'যাদের বাসায় ফ্রিজ নেই তাদের আবার এতো ঠান্ডা পানি খেতে হবে কেন!' ছোট্ট আহাম্মেদ পানি রেখে যাওয়ার পরে উপরতলার মহিলার সঙ্গে মুখ ভেংচি কেটে এই কথাটাই বললো হালিমা বেগম। 

ওপাশে আহাম্মেদ বাসায় গিয়ে আনন্দিত গলায় মা'কে বললো, 'মা। পানি রেখে এসেছি। আজকেও ঠান্ডা পানির শরবত খাব।' 

আহাম্মেদের মা আয়েশা হেসে বললো, 'ইনশাআল্লাহ বাবা।'

আহাম্মেদের বাবা স্বল্প বেতনে একটা চাকুরি করে। কয়েক মাস আগেই গ্রাম থেকে শহরে এসেছে আয়েশা ও আহাম্মেদ। শহরেই এবার আস্তে আস্তে করে নিজেদের সংসার গুছিয়ে নিচ্ছে আয়েশা। এখনো ফ্রিজ কিনে উঠতে পারেনি। প্রয়োজনীয় অনেক কিছুও কেনা বাকি রয়েছে। 

রমজান মাস চলে এলো। গরমের দিনে শুকিয়ে থাকা গলাটা সারাদিন রোজা শেষে ইফতারিতে নরমাল পানিতে যেন ভিজতে চায় না। পাঁচ বছরের আহাম্মেদও মাঝে মধ্যে মন খারাপ করে বলে, 'এই গরমে একটু ঠান্ডা পানি হলে ভালো হতো তাই না মা?'

পাশের ফ্ল্যাটের হালিমা বেগমের সঙ্গে বেশ সম্পর্ক জমেছে আয়েশার। সেই সম্পর্কের জায়গা থেকেই একদিন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে বলে ফেলে আয়েশা, 'ভাবী, রমজানের কয়েকটা দিন আপনার ফ্রিজে একটু পানি রাখা সম্ভব হবে?'

সহানুভূতি দেখাতেই হালিমা বেগম বললো, 'অবশ্যই। আপনি আহাম্মেদকে পাঠিয়ে দিবেন। গরম যা পড়েছে দিন দিন।'

হালিমা বেগমের এমন আশ্বাসে বেশ খুশি হয় আয়েশা৷ এবার ঈদে মূল্যছাড় দিলেই একটা ফ্রিজ কিনবে ভেবে রেখেছে আয়েশা। বেশকিছু টাকা জমিয়েও রেখেছে সে। 

মুখে হ্যাঁ বললেও ভেতরে ভীষণ বিরক্ত হয় হালিমা বেগম। রোজ এভাবে আহাম্মেদের পানি রাখতে আসা নিয়ে বেশ ঝামেলা অনুভব করে তিনি। ভদ্রতার খাতিরে বলতেও পারছে না কিছু। 

একদিন আহাম্মদ পানি রাখতে এলে হালিমা বেগম ভেবে চিন্তে বলে দেয় ফ্রিজে জায়গা খালি নেই৷ আহাম্মেদ মন খারাপ করে পানির বোতল হাতে ফিরে আসে বাসায়। পাশে বসে আয়েশা সান্ত্বনা দেয়। 

খানিক বাদেই হালিমা বেগম আসে আয়েশার বাসায়। অনুতপ্তের স্বরে বলে, 'কী বলব ভাবী! ফ্রিজে এতো জিনিস যে নিজেদের একটা পানির বোতল রাখব তারও জায়গা নেই৷ আপনি কিছু মনে করবেন না দয়া করে।'

আয়েশা কৃতজ্ঞতার স্বরে বলে, 'না, না৷ কেন মনে করব! আপনি যথেষ্ট উপকার করেছেন এ কয়দিন।'

হালিমা বেগম চলে গেলে তার ছোট ছেলে মুরাদ আহাম্মেদের সঙ্গে খেলতে চলে আসে। পাশেই রান্নাঘর। রান্না করছে আয়েশা। রান্নার পাশাপাশি খেয়াল রাখছে বাচ্চাদের দিকেও।

খেলতে খেলতে মুরাদ বলে, 'জানো আজ মা বলেছে, তোমাদের পানির বোতল আর রাখবে না। রোজ রোজ পানি রাখো বলে মা খুব বিরক্ত হয়৷' 

আয়েশা রান্না থামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এভাবে হালিমা বেগমকে বিরক্ত করেছে ভাবতেই লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে তার।

আহাম্মেদ প্রশ্ন করে, 'কিন্তু আন্টি যে বললেন ফ্রিজে জায়গা খালি নেই।'

'তা তো মা এমনি বলেছে। মা'ই তো বললো আপার সঙ্গে, পানি রাখতে বলেছি তাই বলে কী রোজ রাখতে আসবে! একটা ফ্রিজ কিনে নিলেই তো পারে।'

আহাম্মেদকে চুপ করে থাকতে দেখে মুরাদ বললো, 'তুমি মন খারাপ করো না। আমি লুকিয়ে তোমাকে ফ্রিজ থেকে আমার রাখা ছোট্ট একটা বোতল এনে দিব। তুমি ওই পানি খেও৷ ঠিক আছে?'

আহাম্মেদ শান্ত গলায় বললো, 'না। ঠান্ডা পানি লাগবে না। আমার এখন আর ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করে না।'

আয়েশা চুপচাপ রান্না শুরু করে। হালিমা বেগমের প্রতি তার একটুও ক্ষোভ জন্মালো না মনে। বরং ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত হচ্ছে সে, নিজের অজান্তেই এতোদিন তাকে বিরক্ত করার কারণে। তবে আহাম্মেদের জন্য মন খারাপ হয় তার। আবার এটা ভেবেও খুশি হয়, ছেলে তার বুদ্ধি করে কথা বলতে শিখেছে। 

দিন দিন গরমের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বৃষ্টির দেখা নেই তবুও। সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আয়েশা। মায়ের কষ্ট একটু একটু অনুভব করে আহাম্মেদ। 

রান্নাঘরে রান্না করছিলো আয়েশা। আহাম্মেদ এসে আয়েশার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ডায়নিংরুমে। 

ডায়নিংরুমে যেতে দেখে অযথাই ফুল স্পিডে ফ্যানটা চলছে। আয়েশা ফ্যানটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় আহাম্মেদ চেঁচিয়ে বললো, 'ওটা বন্ধ করো না মা।'

'কেন?'

'ফ্রিজ ঠান্ডা রাখতে তো ফ্যানের দরকার।'

অবাক হয়ে আয়েশা জিজ্ঞেস করলো, 'কিসের ফ্রিজ?'

আহাম্মেদ হাত ইশারায় একটা লাল রঙের বালতি দেখিয়ে দিলো। বালতির ভেতরে কী আছে তা দেখতেই এগিয়ে আসে আয়েশা। তাকিয়ে দেখে পানি ভর্তি বালতির মধ্যে এক বোতল পানি ডুবিয়ে রেখেছে আহাম্মেদ। 

জিজ্ঞেস করলে আহাম্মেদ বললো, 'আমি ফ্রিজ বানিয়েছি মা। এই ফ্রিজে শুধু পানি ঠান্ডা করা যায়। এভাবে ঠান্ডা পানির মধ্যে বোতল ডুবিয়ে রাখলে বোতলের পানি ঠান্ডা হয়ে থাকবে।'

আয়েশা হেসে উঠে বললো, 'পাগল ছেলে আমার।'

ঈদ চলে আসতেই বিভিন্ন কোম্পানির ফ্রিজে নগদ মূল্যছাড় দেওয়া শুরু করলো সঙ্গে বিভিন্ন অফার। আয়েশার জমানো টাকা এবং তার স্বামীর দেওয়া টাকা দিয়ে এই মূল্যছাড়ের সুযোগটা লুফে নিলো সে।

বাসায় ফ্রিজ আসতেই আহাম্মদের খুশি ধরে না। ঈদের খুশিটা যেন আরও বেড়ে গেলো  ফ্রিজের কারণে।

'মা এখন থেকে শুধু ঠান্ডা পানি খাব।' 

আহাম্মেদের কথায় হেসে ওঠে আয়েশা, 'এতো ঠান্ডা পানি খেলে তো সর্দি জ্বর লেগে থাকবে!'

আহাম্মেদ মুচকি হেসে বললো, 'তাহলে কম কম খাব। আর মাঝে মধ্যে আইসক্রিম বানিয়ে খাব। ঠিক আছে মা?'

আয়েশা মাথা ঝুঁকে বলে, 'হ্যাঁ।'

কিছুদিন বাদেই হালিমা বেগমের বাসার ফ্রিজটা হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেলো। সার্ভিসিং সেন্টারে দিয়ে আসলে জানতে পারে সারাতে বেশকিছু টাকা লাগবে। হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকার কারণে সার্ভিসিং সেন্টার থেকে ফ্রিজটা বাসায় আনতেও পারছে না৷ এবার ভীষণ বিপাকে পড়ে গেলো হালিমা বেগম। 

খবর জানতে পেরে আয়েশা হাজির হয় হালিমা বেগমের বাসায়। কাঁচুমাচু করে আয়েশা বলে, 'একটা কথা বলব ভাবী?'

হালিমা বেগম মুখে হাসি নিয়ে বলে, 'হ্যাঁ, বলেন।'

'আপনাদের ফ্রিজ না আনা পর্যন্ত আপনি যদি আমাদের ফ্রিজে আপনার প্রয়োজনীয় সবকিছু রেখে আসেন আমি খুব খুশি হব।'

হালিমা বেগমের মুখের হাসিটা পানসে হয়ে যেতেই আয়েশা আবার বললো, 'আমরা তো প্রতিবেশী তাই না? একে অপরের পাশে না থাকলে কে থাকবে বলেন! আর আপনিও তো আমাদের উপকার করেছেন।'

হালিমা বেগম মলিন হাসিতেই জবাব দিলো, 'ঠিক আছে।'

তারপর থেকে হালিমা বেগম নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত ব্যবহার করে চলছে আয়েশার ফ্রিজ। আয়েশা এতে মোটেও বিরক্ত নয়। বরং প্রশান্তি পাচ্ছে, প্রয়োজনে পাশে থাকতে পেরে। 

দেড় মাস শেষে হালিমা বেগম বাসায় ফ্রিজ আনতে সক্ষম হয়। এই দেড় মাসে কখনোই আয়েশার মুখে তিনি বিরক্তির ছাপ দেখেনি। কানেও আসেনি তার অগোচরে আয়েশা নিন্দা করে তাকে নিয়ে কথা বলেছে এমন খবর । 

আয়েশার ব্যবহারে মুগ্ধ হয় হালিমা বেগম। মেয়ের সাথে এই প্রসঙ্গে কথা বলতেই মুরাদ এসে হাজির হয়। 

'দেখেছো, আহাম্মেদের মা কত ভালো। একটুও রাগ করেনি আমি তাদের ফ্রিজে কত পানি রেখেছি।' 

হালিমা বেগম হাসিমুখ করে বললো, 'আমি কী কখনো আহাম্মেদকে কিছু বলেছি রাগ করে যখন আহাম্মেদ পানি রাখতে আসতো?'

মুরাদ চট করে বলে ওঠে, 'বলেছোই তো। আমি আহাম্মেদকেও বলেছিলাম সে কথা। তুমি আপার সঙ্গে রাগ করে অনেক বকেছিলে।'

মুরাদের কথা শুনে চোখ কপালে ওঠে হালিমা বেগমের। আহাম্মেদকে বলা মানে কথাগুলো আয়েশার কানেও পৌঁছিয়েছে বুঝতে পারে সে। এবার লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো তার। মাত্র কয়েকদিনের জন্য সে উপকার করতে পারলো না, আর টানা দেড় মাস ধরে সে ফ্রিজের যাবতীয় উপকার পেয়ে এসেছে আয়েশার কাছ থেকে। আয়েশার এমন ব্যবহার তাকে আরও বেশি অনুতপ্ত এবং লজ্জিত করে ভেতরে। নিজের বিবেকের কাছেই নিজে লজ্জিত হতে থাকে বারবার৷ 

হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, খারাপ ব্যবহারের বিনিময়ে খারাপ ব্যবহার ফেরত পেলে হয়তো তার ভেতরে এতো সহজে অনুতাপ তৈরি হতো না। নিজের খারাপ ব্যবহারের জন্য ভেতরে অনুতাপ তখনই সহজে সৃষ্টি হয় যখন বিনিময়ে ওপাশ থেকে দ্বিগুণ ভালো ব্যবহার ফেরত আসে৷