রিমি আমার হাতে কার্ডটা ধরিয়ে দিয়ে মলিন মুখে বললো,
- অাগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। দাওয়াত খেতে আসিও।
বাক্য দুটো বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি রিমির হাতটা ধরে বললাম,
- চলো না আমরা পালিয়ে যাই?
এক ঝটকায় আমার হাতটা সরিয়ে বললো,
- আমি আমার বাবার মুখে চুন-কালী দিতে পারব না। এতদিনেও তুমি আমার বাবাকে প্রস্তাব দিতে পারো নাই। ভীরু কাপুরুষ তুমি।
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
- চাকরির চেষ্টা তো কম করছি না রিমি। না পেলে কোন মুখে গিয়ে তোমার বাবার সামনে দাঁড়াব, বলতে পারো?
চোখের পানি মুছতে মুছতে কার্ডটা আমার হাতের উপর দিয়ে বললো,
- ইচ্ছে হলে খেতে আসিও। তোমার একবেলা মিলের খরচ বাঁচবে। সাথে কিছু ভালো খাবারও খেতে পারবে।
রিমির একথায় হাসব কী কাঁদবো বুঝতে পারছি না। আমার এই কষ্টের দিনেও রিমির একথার জন্য জন্য হাহা করে হাসতে ইচ্ছে করছে। তবুও হাসিটাকে চেপে ধরে বললাম,
- তোমার স্বামী, মানে হবু স্বামী কী করে?
- বিমানবাহিনীতে চাকরি করে।
আমার কিছুটা অাশ্চর্যের সাথে ভীত হয়ে বললাম,
- খবরদার এমন ছেলেকে তুমি বিয়ে করো না প্লিজ। পুলিশ বা নৌবাহিনীতে দূর্ঘটনা ঘটলে মানুষ বাঁচার সুযোগ থাকে। আর বিমানবাহিনীতে এমন সুযোগ নেই। সোজা উপরে চলে যেতে হবে।
আমার কথায় দাঁতের উপর দাঁত রেখে রিমি বলে উঠলো,
- তুমি আমার হবু স্বামীকে অভিশাপ দিচ্ছো। থাকো আমি গেলাম, আমাকে আর ফোন দিবা না।
বলেই হনহন করে সামনের দিকে হাঁটা দিলো রিমি। আমি পিছন থেকে হিরোর স্টাইলে তার হাতটা টেনে ধরে বললাম,
- তাহলে কি আমাদের ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো রিমি?
- দেখ শুভ আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, সত্যি ভালোবেসেছি কিন্তু ব্যর্থতা তোমারই। ভালো থেক।
রিমি চলে গেল। আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম। তাকে অাটকানোর শক্তি আর আমার নেই। আগামী শুক্রবারই তো সে অন্যকারোর হয়ে যাচ্ছে। রিমি চলে যাওয়ার পর বিয়ের কার্ডটা নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় দু'ফোঁটা পানি কার্ডটাকে স্পর্শ করলো। আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম, নাহ কোনো পাখি তো নেই। তাহলে? গালে হাত দিয়ে বুঝলাম আমার চোখ দিয়েই পানি ঝরছে।
.
সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে নির্ধারিত সময়ে রিমির বিয়ের দাওয়াত খেতে রিমিদের বাড়িতে চলে আসলাম। সাথে নিয়ে আসলাম বড় একটা গিফট পেপারে মোড়ানো একটা গিফট। হাজার হলেও প্রেমিকার বিয়ের দাওয়াত বলে কথা। এর আগে রিমিকে ফোন দেয়াতে রিসিভ করেনি। তাই ওদের বাড়ি এসে এদিক-সেদিক খুঁজতে লাগলাম। নাহ! কোথাও নেই। একজন ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো,
- এই মিয়া কারে চান?
- রিমি।
- রিমি আপুরই বিয়ে।
- জানি তো।
- তাহলে খুঁজতেছেন যে।
- তাকে একটু ডেকে দেয়া যাবে?
- না না। ওকে সাজানো হচ্ছে। কে আপনি?
ছেলেটার চালচুলো দেখে বুঝলাম রিমির ভাই। অনেকদিন আগেও একবার দেখেছি তাকে। স্বভাবতই এই বাড়িতে কেউ আমাকে চিনে না। ভালোই হলো, নির্বিঘ্নে দাওয়াত খাওয়া যাবে। গতকাল থেকে যা ধকল গেছে।
- ওই কী হলো?
আমি একটু রেগে বললাম,
- ওই শালা, দেখতেছিস না হাতে গিফট। দাওয়াত খেতে আসছি। রিমির বন্ধু অামি।
- সিট ফাঁকা অাছে, গিফটটা দিয়ে খেতে বসে পড়েন।
আমার হাত থেকে গিফটটা নিয়ে হনহন করে চলে গেল। মনে মনে ভাবলাম, মানুষ না ডাকাত এ।
.
প্লেটে সুন্দর সুন্দর খাবার দেয়া হয়েছে। কতদিন এমন সুন্দর খাবার খাইনি। বিশেষ করে মুরগীর রোস্টটা। শেষ কবে খেয়েছি মনে নেই। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো,
পকেট থেকে বের করে দেখলাম, রিমি ফোন দিয়েছে। অাশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, নাহ কোথাও নেই। রিসিভ করলাম,
- বাহ, প্রেমিকার বিয়ের দাওয়াত তো ভালোই খাচ্ছ। আরো মুগরীর রোস্ট নিবা?
আমি এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে বললাম,
- দেখ, প্রেমিকা হও আর যাই হও। দাওয়াত তো দাওয়াত। তিন হাজার টাকার গিফট দিয়ে শুধু গোস্ত ভাত খাব, তা হয় নাকি? সারাদিন যা ধকল গেছে, আর কখন খেতে পারব তার ঠিক আছে!
- বা বা। তা প্যাকেটের মধ্যে অাছে কী?
- ইয়ে মানে, নবজাতক শিশুর জন্য যা যা লাগে সব অাছে।
- মানে?
- মানে, তোমাদের বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পর যেন বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সেজন্য আগে থেকেই সবকিছু দিয়ে দিলাম।
- তুমি সত্যি একটা হারামী, কুত্তা, শয়তান।
গরু, খাসি, মুরগীর সাথে আরো তিনটা খাবার জুটলো। খাবার নিতান্তই ভালো প্রকৃতির হওয়ায় পেটের কোনো অংশ বাদ থাকলো না। গিফটের টাকা সুদে-আসলে শোধ করে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
.
আজ পনেরো বছর পর,
রিমি আর আমি একসাথে বসে অাছি। রিমি চা ঢালছে। হঠাৎই হাহা করে হেসে উঠলাম। রিমি বললো,
- হাসছ কেন?
আমি কাপটা টেবিলে রেখে বললাম,
- বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
- তুমি অাস্ত একটা শয়তানের হাড্ডি। আমি তো বরের বেশে তোমাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
- প্ল্যানটা কেমন ছিলো?
- একদম পঁচা।
চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললাম,
- আমি প্ল্যান করে বাবাকে সবটা বলেছিলাম। আমার বাবা ছিলেন আমার বন্ধুর মতো। আমি চেয়েছিলাম দেখতে তুমি আমায় কতটুকু ভালোবাস, আর তারপর বাকিটা সারপ্রাইজ।
- তোমার চাকরি হয়েছে সেকথাও তুমি আমায় বলোনি। আর তোমার নাম তো শুভ না, রায়হার।
- প্রেমের জগতে কারো নাম ঠিক থাকে না রিমি।
- তা তোমার ভালোবাসার পরীক্ষায় কি আমি পাশ করেছিলাম?
আমি চোখ টিপে ইশারা করে বললাম,
- হ্যাঁ।
রিমির খোঁপায় একটা বকুল ফুলের মালা গুঁজে দিয়ে বললাম,
- হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।
রিমি মুচকি হেসে আমার দিকে চেয়ে রইলো।
(সমাপ্ত)
0 Comments