর পর দেশে ফিরেছি এখন থেকে দেশেই থাকব চিন্তা করেছি। এখন আমার একটা ঘর তুলতে হবে জায়গা দরকার।  যদিও বাড়িতে একটা দুইতলা ঘর আছে যার টাকা আমিই দিয়েছি তবুও সেই ঘর আমার না!

বিচার শুরু হবে বিকাল পাঁচটার সময়। আমাদের বাড়ির ছাদে।  আমাদের বাড়ি বলা মনে হয় ঠিক না কারণ এ বাড়িতে আমার কোনো অধিকার আছে কিনা তা এখনো বলতে পারছি না!

আমার শশুর একটু আগে আগে চলে এসেছেন।  আমি অবশ্য জানি না উনাকে খবর কে দিয়েছে!  মনে হয় আমার বাবা খবর দিয়েছেন।  উনি আমার ওপর একটু রেগে আছেন আমি উনাকে কিছুই জানায়নি বলে। এ বাড়িতে আসার পরও ওনাকে কেউ এখনো পর্যন্ত সমাচার জিজ্ঞেস করেনি! আমার বাবা, মা, বা ছোট বোন ও ছোটো ভাই কেউ ওনার সাথে কথা বলেনি।

আমি একটা চেয়ার আনতে গেলাম উনার বসার জন্য। আমার ছোট ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। একবার এসে বলল না আমি চেয়ার নিচ্ছি!  ছোট বোনটাও কাছে এলো না! আমি ওদের বড়ো ভাই এত বছর ধরে এ পরিবারের দায়িত্ব পালন করেছি। হয়ত খুব ভালোভাবে পারিনি!

মোটামুটি সবাই হাজির হয়েছেন। আমাদের চেয়ারম্যান চাচাও চলে এসেছেন।  আমাকে দেখে বললেন,  "কেমন আছ শফিক?" বলেই উনার মুখটা কেমন মলিন  হয়ে গেল! হয়ত আঁচ করতে পেরেছেন আমার এখন কেমন থাকার কথা।

আমার বাবা, ছোট ভাই, ছোটবোনটাও এসেছে!  ওরা সবাই একদিকে বসেছে! আমি অন্যদিকে। চেয়ারম্যান চাচা বললেন,  "নোমান বল তোমার কি বলার আছে? " নোমান আমার ছোট ভাই। উঠে দাঁড়াল। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ।

"চাচা এখানে বলার কি আছে! বড়ো ভাই তার জায়গা জমি বিক্রি করে বিদেশে গেছেন।  এত বছর আমাদের কোনো খবর নেননি!  এখন দেশে এসে ওনার জায়গার ভাগ চান! এখন আপনারাই বলেন এটা কোন বিচার?"

ছোট ভাইয়ের কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেছি! খেয়াল করলাম আমার বাবা একটি কথাও বললেন না! মানে উনি নোমানের কথার সাথে একমত! আমার মা অবশ্য সকাল থেকে কান্নাকাটি করছেন! এ বাড়িতে উনি থাকবেন না! যে ছেলে সবার জন্য এত কিছু করল সেই ছেলের বাড়িতে জায়গা হবে না! সেই বাড়িতে উনি থাকবেন না। বড়ো ছেলে তাকে না খাওয়াতে পারলে ভিক্ষা করে খাবেন। অন্যরা মায়ের কথার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না! আমার স্ত্রী মা কে বলছে আমি খেলে আপনিও খেতে পারবেন মা। আমার খুব ভালো লেগেছে মিলার কথা শুনে। এমন একটা ভালো মেয়ে কে আমি স্ত্রী হিসাবে পেয়েছি!

চেয়ারম্যান বললেন, " তোমরা বলতে চাও শফিক তোমাদের কোনো টাকা পয়সা দেয়নি?"

"একেবারে দেয়নি তা বলব না। বড়ো যা করেছে তা অস্বীকার কেন করব! প্রথমদিকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন।  তারপর থেকে বাবা-মার খরচের জন্য সমান্য টাকা দিতেন মাসে মাসে। যা দিয়ে বাবা-মায়ের ওষুধ খরচ হতো না!"

আমার যতদূর মনে পড়ে আমি কোনো মাসে পনেরো হাজার টাকার কম পাঠায়নি। আমার বাবা মা মাসে পনেরো হাজার টাকার ঔষুধ খায়! এত বড়লোক আমরা কবে হলাম! বিদেশ যাওয়ার আগে আমার বাবার মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকার কম ছিলো। ঠিক মতো খেতেও পেতাম না! 

চেয়ারম্যান চাচা এসব শুনে নীরব হয়ে গেলেন! আমাকে বললেন,  "শফিক তোমার কিছু বলার আছে?
"

"না চাচা আমার কিছু বলার নাই।" আমার শশুর কিছু বলতে চাচ্ছিলেন আমি ইশারায় মানা করলাম।

"গ্রামের একজন মুরুব্বি আমজাদ চাচা বললেন, শফিক তোমাদের তেমন টাকা পয়সা দেয়নি! তা তোমাদের বাড়িতে বিল্ডিং উঠল কেমনে? তোমার বাবার অবস্থা তো আমরা সবাই জানি।

আমার ছোটোবোন বলল, "ছোট দা ব্যবসা করে এ সব গড়েছেন।"

"তাই!  তোর ছোট ভাই ব্যবসা করার টাকা পেলো কোথায় রে রুমকি?"

আমার ছোট ভাই বলল, "বলতে লজ্জা লাগছে কাকা! আপন বড়ো ভাই বিদেশে থাকতে শশুর বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম।"

বাঃ! কী সুন্দর করে ওরা বলছে! অথচ নোমানের ব্যবসার জন্য আমি পাঁচ  লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলাম!

বিচার আর কী হবে? আমি এদের জন্য কিছুই করিনি! যে জায়গা বিক্রি করে বিদেশে গেছি তাই আমি কিনে দেইনি! এখন আমাদের যে সব জায়গা জমি আছে সব নোমানের নামে।

চেয়ারম্যান চাচা বললেন,  "শফিক তোমার জন্য দুঃখ হয় কিন্তু আমরা কী বলব বাবা? কাগজ পত্র সব তো তোমার বিপক্ষে কথা বলে।"

আমার শশুর বললেন, " শফিক তো তাহলে এ বাড়ির ছেলেই না! ওর কোনো অধিকার নেই? "

আমার বাবাও এ কথা শুনে কিছুই বলল না! রায় হয়ে গেল সবার সম্মতিতে এ বাড়িতে আমার কোনো অধিকার নাই! আমার বাবা, ছোট ভাই, বোন সবার মুখে হাসি। আমার শশুর গোমড়া মুখে বসে আছেন।  বিচার শেষে আমি উঠে দাঁড়ালাম চেয়ারম্যান চাচা বললেন," তুমি কিছু বলতে চাও শফিক?"

জি, চাচা।

"এখন তো করার কিছু নাই! বলো শুনি।"

"চাচা আজ আমার খুব খারাপ লাগছে! " আমার ছোটবোন আমার কথা শুনে ঠোঁট বাঁকাল!

"এ বাড়িতে আমি কোনো জায়গা পাইনি। আমি আমার পরিবারের জন্য যা করেছি তা সবাই অস্বীকার করল এর জন্য খারাপ লাগছে তা না চাচা। খারাপ লাগছে আমি একজন মানুষের কাছে হেরে গেছি! খুব গর্ব করেছিলাম আমার পরিবার নিয়ে আজ তা ধুলোয় মিশে গেছে!"

আমার ছোট ভাই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলল," এ সব কথা শুনার সময় নেই আমার আমার কাজ আছে চেয়ারম্যান চাচা আমি উঠব।"

"বিচার তো শেষ তুই যেতে চাইলে চলে যা।"

ছোটো ভাই উঠল না অবশ্য। কেন উঠল না জানি না!

"তুমি বলো শফিক আমরা শুনতে চাই।" এলাকার মুরুব্বিরা বললেন।

আমি যখন প্রথম বিদেশে গেলাম। প্রথমে যা আয় হতো সব বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম। নিজে কত কষ্ট করে চলেছি যেন একটু বেশি টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারি।

আমার সাথে থাকে খালেদ ভাই। বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে এখনো বিদেশে পড়ে আছে। দেশে যেতে চায় না! বলেন, মরলে তাকে যেন এই দেশে কবর দেয়া হয়! খালেদ ভাই আমাকে ডেকে, "বললেন শফিক তুই তো আমার পথে হাঁটছিস!"

"আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ভাই কী বলছেন? "

"দ্যাখ আমি তোর মতো যা আয় করতাম সব দেশে পাঠিয়ে দিতাম বাবার কাছ। নিজের কথা ভাবতাম না। সব তো আমাদেরেই থাকবে। পনেরো বছর বিদেশে থেকে দেশে গিয়ে দেখলাম আমার কিছুই নাই! ভাই-বোন সব কিছু ওদের নামে করেছে! এমনকি বাড়িতে আমার থাকার জন্য এক টুকরো জমি পর্যন্ত নেই! তাই তো আবার বিদেশে এসে পড়ে আছি। তুই আমার মতো ভুল করিস না।"

"ধুর ভাই কী বলেন! আমার ভাই বোন এমন না। ওরা কখনো আমার সাথে এমনটা করবে না।"

খালেদ ভাই একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন,  "আমিও তো তোর মতো ভাবতাম রে বোকা!"

"আপনি কী বলতে চান আমি আমার বাবা-মা,  ভাই-বোন কে টাকা দিবো না!"

"দিবি না কেন! অবশ্যই দিবি যা ওদের প্রয়োজন ততটুকু দিবি। টাকা থাকলে ওদের জন্য দেশে গিয়ে কিছু করতে পারবি। তোর পরিবার ভালোভাবে চলতে যতটা লাগে পাঠা বাকিটা তোর কাছে রাখ। "

আমি বিদেশ যাওয়ার আগে আমার বাবার কত টাকা আয় ছিলো? আমি বিদেশ যাওয়ার পর মাসে বিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছি।  সেই টাকায় আমার বাবা-মায়ের ওষুধ খরচ হায়নি চাচা!

গত বছর যখন আমার একটা এক্সিডেন্ট হলো। আমার পরিবার খবর শুনে বুঝে ফেলল। আমার আয় বন্ধ হয়ে গেছে!  আমি এখন খোড়া ঘোড়া কাজেই আমাকে তাদের দরকার নাই! আমার সাথে আর যোগাযোগ করে না! বাকিটা তো আপনারা দেখলেনেই! ওদের টাকা আমার প্রয়োজন নাই, না জায়গার প্রয়োজন আছে! আমি এবিচার ডেকেছিলাম খালেদ ভাইয়ের কথায়। ওনার কথাই সত্যি হলো! আমি হেরে গেলাম চাচা! ওই মানুষটা হাসছে! 

আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে। আমার এক্সিডেন হওয়ায় কোম্পানিও আমাকে ভালো পরিমান ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।  আমি আমার মাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।