আমার আর অভিকের ছোট্ট সুখের সংসার। আমাদের সংসার আলো করে আছে আমার মেয়ে কবিতা। সারাদিন কবিতার এটা ওটা আবদার। সারা বাড়িটাকে অই মাতিয়ে রাখে। অভিক তো সেই সকালে অফিস যায় আর রাতে ফেরে। মেয়েকে নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া আর বাকীটা সময় বাসায় টুকিটাকি কাজেই সময় কাটে। বিকেল বেলা। মেয়েটাও ঘুমাচ্ছে। একা একা ভালো লাগছিলো না। তাই বারান্দায় এসে দাড়ালাম। এখান থেকে পুরো রাস্তাটাই দেখা যায়। হঠাৎ চোখ আটকে গেলো বাসার সামনেই একটা দেবদারু গাছ আছে। সেখানটায় আজ কয়েকদিন একটা পাগলকে দেখা যাচ্ছে। উস্কো- খুস্কো চুল। মাথার চুল গুলোয় জট বেঁধে আছে দূর থেকে দেখলেই বুঝা যায়। ইয়া লম্বা দাঁড়ি। গায়ে ময়লা কাপড় পরা। ঠিক কতদিন যে গোসল করেনি, কাপড় পাল্টায়নি কে জানে। এসব আমি কি ভাবছি? পাগলের কি এত হুশ আছে নাকি। আজ শুক্রবার। অভিকের অফিস বন্ধ। নামাজ পড়ে এসে আমাকে বললো... একজনকে ভাত খাওয়াতে হবে। পারব কিনা? আমি বললাম সে তো ভালো কথা.. কে সে? কখন আসবে? অভিক জানালো গাছের নিচের সেই পাগলটার সাথে অভিকের সখ্যতা হয়েছে তাই তাকে এসে ভাত খেতে বলেছে বাসায়। আমি শুনেই লাফিয়ে উঠলাম... এই তোমার মাথা খারাপ নাকি? এই নোংরা লোকটার সাথে তোমার বন্ধুত্ব করেছো আবার বাসায় এসে ভাত খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছো। খবরদার... সে যেন বাসার আশে পাশেও না আসে। অভিক আমার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। কিছু একটা বলতে যেয়েও যেন পারলো না। শুধু বললো... ঠিক আছে, বাসায় আসবে না। তুমি একটা প্লেটে ভাত বেড়ে দাও আমি দিয়ে আসছি। আমি একটা পুরোনো প্লেটে ভাত বেড়ে দিলাম। অভিক একটা বোতলে পানি নিয়ে আমার মেয়েকে সাথে নিয়ে পাগলটার কাছে গেলো। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি... অভিক কি যেন বলছে। আর পাগলটা এদিকেই তাকিয়ে আছে। প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে আসা যাওয়ার সময় পাগলটাকে দেখি। একই জায়গায় বসে আছে নয়ত শুয়ে আছে। আজ অনেক বৃষ্টি নেমেছে। অভিকটা ফিরতেও দেরী করছে। মেয়েটা সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রাস্তার নিয়ন আলোয় পাগলটাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সেদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। অনেক কথা আজ মনে ভীড় জমাচ্ছে। এইসব বৃষ্টির দিন গুলোতে যখন একা একা থাকি অতীতের স্মৃতিগুলো যেন আমাকে পেয়ে বসে। কলেজে পড়ার সময় আমার সিনিয়ার ছিলো নিজার। প্রথম দিন কলেজে যেতে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়াতেই দৌঁড়ে একটা ছেলে এসে হাজির স্টপেজে। একসাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যখন বাস আসলো। আমরা উঠে পড়েছি। নামার সময় দেখলাম সে আমার পেছন পেছন নামছে। পরে জানতে পারলাম আমরা এক ই কলেজে পড়ি। প্রতিদিন আসতে যেতে তার সাথে দেখা হয়েই যেতো। কলেজের ব্রিলিয়াণ্ট, সুদর্শন, স্মার্ট ছেলে হিসাবে সবাই তাকে একনামেই চিনতো। একদিন বাস থেকে নামার সময় আমার পায়ের উপর তার পা পড়ে গিয়েছিলো...সরি বলে নেমে পড়েছিলো। তার সেই চাহনিতে কি যে এক মায়া ছিলো। খুব বেশিদিন লাগেনি আমাদের বন্ধুত্ব হতে। একসাথে আসা যাওয়ার সুবাধে তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের মাঝে প্রেম জমে উঠে। আজও মনে উঠলে কি যে হাসি পায়.. প্রপোজ করার দিন তার সেই কি যে লজ্জা। আমার বান্ধবী কে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলো... সে আমাকে ভালোবাসে আমিও যদি বাসি তবে যেন... কলেজের পরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তার জন্য অপেক্ষা করি। সে নাকি ভয়ে আমাকে ফোন করতে পারছিলো না। আমি সেদিন সেখানে গিয়েছিলাম, তবে তাকে না পেয়েই ফিরে এসেছিলাম। রাগে, ক্ষোভে যখন তাকে ফোন দিলাম... সে তো ফোন রিসিভ ই করলো না বরং কেটে দিলো। তারপর বান্ধবীকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম... সে নাকি লজ্জায়, ভয়ে পালিয়েছে। কিছুটা অবাক হলাম। ছেলেদের কি এতটা লজ্জা থাকে নাকি? পরের দিন স্টপেজে দেখা হতেই চোখ নিচু করে ফিরে যাচ্ছিলো। আমিই হাতটা টেনে ধরে বলেছিলাম... ভালোবাসি বলতে এতটা ভয় পাওয়ার কি আছে? কিছু না বলে শুধু একটু হেসেছিলো। আহা... সেই হাসি এখনো প্রানে সুর তোলে। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ। নিশ্চয় অভিক এসেছে। দরজা খুলতেই দেখলাম... পাগলটাকে সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাগলের গা থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে ফ্লোরে। আমি রাগত দৃষ্টি নিয়ে অভিকের দিকে জিজ্ঞাসু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অভিক বললো... বেচারা প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজছিলো। সারারাত মনে হয় বৃষ্টি হবে তাই সাথে করে নিয়ে এলাম। আজ রাত টা আমাদের এখানেই থাকুক। অভিক তার একটা পুরোনো লুঙ্গি আর একটা গামছা এনে দিলো।আজকে রাতটা আমাদের বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখি পাগলটা নেই। অভিক বললো... বৃষ্টি থেমে গেছে তাই অনেক আগেই চলে গেছে।তাহলে কি পাগলটা আমার বিরক্তিকর চেহারাটা বুঝতে পেরেছিলো। আজও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। না আজ আর পাগলটাকে দেখলাম না। মনে করলাম... বৃষ্টিতে অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। আজও নিজারের কথা ভাবছি। আমাদের প্রেম বেশ জমে উঠেছিলো।কলেজে বেশ নাম করা জুটি হিসাবে পরিচিত ছিলাম। সুখের স্থায়িত্ব বেশিদিন থাকেনা। বাবার হার্টের অসুখটা বেড়েছে। ইদানীং একটাই টেনশন আমার তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া। এদিকে নিজারের পড়ালেখা শেষ হতে এখনো অনেকটা সময় বাকী। এ মুহুর্তে পরিবারে কিছুতেই বিয়ের কথা বলা সম্ভব নয়। আর সেই লাজুক ছেলেটার পক্ষে তো কিছুতেই সম্ভব নয়। নিজার আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। যখন তাকে বললাম বাবা আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখছে। সে কেঁদে ফেলেছিলো। শুধু বলেছিলো... আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে নিয়ে পালাতে পারব না। আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাথে জড়িয়ে, দুই পরিবারকে কষ্ট দিয়ে আমরা কেউ সুখি হতে পারব না।আমি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেকেটে ফিরে এসেছিলাম। এর কিছুদিন পর অভিকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। ভালো পড়াশোনা, ভালোবেতনের চাকরী। যে কেউই এমন ছেলে পেলে লুপে নিবে। খুব শ্রীঘ্র ই ধুমধাম করে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো। অভিক খুব ভালো ছেলে। কখনো কোন কষ্ট দেয়নি। স্ত্রী হিসাবে যতটুকু ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য, অভিক তার চেয়েও বেশী ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে আমায়। এই মাঝে মাঝে নিজারকে মনে পড়লে কষ্ট হয় বুকের খুব গভীরে। কিন্তু তার আঁচ আমি কখনো আমার সংসারে লাগতে দেইনি। বিয়ের পর অভিকের চাকরীসুত্রে বদলী এই শহরে।বাবাও গত হয়েছেন অনেকদিন। মা ভাইয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। গ্রামে যাওয়া হয় না অনেক বছর। নিজারের খবর ও নেয়া হয়নি অনেকদিন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের গভীর থেকে। চোখ বেয়ে কয়েকফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। অনেক রাত হয়েছে। অভিক এখনো ফেরে নি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম... অভিক ফোন করেছিলো। আমি বারান্দায় ছিলাম। বৃষ্টির আওয়াজে শুনতে পাইনি। ফোন করলাম অভিককে। কয়েকবার রিং হতেই অভিক ফোন ধরলো... যা বললো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। পাগলটা একটা ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করেছে। অভিক ফেরার পথে দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয় নি। তাই সারারাত অভিককে হাসপাতালে থাকতে হবে।পোস্টমর্টেম করে সকালের আগে লাশ দিবে না। অভিক আমাকে বললো... পারলে সকালে একবার এসো। অভিকের সাথে কথা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে আবার। অভিকের ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো। ইরা তাড়াতাড়ি এসো.... নিজারকে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর তোমাকে তো বলা হয় নি। নিজারের বাড়ী তোমাদের গ্রামেই ছিলো। নিজারের নামটা শুনে বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো। এই কি আমার সেই নিজার, তাহলে তাকে আমি চিনতে পারলাম না কেন। কি করেই বা চিনবো? আমি তো তার দিকে ভালো করে তাকাই নি। পাগল ভেবে নোংরা দেখে নাক সিটকিয়েছি। দ্রুত তৈরি হয়ে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছলাম। হাসপাতালের বেডে দেখলাম... আমার নিজার ই তো শুয়ে আছে। আজ আর তার সেই জট ওয়ালা চুল, দাঁড়ি কিচ্ছু নেই। আজ আর তাকে চিনতে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। অভিক বলে উঠলো... আশে পাশের সবাই নাকি দেখেছে বৃষ্টির রাতে নিজার নিজেই ট্রাকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তবে কি নিজার আমার উপর রাগ করেই চলে গেলো এ পৃথিবী ছেড়ে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু অভিক আর আমার মেয়ের সামনে পারছি না। তবে দু'চোখ বেয়ে জল পড়ছে আর অভিক কে বলছি... অভিক আমি ওকে চিনি খুব ভালো করেই চিনতাম। তবে ওর এই পাগলের বেশ দেখে তার দিকে ঠিক ভাবে তাকাইও নি। তাই তাকে চিনতে পারি নি। এবার অভিক যা বললো...আমি শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। নিজার নাকি অভিককে বলেছিলো... তার ভালোবাসার মানুষ টাকে শত চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারে নি। তার ভালোবাসার মানুষের জন্য ই তার আজ এই দশা। তবে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ভুলে সুখেই আছে। তাকে চিনতে পর্যন্ত পারে নি। তবে কি আমার ধারনাই সত্যি... আমার উপর অভিমান করেই আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো নিজার।