অবেলা বকুল

পাত্রপক্ষের সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে আমাকে আর পাত্রকে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হল।তখন পাত্রের আমাকে জিজ্ঞেস করা প্রথম প্রশ্নটা ছিল;
- শুনেছি, কিছুদিন আগে নাকি অন্য এক জায়গায় আপনার বিয়ের কথাবার্তা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলো?
আমি বিব্রতবোধ করলাম না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানালাম,
- জ্বী ঠিকই শুনেছেন। ওখানে শুধু বিয়ের ডেইট ফাইনাল হওয়া বাকি ছিল।
ভদ্রলোক ঠোঁটের ভাঁজে ভদ্রতাসূচক হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন;
- তো হল না কেন?
- তারা এলাকায় এসে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ভালো কোনো রিপোর্ট পায়নি।
- ঠিক বুঝলাম না।
আমি একবার চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার ভদ্রলোকের দিকে মুখ তুলে তাকালাম।
- মানে তারা শুনে গিয়েছে, কিছুদিন আগে একটা ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেছে আর অন্য আরেকজনের সাথে বিয়েও ভেঙে গেছে।
লোকটার চোখেমুখে তীব্র কৌতুহল ভেসে উঠেছে;
- এগুলো কি সত্যি?
- আমি যদি এখন বলি যে, "এগুলো সব মিথ্যে"। আপনি বিশ্বাস করবেন?
- কেন করবো না! মানুষের জীবনে অতীত থাকতেই পারে।
- কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমার জীবনে এমন কোনো অতীত নেই।
- তাহলে কথাগুলো আসলো কি করে?
- তা জানি না। জানার চেষ্টাও করছি না আপাতত৷
- আপনার ফ্যামিলি কোনো স্টেপ নেয়নি?
- কি স্টেপ নিবে?
- এতগুলো মিথ্যে অপবাদ দিয়ে দিল আপনার নামে, আপনারা লোকগুলোকে খুঁজে বের করবেন না?
- বাবা চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেন নি৷ আর যারা এসব শুনে গিয়েছে, তারাও বলতে রাজি না যে কার বা কাদের কাছ থেকে কথাগুলো জেনেছে।
ভদ্রলোক কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তিত মুখ করে বললেন,
- ব্যাপারটা ঠিক হয়নি একদমই।
- আপনার কি আর কিছু জানার আছে?
- না, তেমন কিছু না। আপনি কিন্তু আমাকে আপনার বন্ধু মনে করতে পারেন। বন্ধু ভেবে মনের গোপন কথাও শেয়ার করতে পারেন নিঃসন্দেহে।
আমি বুঝতে পারছিলাম না তার কথার মানেটা। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
- কিরকম গোপন কথা?
- মানে আপনার যদি কোনো পছন্দ থেকে থাকে বা আপনি যদি অন্য কোথাও কমিটেড হয়ে থাকেন...
- সেরকম কোনো ব্যাপার নেই। থাকলে আপনার আগে আমি আমার ফ্যামিলিকে জানাতাম।
- ও। ঠিক আছে তাহলে।
বাই দ্যা ওয়ে, আপনার ঠোঁটের উপরের তিলটা মারাত্মক!

পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর মা আমার কাছে আসলেন। আমি ব্যস্ত ছিলাম শাড়ির কুঁচির সেফটিপিন খোলা নিয়ে।
- মেঘা, ছেলের সাথে তোর কি কি কথা হল?
বিরক্তি নিয়ে বললাম,
- পরেরবার থেকে আমাকে আর শাড়ি পরিয়ো না তো মা। ঝামেলা লাগে।
- আহ্, আমি যা প্রশ্ন করছি তার উত্তর দে না। পছন্দ হয়েছে?
- আমার পছন্দের কথা জিজ্ঞেস করছো?
মা আড়চোখে কঠিন দৃষ্টি নিয়ে  আমার দিকে একবার তাকালেন। আমি বললাম,
- আমার পছন্দ হয়েছে কিনা এ কথা আমি তোমাকে বলবো না মা, বাবাকে গিয়ে বলবো।
- কেন? আমাকে বললে সমস্যা কি? আমি কি তোর কেউ না?
- এসব বলে তুমি আমাকে কনভিন্স করতে পারবে না। এর আগেও আমি যতবার তোমার কাছে আমার পছন্দের কথা জানিয়েছি, ততোবার অপমানিত হয়েছি। অথচ বাবার কাছে গিয়ে বললে কি সুন্দর করে আমার প্রত্যেকটা যুক্তি মনোযোগ দিয়ে শোনেন, মূল্যায়নও করেন। আমার কোথাও ভুল হলে সহজ যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েও দেন।
মায়ের কান লাল হয়ে গেছে। তার মানে বিস্ফোরণ ঘটবে যেকোনো সময়। তবুও যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে আবেগ দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি;
- তুই আমাকে সবসময় ভুলই বুঝিস মেঘা। আমি কি কখনো তোর খারাপ চাইবো বল্? আমি যে মা, আমার কষ্ট আর দুশ্চিন্তাগুলো তুই কি করে বুঝবি!
- কানের দুলটা একটু খুলে দিবে? পারছি না আমি।
বিস্ফোরণটা এবার ঘটলো;
- বাবার কাছে যা। কাজের সময় মা আর কাজ ফুরালেই বাবা? এ সংসারে আমার কোনো মূল্য আছে নাকি!
মা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু এমন সময় বাবা চলে আসলেন;
- শুনো, ঘটক সাহেব ফোন করেছিলো। ওরা "না" করে দিয়েছে।
সাথে সাথে মা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকালেন;
- তুই কি ছেলেকে সব বলে দিয়েছিস? এলাকায় তোকে নিয়ে কিসব কানাঘুঁষা চলছে।
আমি সহজভাবে উত্তর দিয়ে দিলাম,
- হ্যাঁ। যা যা জানতে চেয়েছে সব জানিয়ে দিয়েছি।
মা তড়িৎ গতিতে আমার সামনে থেকে চলে গেলেন৷ আর বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুচকি হাসলেন৷

পরের বেশ কিছুদিন আমার জন্য আর কোনো প্রস্তাব এলো না। দিন যত যাচ্ছিলো, বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা ততো বাড়ছিলো। ২৬ বছর বয়সের অবিবাহিত মেয়ে ঘরে থাকা মানে বাবা মায়ের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়া। আমার বাড়িতেও এর ব্যতিক্রম ঘটলো না। মা কিছুদিন পরপর এসে আমার কাছে জানতে চায়, "আমার কোনো পছন্দ আছে কিনা"। বাবা অবশ্য কিছু বলেন না। তার দুশ্চিন্তাগুলোও আমাকে বুঝতে দিতে চান না। ফুরফুরে মেজাজে থাকার চেষ্টা করেন সবসময়। কিন্তু তার লুকানো কষ্টগুলো আমার দৃষ্টি এড়ায় না। এরমধ্যে মনস্থির করে ফেললাম, নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অব্দি বিয়ে-শাদি'র নাম নিব না আর।  বাবা-মাকেও এ সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিলাম। মা প্রথমে বেশ আপত্তি জানালেও বাবা আমার বিরোধিতা করলেন না। দিনরাত এক করে জবের প্রিপারেশনে লেগে গেলাম। আগে থেকেই প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম যদিও, কিন্তু এবার কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম।

ছয় মাসের মধ্যে ভালো একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে যুতসই স্যালারির একটা জব হয়ে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। তারপর একমাস যেতে না যেতেই দেখলাম, বেশ কিছু জায়গা থেকে ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। সেখানে আমার বয়সটাও কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না! আমার বাবার ব্যাংক ব্যালেন্স বা বাড়ি গাড়ি নেই জেনেও তাদের কারো কপালে ভাঁজ পড়ছে না! অথচ কয়েকমাস আগেও এ ব্যাপারগুলো প্রত্যেক পাত্রপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো৷ ও হ্যাঁ, ওই পাত্রপক্ষ আমার এলাকায় এসে যার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে গিয়েছিলো, তিনি আমার বাবার নাম গুলিয়ে ফেলেছিলেন। এই এলাকায় একই নামের দুজন মানুষ রয়েছেন। ভদ্রলোক ভুল করে ওই লোকের মেয়ের চারিত্রিক বৃত্তান্ত আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই পাত্রপক্ষও শুধুমাত্র একজনের মন্তব্যের উপর নির্ভর করে পিছু হটে গিয়েছিলো।

এদিকে মা তো মহাখুশি এত এত প্রস্তাব আসছে দেখে৷ বাবাও আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছেন না। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হল আমাকে নিয়ে। আমি কোনোভাবেই বিয়েতে আগ্রহ আনতে পারছি না। বিয়ের মত পবিত্র একটা কাজকে খুব অহেতুক অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে কেন জানি। কি দরকার! ভালোই তো আছি। নিজ যোগ্যতায় রোজগার করছি, মানসিক তৃপ্তি নিয়ে বাবা-মায়ের চাহিদা মেটাচ্ছি, নিজের ইচ্ছেয় চলতে পারছি। আমার রাজ্যে আমিই রাজা, আমিই রানী। বাহ্, এরচেয়ে সুখকর জীবন আর কি হতে পারে? বিয়ের পর এ জীবনটার নিশ্চয়তা নাও থাকতে পারে। অন্যের অধীনে চলতে হতে পারে৷ এমনও হতে পারে, মাসশেষে আমি আমার স্যালারির একটা অংশ আমার বাবা-মা'কে দেয়ার অনুমতি পাচ্ছি না বা পেলেও এর জন্য অনেক কথা শুনতে হচ্ছে। আগ বাড়িয়ে এ ধরনের অনিশ্চয়তা বয়ে আনার কোনো মানেই হয় না।

তবুও বাবা-মায়ের অনেক জোরাজুরির পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও  আবারও পাত্রপক্ষের সামনে বসতে চলেছি। পাত্রের সাথে আমাকে আলাদা করে কথা বলতে বলা হয়েছে৷ আমি একনজরে ভদ্রলোককে একবার দেখে নিলাম। এককথায় সুদর্শন পুরুষ বলা যায়। নীরবতা ভেঙে আমিই প্রথম প্রশ্ন করলাম,
- আমার চাকরী নিয়ে আপনার কোনো আপত্তি আছে?
- না, না। আপত্তি থাকবে কেন!
- অনেকেই আপত্তি জানায়। শর্ত জুড়ে দেয় প্রথমেই, বিয়ের পর নাকি চাকরী ছেড়ে দিতে হবে৷
ভদ্রলোক মুচকি হাসলেন;
- আমার কোনো শর্ত নেই।
- আচ্ছা। আপনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না আমাকে?
- আমার নাম পলাশ। ব্যাংক সেক্টরে আছি।
- এগুলো তো জানিই।
- তাহলে তো হয়েই গেল। আমি নাহয় আপনাকে ধীরেধীরে জেনে নিব৷

পলাশের ব্যাপারে মা আমার মতামত জানতে এলে আমি "না" করে দিলাম। কারণ দেখালাম- মানুষটা আমার জব নিয়ে আপত্তি জানায়নি। তার মানে বিয়ের পর আমার স্যালারির উপর তার সজাগ দৃষ্টি থাকবে। যেটা আমার পছন্দ হবে না। আর ছেলে দেখতেও তো সুন্দর। আমি সে তুলনায় আহামরি কিছু না। ভবিষ্যতে হীনমন্যতায় ভুগতে আমি রাজি নই। বাবা আমাকে বুঝিয়েছেন অনেকবার কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসিনি। নিজের অজান্তেই আমার মধ্যে একধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলে এসেছিলো৷ তার সাথে যোগ হয়েছিল জেদ আর কিছু অদেখা ক্ষত। এক বছর আগে ছেলেপক্ষরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করে দিত৷ আর আজ আমি ছেলেপক্ষদের প্রত্যাখ্যান করে দিচ্ছি। আনন্দ পেতাম, মনে হত নিজের সাথে ন্যায় বিচার করতে পারছি। যার ফলস্বরূপ এভাবে একের পর এক সম্বন্ধ আমি ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম৷ বাবা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করেননি কখনো৷ এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। তবে প্রায়ই তিনি আক্ষেপ করতেন কিন্তু আমি তেমন গুরুত্ব দিতাম না। যখন ইচ্ছে করছে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে চলে যাচ্ছি, ঘুরছি, ফিরছি, আনন্দ করছি। জীবনে আর কি লাগে! মুক্ত আকাশে উড়ার স্বাধীনতা ছেড়ে খাঁচায় বন্দি হতে কে চায়!

মুক্ত আকাশে উড়তে উড়তে সতেরোটা বছর যেন চোখের পলকে কেটে গেল। বাবা মারা গেছেন পাঁচ বছর হতে চলেছে৷ মা'ও আজকাল খুব একটা সুস্থ থাকছেন না। ইদানীং নিদারুণ এক একাকীত্ব ঘিরে ধরেছে আমাকে। চারপাশটা কেমন খালি খালি লাগে। শূন্যতা কাজ করে ভীষণ৷ বন্ধুরা সবাই যে যার সংসারজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এখন টের পাই, দিনশেষে একটা মানুষ লাগে যার কাঁধে মাথা রেখে একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়া যাবে। কোনো কোনো সময় তো মনে হয়, কষ্টের ভাগীদার তো দূরের কথা, আমার সুখের ভাগীদার হওয়ার মতোও কেউ নেই আমার জীবনে। গরম চায়ের কাপে একাকী গল্প আর জমানো যাচ্ছে না, আজকাল রাস্তা পার হতে গেলেও একটা যত্নশীল হাতের অভাব অনুভব করছি খুব করে, রাতেও ভালো ঘুম হয় না।

গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ পলাশ সাহেবের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে প্রথমে চিনতে না পারলেও তিনি আমাকে ঠিকই চিনে নিলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ কথাও বললাম। প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারলাম, তার স্ত্রী বিয়ের আগে চাকরী করলেও বিয়ের পর স্বেচ্ছায়  চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। পলাশ সাহেবের তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। এখন তাদের তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের দাম্পত্যজীবন চলছে। বিদায়বেলায় পলাশ সাহেব যখন তার ওয়ালেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করছিলেন আমাকে দেয়ার জন্য, তখন ওয়ালেটে থাকা তার বউয়ের ছবিটায় আমার চোখ পড়ে গেল।  নিজের অজান্তেই মনে মনে বলে উঠলাম, "আচ্ছা এই ভদ্রমহিলা কি পলাশ সাহেবের পাশে দাঁড়াতে গেলে কখনো হীনমন্যতায় ভুগে?" নিশ্চয়ই না, পলাশ সাহেব সে সুযোগই দেন না হয়তো।

পলাশ সাহেব চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পরপরই নিজের গন্তব্যের পথে হাঁটা শুরু করলাম। চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে ভেতর থেকে অনুভব করলাম- আজ নিজের একটা সংসার থাকলে মন্দ হত না।

Post a Comment

0 Comments