দ্বিধা


 
লায়লা আমার সহপাঠী ছিল। ইউনিভার্সিটিতে  তিন বছর একসাথে অনার্স পড়েছি।  আমরা দুজন একে অপরের ভালো বন্ধুও ছিলাম। 

লায়লা আমাকে একটি চিঠি লিখেছিল। আমাদের অনার্স পরীক্ষা যেদিন শেখ হয়ে যায় সেদিন।  তিন বছরে কত ক্ষণ ছিল, কত মুহূর্ত ছিল, কত আনন্দময় সময় ছিল,  কত আকাঙ্খা করতাম কোনো নিবেদন পাওয়ার -- তখন সে কিছু  লেখেনি। ইউনিভার্সিটি  যেদিন বন্ধ হয়ে গেল, যেদিন থেকে আর কোনো দিন ক্লাস হবে না, সেদিন সে আমাকে চিঠি লিখেছে। তাও বিদায় বেলায় যাবার সময়।    
    
চিঠিটি দেওয়ার সময় লায়লা শর্তও দিয়েছিল একটা -- 'আমি যখন চলে যাব। স্টেশন থেকে ট্রেনখানি যখন ছেড়ে চলে যাবে অনেক দূর,  তখন  প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তুমি পড়বে আমার চিঠিখানা, এর আগে নয়। '
আমি লায়লাকে বলেছিলাম, 'ঠিক আছে, তাই পড়ব।'     

রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে ঝিকঝিক করে প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যায়। এই ট্রেনেই চলে যায় লায়লা । কী সুন্দর হাসিখুশি ভাবে চলে গেল সে।  মুখে কোনো মন খারাপ নেই।  চোখে কোনো বিষণ্ণতাও নেই। জানালার কাছে বসে ছিল সে। তাই দেখতেও পেলাম ওর যাবার বেলাকার দু চোখ। ট্রেন আড়াল হয়ে  যতদূর পর্যন্ত  মিলিয়ে গেল, ততদূর পর্যন্ত ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলাম ।      

পথে যেতে যেতে ওর চোখ থেকে একটুও কী কান্না ঝরে পড়েনি আমার জন্য?  ও কী পাষাণী? নাকি আমি পাষাণ?  কারোর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও ঝরে পড়ল না!  তবে কী মিছে ছিল সব তিন বছরের মায়া মমতা ! 
                      
লায়লা চলে যাবার পর প্লাটফর্মেের কোলাহল মুহূর্তেই যেন মুখরহীন হয়ে গেল। কতক্ষণ এমনি দাঁড়িয়ে থাকলাম একাকী ।  তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে একটি খালি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর যেয়ে  বসি।  ফ্লাস্কে করে এক চা বিক্রেতা ছেরা বলছিল -- স্যার চা খাইবেন? 
বললাম -- দে। 
--- লাল চা কিন্তু! 
--- তাই দে।
--- সিগারেট দিব?
--- দে। 
--- কোনটা খান?
--- ছাত্তার।
--- ছাত্তার কী স্যার! 
--- স্টার দে। স্টারকে ছাত্তার কই।          

চা খেয়ে স্টার টানতে থাকি। একটু জোরে জোরেই টানলাম।  মাথা ধরে গেল বেশ !  মাথা ধরা নিয়েই  লায়লার চিঠিখানি বের করে পড়তে থাকি ---

রঞ্জন, 

আমি চলে যাচ্ছি। আবার কবে আসব জানি না।  মাস্টার্স করা হয়ত আর হবে না।  আবার হতেও পারে। যদি তুমি চাও। 
আমার বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে আছে।  আমি গেলেই আমার মতামত নিয়ে হয়ত কথা পাকাপাকি করে ফেলবে।  
                      
তুমি এমন কেন বলো তো?  ছেলে মানুষের এত দ্বিধা থাকে?  তিন বছরে কতগুলো দিন ছিল, সে কী তুমি গুণেছিলে কখনও?  কত কথা বলেছি তোমার সাথে, কত ক্ষণ তোমার পাশে বসেছি, কত কিছু দিতে নিতে কত যে আঙুলের ছোঁয়া লেগেছে দুজনের ! কার শরীরের কেমন গন্ধ,  তাও জানা হয়ে গেছে।  চেহারার রূপ, অপরূপ, অরূপ -- সবই দেখা হয়ে গেছে ! 

আমাকে কী তোমার ভালো লাগেনি? দ্বিধাটা  ছিল তোমার কোথায়? কেন তুমি গত তিন বছরেও বলতে পারোনি -- ' লায়লা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি চাই।  তোমাকে ছাড়া বাকী জীবন আমার  চলতে চাইবে না। '            
  
না কী,  তুমি চেয়েছিলে আমি তোমাকে আগে বলি!  তাই না?  

কী আশ্চর্য!  আমারও বলতে বলতে তিনবছর লেগে গেল।  যখন এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ঠিক তখন। হঠাৎ করেই কেমন জানি লাগছে!  মনে হচ্ছে -- তুমি ছাড়া আমি খুব একা!  তোমাকে ছাড়া আমার বাকী জীবন অর্থহীন।               

এই শহরে কোথায় আমরা যাইনি বলো?  পথে 
পথে কত হেঁটেছি , কত বৃক্ষের সবুজে, ইউক্যালিপটাসের কত ছায়াতলে!  কত সময় পার করেছি অহেতুক কোনো কথা না বলে। শুধু আসল কথাটাই তোমাকে বলা হয়নি -- 'আমি তোমাকে ভালোবাসি রঞ্জন।'       

হ্যাঁ -- রঞ্জন, আমি তোমাকে ভালোবাসি।  এই চিঠির অপর পৃষ্ঠায় আমার ঠিকানা লেখা আছে।  তুমি আমাকে দ্রুত পত্র লিখে তোমার মতামত জানাবে।  আমি তোমার পত্রের জন্য অপেক্ষা করব।  ভালো থেকো। 

-----  লায়লা।                

আমি চিঠিখানা পড়ে কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখি।  ঐ চা-ওয়ালা ছেরাকে আবার ডাকি।  ওকে বলি -- চা দে এক কাপ!  
ছেরা চা দেয়। এবং বলে -- ছাত্তার দিব?
-- না,  আবদুল লতিফ দে। 
-- স্যার আবদুল লতিফ কী? 
-- চিনোস না!  গোল্ড লীফ!  গোল্ড লীফ দে।                    
চা ওয়ালা ছেরাকে বলি -- তোর নাম কী?  ও বলে, এমডি আবুল কাসেম। 
আমি এমডি আবুল কাসেমকে বলি -- তুই আমাকে আরও দুই রাউন্ড চা সিগারেট খাওয়াবি।  তারপর,  বিল নিয়ে চলে যাবি।  কাসেম মাথা নেড়ে বলে -- আচ্ছা।                    
                                 

প্লাটফর্ম থেকে যখন চলে আসব তখন কংক্রিটের বেঞ্চের উপর রাখা চিঠিখানি খুঁজি।  দেখি চিঠিটি নেই। ফাল্গুণের দমকা বাতাসে কখন চিঠিটি উড়ে যেয়ে প্লাটফর্মের নীচে রেললাইনের উপর পড়ে গেছে দেখতে পাইনি।  ট্রেনের ঘূর্ণোন চাকায় সে চিঠি ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ছিন্ন চিঠি কুড়িয়ে চিঠির পিছনে লেখা লায়লার ঠিকানাটা যে উদ্ধার করব,  তা আর ইচ্ছে হলো না !         

প্লাটফরমের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, কী করব এই জীবনে?  বিয়ে করে খাওয়াব কী?  সেই একই দ্বিধা! একই অনীহা!  চাল চুলোহীনদের বিয়ে করার সাধ হওয়া ঠিক না।  ওর বিয়ে হয়ে যাক।  ভালো থাক্ আমার আজীবন চির- সখা লায়লা। এর চেয়ে  বেশি কিছু চাই না !         

পাঁচ বছর পর...... 

একটা সরকারি কাজে চাঁপাই নবাবগঞ্জ  গিয়েছিলাম।  ওখানে কাজ সেরে একটি লোকাল বাসে করে  ফিরছিলাম রাজশাহীতে। পথিমধ্যে গোদাগাড়ী থেকে একটি মেয়ে ওঠে।  আমি দেখে তাকে চিনতে পাই,  এ যে লায়লা।  

সিট ছিল না!  ওকে  বসতে দেই।  আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বলে --  তুমি, এখানে! 

টুকটাক অনেক কথাই হল ওর সাথে।  রাজশাহীতে এসে দুজনই নামি।  লায়লা বলছিল -- চলো আমার স্বামীর বাসায়।  
--- আমি বললাম, না -- আজ না। আজই আমাকে ঢাকা চলে যেতে হবে।  
---   আচ্ছা।  
--- চলো তোমাকে এমনি একটু এগিয়ে দিয়ে আসি! 
--- এসো।  

হাঁটতে হাঁটতে লায়লা আমাকে বলছিল -- বিয়ে করেছ? 
-- না। 
-- কেন করো নাই? 

হঠাৎ ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।  লায়লা বলছিল --  তুমি একটা রিকশা নিয়ে বাস স্টান্ডে চলে যাও। ঠান্ডা লাগবে।  তোমার তো একটুতেই ঠান্ডা লাগে।        
আমি বললাম -- আচ্ছা। 
লায়লা ছাতা মাথায় দিয়ে  হেঁটে হেঁটে  চলে গেল।  

অনেক দূর পর্যন্ত যেয়ে লায়লা একবার পিছনে ফিরে তাকায়।  ও দেখতে পায় -- তখনও রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থেকে আমি ওর চলে যাবার পথের  দিকে তাকিয়ে আছি, তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজছি।   
                 

Post a Comment

0 Comments