এক মেয়েকে একই সাথে দুই বন্ধু যখন পছন্দ করে বসে, ব্যাপারটা যে কতটা বিব্রতকর- নিজে এই ফাঁদে না পড়লে বুঝতাম না।। উপমাকে আমার অনার্স ফাস্ট ইয়ার থেকেই ভালো লাগে- কিছুদিন পর আবিস্কার করলাম আমার বন্ধু আতিকেরও নাকি উপমাকে ভালো লাগে।। মজার ব্যাপার একটাই, আতিক জানে না যে, আমি উপমাকে মনে মনে পছন্দ করি।। আমি ভাবলাম, আতিকের আগে দান মারতে হবে।। আতিক বেশ বোকা বোকা ছেলে, কিন্তু- আমাদের ল' ডিপার্টমেন্টের সেরা ছাত্র সে।। আমি তো মাঝে মাঝেই বলি, তুই তো ডিন'স এওয়ার্ড পাবি নিশ্চিত।। আমি রায়হান, একটু চঞ্চল- গান বাজনা গিটার ঘোরাঘুরি আর একটু পড়াশোনা এইতো জীবন।। উপমা ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে।। ওর চোখ- বিড়াল চোখ।। আমি শুরুতে ওর চোখের প্রেমেই পড়েছিলাম।। এরপর, সবকিছুর প্রেমেই পড়ে যাই- কিন্তু কখনো উপমাকে বুঝতে দেই নি।। সেম ডিপার্টমেন্ট এর মেয়েরা প্রেমে সায় দিবে, যখন ওরা সেকেন্ড ইয়ার বা থার্ড ইয়ারে উঠবে।। এখন কেবল চান্স পাইছে তো- নিজেদের রাজকন্যা ভেবে বসে আছে এরা।। আমি খুব সতর্ক, নিজেকে বরাবরি চালাক মনে করি- বিশেষ করে আমি যে আতিকের থেকে চালাক এতে কোন সন্দেহ নেই।।
......
এভাবেই, জানা অজানার মধ্যে আমাদের প্রথম বর্ষ শেষ হয়ে যায়।। প্রত্যাশামত আতিকের সিজিপিএ ক্লাসের সবার উপরে।। আমারো খারাপ না, তবে আতিক পড়াশোনায় কখনোই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী না।। আমার যুদ্ধ হলো উপমাকে নিয়ে।।
আতিকের সাথে উপমার বেশি সখ্যতা।। মেয়েটা আতিকের কাছে নোট ফোট হাবি জাবি সুবিধা নেওয়ার জন্যে, সারাদিন আতিক আতিক করে।। আমার তো গা জ্বলে যায়।। আতিক মাঝে মাঝে আমাকে এসব শেয়ার করে, ও উপমাকে কত ভালোবাসে।। উপমা ওর কাছে এলে ওর নাকি অন্যরকম ভয়, অস্থিরতা, ভালোলাগা এসব কাজ করে।। আমার শুনে কান গরম হয়ে যায়, গলা চেপে ধরতে মন চায় আতিকের।। মনে মনে ভাবি, এভাবে আর হবে না।। কবে দেখবো আতিক আর উপমার প্রেম হয়ে গেছে।। আমাকে দ্রুত কিছু করতেই হবে।। ওদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিয়ে, উপমাকে আমার ভালোলাগার কথা জানাতে হবে।। পরে কি হয় দেখা যাক।।
........
কোন মোক্ষম সুযোগ পাচ্ছি না, কোন বুদ্ধি কাজ করছে না।। আতিক এত ক্লিন ইমেজের ছেলে যে, ওকে খারাপ বানানো বিশাল চ্যালেঞ্জ।।। এদিকে আতিক যেহেতু আমার উপমার দুইজনেরই বন্ধু, আতিক সহজেই নিজেকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাবে উপমার কাছে।। আতিকের ভালো পড়াশোনার কারণে উপমার সংগ বেশি পায়।। আমার পড়াশোনায় এত ধাত নাই, আতিককে টেক্কা দেবার কথা কল্পনায়ও ভাবতে পারি না।।
আতিক বাসায় থাকে, আমি পলিটিক্যালি হলে সিট পাইছি।। একদিন আতিককে বললাম, আমার সাথে হলে রাত কাটা।। ক্যাম্পাস জীবনে হলে রাত না কাটালে আফসোস থাকবে, আতিক রাজী হলো।। আমিও ভাবলাম যা করার আজ রাতের মধ্যেই করতে হবে।।
......
আতিকের কিছু বিব্রতকর ভিডিও মজার ছলে উপমাকে দেখাচ্ছি।। আতিক মাতাল হয়ে আমার রুমে পাগলের মত কাজকারবার করছিলো ভিডিওতে।। উপমা দেখে ছি ছি করছে।।
আমি উপমাকে বললাম, দোস্ত আমি মাঝে মাঝে ড্রিংস করি, সত্য কথা, তোকে আগেও বলেছি।। কিন্তু দেখ আতিককে আমরা সবাই কত ভালো জানতাম।। আলা ভোলা সেজে থাকতো সে, আর ভিতরে ভিতরে সেও মদ খায়, নেশা করে।। উপমাকে আতিকের ব্যাপারে সু্ক্ষ্ণ ধাক্কা দিলাম, বেশ কাজ হলো।। আতিকের ভালো মানুষির এডভান্টেজ নস্ট করে দিয়ে, এখন আমার লেভেলে নামিয়ে এনেছি।। এবার আমার লেভেল থেকে ওকে নামালেই- কেল্লা ফতে।।
আতিক কিছুটা অভিমান করেছে, এই ভিডিও উপমাকে দেখানের জন্যে।। আমি বুঝালাম আতিককে, উপমা একটু দুস্ট চঞ্চল ছেলে পছন্দ করে, ব্যাটা।। তুই তো বুঝিস না ছাগল।। আমি এই জন্যেই এটা ওকে দেখাইছি, ও কিন্তু সেই মজা পাইছে।। আতিক খুশি হলো।।
আতিককে বললাম এক কাজ কর, তুই ফাস্ট ইয়ারের জুনিয়র কোন মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব টাইপ কিছু কর, এতে উপমা জেলাস হবে।। উলটা তোকেই ভালোবাসি বলে দিতে পারে।। বোকা ছেলেটা, লাজুক ছেলেটা- আমার কথা শুনে শুনে আরো একটা ভুল পদক্ষেপ নিলো।। আমি শুধু দেখে গেলাম, কিভাবে ধীরে ধীরে খেলা আমার নিয়ন্ত্রনে চলে আসছে।।
আর, একটা দান মারতে পারলে- আতিক শেষ।।
মিডটার্মের পরীক্ষা চলাকালীন, রেজা স্যার আচমকা আতিককে দাঁড়াতে বললো।। তার বডি চেক করে, মানিব্যাগের মধ্যে নকলের কাগজ পেলো।। পরীক্ষা থেকে আতিক সাময়িক বহিস্কার।।
ব্যাস- উপমার রুচিই চলে গেলো আতিকের সাথে কথা বলার।।
পুরোটা যে আমার প্লান তা বলে দিতে হবে না।। মানিব্যাগে নকল আমিই রেখেছি।। রেজা স্যারকে আমি ফেক আইডি থেকে গত রাতে ম্যাসেজ দিয়েছি- স্যার আমি আপনার ডিপার্টমেন্টের একজন ছাত্রী।। আমার মনে হয়, আতিক নকল করে ভালো রেজাল্ট করে।। আমি এর আগেও ওর পকেটে নকল দেখেছি।। এখন আপনাকে জানানো আমার দায়িত্ব মনে হলো, বাকিটা আপনার ইচ্ছা স্যার।।
........
উপমাকে বললাম, তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও।। আজ তো আমার সেই ঐতিহাসিক মূহূর্ত।। উপমা হাসে আর বলে অবাক লাগে রায়হান- এমন অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটবে ভাবাই যায় না।। আমি উপমাকে বাসার দরজা লাগিয়ে দিতে বলে, গাড়ি নিয়ে দ্রুত জজকোর্টে চলে যাই।। উপমা লক্ষী বউয়ের মত আমার যাবার রাস্তায় তাকিয়ে থাকে, আমি জানি।
আমি এই শহরের নামকরা উকিল।। ১৫ বছর হলো, এখন পর্যন্ত কোন মামলা হারিনি।। আমার বুদ্ধির জোরে আমি কত খুনিকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।। কত নিরাপরাধকে জেলে ঢুকিয়েছি।। আমার নাম বাংলাদেশের বার সমিতির অনেকের কাছেই আতংক।।
কিন্তু, আজ ঘটনা ভিন্ন।। আমি বেশ চিন্তিত।। একটা মামলা বোধহয় হারতে যাচ্ছি, আমার দীর্ঘ দিনের ক্যারিয়ারে দাগ পড়তে যাচ্ছে।। এটা মেনে নিতে খুব কস্ট হচ্ছে।। আমি মামলার আসামী পক্ষের উকিল, আসামী আমার কাছে মানুষ।। বড় ব্যবসায়ী, উনাকে বাঁচাতে পারলে মোটা অংকের টাকা পাবো আমি।। কিন্তু, উনি যে খুন করেছে এটা সত্য, আমি জানি।। পূর্বে বহুবার অনেক খুনিকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।। কিন্তু, এইবার এই মামলায় মনে হয় না আমার শেষ রক্ষা হবে।।
আজ মামলার রায় হতে পারে, আমি এমন কোন সাক্ষ্য প্রমাণ বা কিছুই করতে পারি নি- যাতে আমার কাছের লোকটাকে বাঁচানো যাবে।। আমার বিপক্ষের উকিল, আমার এক সময়ের বন্ধু।। কিন্তু, এখন আমরা ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী।। আমি হয়তো আজ হেরে যাবো, জীবনে প্রথম কোন মামলা হারবো, ভাবতে গেলেই বুকের মধ্যে জমাট কস্ট মোচর দেয়।।
......
জজ সাহেব রায় লিখবেন লিখবেন ভাব।। এমন সময় আমি বললাম, ইউর অনার- আমি একটা কথা জানাই, যে ব্যক্তির খুন নিয়ে এই মামলা।। সে খুন হয় নি, সে বেঁচে আছে।। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হেঁটে এই আদালতে প্রবেশ করবে।।
(আইনের একটা ফাঁক হলো, কেউ যদি কোন ঘটনা নিয়ে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে পারে।। জজকে বুঝাতে পারে ঘটনাটা সন্দেহজনক বা এতে সন্দেহের অবকাশ আছে।। তবে আসামী খালাস, রায় স্থগিত কিংবা শাস্তি কমের মত ঘটনা ঘটতে পারে।।)
আদালতের সবাই দরজার দিকে ঘুরে তাকালো।। এমনকি জজ সাহেবো, দেখলাম দরজার দিকে চোখ রাখলো।। বাদী পক্ষের উকিলো চোখ রাখলো।।
আমি সাথে সাথে বললাম, ইউর অনার- আপনিই বলুন- আপনারা যদি পূর্ণ বিশ্বাস করেন লোকটা মৃত, তবে বাদী পক্ষের উকিল, আপনি, এখানের সবাই কি জন্যে ঘুরে দরজার দিকে তাকালো?? তার মানে আপনাদের মনে এখনো এই খুন নিয়ে সন্দেহ আছে?? আপনিই বলুন, সন্দেহ নিয়ে কি, রায় দিবেন আপনি?
আদালতের সবাই জমে গেছে। জজ সাহেবকেও বিচলিত মনে হলো।।। আমার আসামী তো মুচকি মুচকি হাসছে।। আমি গায়ের এপ্রোনকোট ঝাঁকি দিয়ে, বুক ভরে দম নিলাম।। আবারো কোন জয়ের স্বাদ পেতে যাচ্ছি।।
কিন্তু, আমাকে অবাক করে দিয়ে, আদালতের সবাইকে অবাক করে দিয়ে- জজ সাহেব রায় পড়ে শুনালেন।।
আসামী মৃত্যুদন্ডের রায় হলো।।
আমি আদালতে হতম্বরের মত দাঁড়িয়ে আছি।। জজের ক্ষমতা আছে, যা খুশি রায় দেবার।। আমার প্রথম পরাজয়, আমি জানতাম- এমন কিছুই হবে।। এই মামলার শুরু থেকেই আমি ভয়ে ছিলাম।। বিপক্ষ উকিল একটা তিরস্কারের হাসি উপহার দিলো, হজম হচ্ছিলো না।।
......
আতিকের বাসায় গেলাম।। আমি ড্রয়িং রুমে বসা।। ওকে দেখে সালাম দিলাম, তারপর বললাম- কেমন আছো?
আতিক বসতে বসতে বললো- ভালো আছি, তা বলো- কি জন্যে এত বছর পর সোজা আমার বাসায়?
আমি বললাম- স্যার, রায়ের ব্যাখ্যাটা একটু দিবেন? আসলে কৌতুহল থেকে জানতে চাইলাম।।
জজ সাহেব মুচকি হাসলেন, বিদ্রুপের হাসি।। বললেন- কোন ব্যাখ্যা নেই।। আমাকে যখন ঠকিয়ে, বোকা বানিয়ে, ভুলভাল বুঝিয়ে- উপমাকে বিয়ে করেছো, তার ব্যাখ্যা কি?
আমি উঠে দাঁড়ালাম- প্রচন্ড অপমান নিয়ে চলে যাচ্ছি।। আমি জানতাম জজ যখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আতিক, আমার এখানে খুব বেশি কিছু পাবার নেই।। জীবনে প্রথম কোন মামলার চূড়ান্ত জজ হয়েছে আতিক, ওর শুরু হলো জয় দিয়ে- আর, আমার পরাজয়ের শুরু।।
একরাশ হতাশা নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার দিকে যাচ্ছি, জজের বাসা থেকে বের হবো।।
আতিক আমাকে ডাক দিলো- এই যে উকিল সাহেব শুনেন... আমি থেমে গিয়ে ঘুরে তাকালাম- আতিক বলে চললো- যে জীবনে একবার প্রতারণা করে, সে বার বার প্রতারণা করে।। আমি আপনার সাথে কোনদিন প্রতারণা করি নি।। আপনি ছিলেন আমার বন্ধু মানুষ।। আমি এটাও বিশ্বাস করি- এভরিথিংক ইজ ফেয়ার, লাভ এন্ড ওয়ার।।
আমি মুখ ফুটে বলতে চাইলাম, তাহলে রায় ওমন দিলেন কেনো?
আতিক আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে চললো-
আদালতে সবাই যখন দরজার দিকে তাকাচ্ছিলো, মৃত ব্যক্তি হেঁটে আসে কিনা দেখার জন্যে।।
একজন শুধু তাকায় নি, দরজার দিকে।।
সে হচ্ছে আপনার মক্কেল।।