সকালবেলা একটা আড়াই কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগী এনে শ্বশুড় আব্বা বললেন, বউমা মুরগীটা ছুলে একেবারে টুকরা টুকরা করে কাটবা, ঈদের দিন তোমার শাশুড়ি খিচুড়ি রান্না করবে।" শুনে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। শাশুড়ি গৃহস্থালি কাজে একেবারে সুচতুর বাঘিনী যেখানে আমি একটি ছোট্ট ইদুর মাত্র। স্বপ্ন দেখতাম কোন এক রাজপুত্র টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে এসে তুলে নিয়ে আমায় তার রাজপ্রাসাদে ঠাই দেবে। চারপাশে থাকবে দাসী বাদী আমার সেবা যত্ন করার জন্য। আর আমি রাজরানী হয়ে পায়ের উপর পা দিয়ে শুধু হুকুম জারি করব। আহ! কত মজাই না হবে। আমার সে আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়ে আমার বাস্তবের রাজপুত্র আসলো ঠিকই কিন্তু রাজপ্রাসাদ আর রাজসুখ আমার কাছে ডুমুরের ফুল হয়ে ধরা দিল। কাজের কথায় আসি। জীবনে মুরগী ছোলা তো দুরের কথা, গলা কাটা মুরগী কোনদিন ধরেও দেখিনি। আর সেই আমি কিনা মুরগী ছুলে, কেটে মাংস বানাবো। আমার সেই কাটা মাংস দিয়ে আবার খিচুড়িও হবে! ভাবনার জগতে কিছুক্ষণ বিচরণ করলাম। কাউকে বুঝতে দিলাম না যে ও কম্ম আমার নয়। বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলাম, "কোথায় মুরগী? দিন কেটে ফেলি।" শ্বশুড় আব্বার আবার মুরগীর চামড়ার প্রতি লোভ হয়েছে। তাই চামড়া ফেলা যাবেনা। নিখুঁতভাবে সেটা পরিষ্কার করে তার খাবার উপযোগী করে দিতে হবে, এমনটাই বলেছেন তিনি। বটি, চাপাতি, মুগুড় ইত্যাদি নিয়ে বসে গেলাম আমার যুদ্ধের ময়দানে যেখানে জয়ী হওয়াটা আমার জন্য অপরিহার্য। মুরগী হাতে নিতেই অপ্রত্যাশিত একটা স্মেল অনুভূত হলো যার ঘ্রাণে আমার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। অতঃপর দুই হাত মুরগীর বিষ্ঠাওয়ালা পশমের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে এলোপাথাড়ি ছিড়তে থাকলাম। আমার স্বামী মহোদয় দূর থেকে ব্যাপারখানা আচ করতে পেরে বলে উঠলেন, "আরে, এই মুরগীর চামড়া খাওয়া যায় নাকি! খুবই বাজে লাগবে খেতে। ফেলে দাও ফেলে দাও।" মুহূর্তেই অমাবস্যার অন্ধকার ঠেলে পূর্ণিমার চাঁদ উকি দিল আমার গন্ডদেশে। শাশুড়ি আম্মা দূর থেকে আড়চোখে দেখছিলেন মুগুড়ের উপর চাপাতি দিয়ে আমার মুরগী কাটার কান্ড কারখানা। যাইহোক সকাল গড়িয়ে দুপুরবেলা আমার কর্ম সমাপ্ত করে হাতমুখ ধুয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়েছি মাত্র এর মধ্যে শশুড় আব্বা আবার হাট থেকে পাঁচ ছয় কেজি টাটকা মাছ নিয়ে এসেছেন। রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছিল। ভেতরের রাগ লুকিয়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললাম, "মা, মাছগুলো আমি কাটছি, আপনি রান্না সামলান।" মাছ কাটার অভ্যাস আছে তবে চুনো পুটি টাইপের মাছ আর কি, এতো বড় বড় মাছ না। স্বামী মহোদয় এবার প্লায়ার্স নিয়ে বসে গেল আমার সাথে। তিনি মাছের কাটাগুলো কেটে দিলেন আর আমি ঘেচাঘেচ মাছগুলো কেটে ফেললাম। আমার আজকের কম্ম দিয়ে শাশুড়ির মুখে একটু হলেও হাসি ফোটাতে পেরেছি। শাশুড়ির হাড়ির মত মুখ দেখতে দেখতে আসল হাড়ির চেহারা ভুলেই গেছিলাম। কারন আমি তার মত কাজে পটু না। তবে কাজ করতে যে একেবারে পারিনা তা না, ওই আগডুম বাগডুম পারি আর কি যা দিয়ে কোনমতে দিন পার করা যায়। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে ঘর ঝাড়ু দিতে পারিনা ঠিকই কিন্তু দুপুরবেলা ঘর ঝাড়ুসহ ঘর মোছাও পারি। মেয়ে মানুষ সে যত বড় কিছুই হোক না কেন হাড়ি, পাতিল, চুলার সাথে তার সখ্যতা গড়তেই হবে। নো ওয়ে। বিয়ের পরে এই কাজগুলো জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। এড়ানোর কোন উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, ঘরের কাজে অতিরঞ্জিত কিছু করার পক্ষপাতি আমি নই। একশ টাকার হাঁড়ির তলার কালি ঘষতে ঘষতে আমি আমার মহামূল্যবান হাত খানা ও আমার দূর্লভ সময়গুলো নষ্ট করতে রাজিনা। ওই সময়টুকু আমি অন্যকাজে ব্যয় করতে পারি। যেমন, কর্মজীবী মা হলে একটু বিশ্রাম যেটা আমার একান্ত পাওনা। সারাদিন ঘরে বাইরে খেটেখুটে একেবারে নিজেকে রোবট বানিয়ে ফেলব তা তো হতে দেয়া যায়না। আর গৃহিনী মা হলে স্বামী ও সন্তানকে একটু সময় দিতে পারি। আমার বিয়ের বয়সী ছোট বোনটি এখনো মাছ ধরতেই পারেনা, এমনকি কাটা মাছও না। মাংসও না। ওর নাকি ভয় লাগে। আর তাজা মাছ ধরতে বললে মাছের সাথে ওউ লাফায়। কপালে দুঃখই আছে নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে। এমতাবস্থা হলে শশুড়বাড়ি কারাগারে পরিনত হবে। শাশুড়ির অবহেলা মানে কারাবাস আমি মনে করি। কোন দামি জিনিস উপহার দিয়েও তাকে খুশি করা যায়না যতটা যায় তাকে আরাম দিয়ে মানে তার কাজগুলো নিজে করে। সদ্য বিবাহিত মেয়েটিকে শশুড়বাড়ি গিয়ে বেশ হেনস্তায় পরতে হয় যদিনা সে বিয়ের আগে কোন কাজকর্মের ধার ধারে। এক্ষেত্রে মায়েদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উচিত ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের নিজের কাজ নিজে করা শেখানো, তারপর আস্তে আস্তে সংসারের কাজ। পাশাপাশি ছেলে সন্তানদেরও এই শিক্ষা দেয়া উচিত যাতে তারা অন্যের মেয়ের কষ্টটা একটু উপলব্ধি করতে পারে।