এ নিয়ে তিনবার সাইকিয়াট্রিস্ট কে দেখানো হলো। প্রথমবার সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক আমার সাথে তেমন কথা বলেন নি। আমার পক্ষ হয়ে রিনি সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলো। প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে ভদ্রলোক রিনিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আপনি বলেছিলেন, আপনি উনার গার্লফ্রেন্ড, আচ্ছা বলুন তো উনার মাথায় কয়টা পাকা চুল আছে?" রিনিকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। এ প্রশ্নের উত্তর রিনির জানার কথা? কারো মাথায় কয়টা পাকা চুল থাকতে পারে সেটা তার নিজেও জানার কথা না। রিনি কিভাবে জানবে? অবশ্য কিছুদিন আগে আমার খুব জ্বর এসেছিলো। রিনি আমার ব্যাচেলর বাসায় এসে মাথায় পানি ঢালার সময় বলেছিলো, "দেখো রূপক, আর কক্ষনো লুঙ্গি খুলে বারান্দায় যাবানা, মনে থাকবে? কী লজ্জার কথা! এত্ত বড় ছেলে লুঙ্গি খুলে বারান্দায় যায়! লোকজন কি বলবে বলো তো!" মাথা মুছিয়ে দেয়ার আগে মগটা বালতিতে রাখার সময় আবার বললো, "কি নোংরা করে রেখেছো বালতিটা! তোমাদের বুয়া কোথায়, ডাকো তো!" পাশের রুমের অনার্স পড়ুয়া লিমন রিনিকে ভাবী বলে ডাকতো। সে তখন বলেছিলো, "ভাবী, আপনি একদম চিন্তা করবেন না, এখন থেকে আমি নিজে ভাইয়ার লুঙ্গিতে গিট্টু দিয়ে রাখবো, উপরে একটা গিট্টু আর নীচে আরেকটা"। রিনি সেদিন খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছিলো। টাওয়েল দিয়ে শেষবার মাথা মোছানোর সময় বলেছিলো, “মাথা এমন গরম থাকলে সব চুল পেকে যাবে, দেখি দেখি তোমার চুল পেকেছে কিনা!” (২) আজ সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। কয়েক মিনিট ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার অর্থ কি হতে পারে? আমাকে কি ভদ্রলোক বিব্রতকত অবস্থায় ফেলতে চাচ্ছেন? হতে পারে, সাইকিয়াট্রিস্টরা সবসময়ই পেশেন্টদের মন হাতের মুঠোয় নিতে চান। পেশেন্টদের ইচ্ছা বা আকাঙ্খাকে প্রাধান্য দিয়ে সূক্ষ্মভাবে ট্রিটমেন্ট করান। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে রিনিকে বললেন, "এখানে আসার আগে আপনি উনাকে চুমু দিয়েছেন নাকি উনি আপনাকে দিয়েছে?" ডাক্তার সাহেবের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হলাম। আমি অতিমাত্রায় খুশি হয়ে নিজেকে সংবরণ করে চুপ করে বসে আছি। ভাবছি, এই ভদ্রলোক তো একজন জিনিয়াস! তা না হলে তিনি কিভাবে এমন ঘটনা অনুমান করলেন? রিনি খুব সামান্য লজ্জা পেয়ে বললো, "জ্বী আমিই" ডাক্তার ভদ্রলোক আমার দিকে এখনো তাকিয়ে আছেন। রিনিকে বললেন, "রূপক সাহেবের রেস্পন্স কেমন ছিলো? আই মিন, তিনি কি সাগ্রহে সেটা গ্রহণ করেছিলেন?" রিনি এবার একটু লজ্জা পেলো। কথা ঘুরিয়ে সামান্য কাতর কণ্ঠে বললো, "স্যার, ও কি কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না?" রিনির কথা ঘোরানো দেখে ভদ্রলোক অল্প চটে গেলেন। একটু ধমকের সুরে বললেন, "ডোন্ট স্কিপ মাই কোশ্চেন, এন্সার মি টু দ্য পয়েন্ট।" আমার রাগ হলো। রিনির সাথে লোকটা জোরে কথা বলেছে। কেনো রিনিকে ধমকিয়ে কথা বলবে? আমাকে তো তিনি ফ্রী চিকিৎসা দিচ্ছেন না। হাত কচলাতে কচলাতে বললাম, "দেখুন ডাক্তারসাহেব, যা জিজ্ঞেস করার আমাকে করুন, ওকে আর একটা কথাও বলবেন না, কি জানতে চান? আমার কেমন লেগেছিলো?.....খুবই ভালো লেগেছিলো। ওর চুমুটা অনেক মিষ্টি ছিলো। এর পরের প্রশ্ন করুন...." ডাক্তার ভদ্রলোক চুপ আছেন দেখে আমার আরো রাগ হলো। ধীরে টেবিল চাপড়িয়ে বললাম, "জিজ্ঞেস করুন, রিনি মাসে কয়বার আমার বাসায় আসে, কয়বার আমাকে খাইয়ে দেয়, জিজ্ঞেস করুন, রিনি কয়বার আমাকে গোসল করায়, নাকি আরো অন্য কিছু জিজ্ঞেস করবেন...?" ডাক্তার সাহেব শান্তভাবে রিনিকে বাইরে যেতে বললেন। রিনি বাইরে যেতে তিনি উঠে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। নিজের ডান গাল এগিয়ে দিয়ে বললেন, "নিন, এখানে কষে একটা থাপ্পড় দিন।" আমার চুপ থাকা দেখে তিনি আবার বললেন, "থাপ্পড় দিন নয়তো আমাকে থাপ্পড় দিতে দিন।" মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। এখন আমার কি করা উচিত? অন্যসময় মাথা কাজ না করলে লুঙ্গি খুলে দিগম্বর হয়ে বারান্দায় দাঁড়ালে কোনো না কোনো একটা বুদ্ধি বের হতো। ডাক্তার সাহেবের সামনে দিগম্বর হওয়া অভদ্রতার মধ্যে পড়বে। পাগলদের পাগলামি করা মানায়, অভদ্রতা নয়। পাগলামি আর অভদ্রতা দুটো আলাদা জিনিস। আচ্ছা আমিই না হয় থাপ্পড় খাই, মানী লোকের মান নষ্ট করে লাভ কি? ভদ্রলোক আমাকে থাপ্পড় দিলেন না। মাথা ঝুঁকিয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন, "রূপক সাহেব, আপনি জানেন কি, আপনি যে একদম সুস্থ্য একটা মানুষ? আপনি দিগম্বর হলে কার কি সমস্যা? এটা আপনার ব্যক্তিগত অভিরুচির মধ্যে পড়ে, কোনোভাবেই এটা রাষ্ট্রীয় সমস্যা নয়। আই এপ্রিসিয়েট ইউ...ক্যারি অন মাই ব্রাদার!" রিনি আমাকে সিঁড়ি ধরে নামাচ্ছে। একটা টিকটিকি সিঁড়ির দেয়ালে ঝুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব ভয়ে রিনির কাঁধে সজোরে টান দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করতে রিনি বললো, "আস্তে রূপক!" (৩) এমন একটা টিকটিকি সেখানেও ছিলো। সেখানে পুরোটা ঘর জুড়ে একটা চেয়ার ছাড়া অন্য কোনো আসবাবপত্র ছিলোনা। একটা ভেন্টিলেটর, একটা লোহাকাঠের পাল্লাতে শিকের জানালা আর মোজাইকের পুরোটা মেঝে, আমার বিছানা। প্রতি রাতে আনুমানিক দশটার দিকে যখন ওরা দুজন আমার চোখের বাঁধন খুলে দিতো তখনও ঘরটা ভীষণ অন্ধকার থাকতো। ওদের একজন 'কট' করে বোর্ডের সুইচ অন করলে পুরো ঘর আলোতে ভরে যেতো। আলোর ঝাপটা এতটা প্রকট ছিলো যেন চোখে কেউ ঝাঁঝালো কিছু ছিটিয়ে দিয়েছে। আমি চিৎকার দিয়ে বলতাম, "বন্ধ করো, প্লিজ লাইটটা বন্ধ করো!" দুজনের কেউই আমার সাথে তেমন কোনো কথা বলতো না। একজন হাতের শেকল টা খুলে ডান পায়ে বেঁধে চেয়ারের সামনে একটা কালো পলিথিন ছুঁড়ে দিতো। অন্যজন একটা দেড় লিটারের পানির বোতল খুলে সেটার ভেতর কি যেন একটা মেশাতো। কালো পলিথিনের শুকনা রুটি অল্প তেলের ডিমভাজির চারপাশে জড়িয়ে অর্ধেক মুখে ঢোকালে শুকনো গলায় আটকে যেত। ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বাকিটা শেষ করতাম। খানিকক্ষণ মাথা ঝিমঝিম করার পর ঘুম যেন দু’চোখে জুড়ে আছড়ে পড়তো। সামনের দেয়ালে ওৎ পেতে থাকা টিকটিকিটাকে ধীরে ধীরে ঝাপসা দেখা শুরু করতাম। ঘুমের ঘোরে কিছুক্ষণ সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার পর নিভু নিভু চোখে ভেসে উঠতো রিনির মুখ, কী নিখুঁত সে মুখ! কি মায়াভরা ডাগর চোখের নিখুঁত মুখ! (৪) দ্বিতীয় বার যেদিন আমাকে সেই সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সেদিন ডাক্তার ভদ্রলোক প্রায় পুরোটা সময় আমার সাথে কথা বলেছিলেন। রিনি সেদিন চুপচাপ ছিলো। ডাক্তার সাহেব আমার মুখ থেকে অগোছালোভাবে সবকিছু শোনার পর প্রচুর প্রশ্ন করতে শুরু করেন। প্রায় অর্ধশত প্রশ্নের শেষের দিকের একটা প্রশ্ন ছিলো এরকম, "ধরুন, রিনি আপনাকে একটা ফাঁকা ঘরে ডেকে নিয়ে গেলো। সেখানে রাখা একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে আপনাকে বসিয়ে হাত পা বেঁধে আটকে রাখলো। লিসেন, আপনার হাত ও পা দুটোই কিন্তু বাঁধা! আপনি খুবই তৃষ্ণার্ত ছিলেন। ভীষণ তৃষ্ণায় আপনার গলা শুকিয়ে প্রায় কাঠ হয়ে গেছে। গলা দিয়ে একটুও আওয়াজ বের হচ্ছে না। রিনি মুখভর্তি পানি নিয়ে আপনার কাছে এগিয়ে গেলো। ও এমন শর্ত দিলো যে, আপনি যদি পানি খান তবে চুমু খেতে পারবেন না আর যদি চুমু খান তবে পানি খেতে পারবেন না। তখন আপনি কোনটা বেছে নেবেন?" আমি তখন ডাক্তার ভদ্রলোকের কোঁকড়া চুলের দিকে তাকিয়ে আছি। তাঁর চেয়ারের ঠিক উপরের ছাদে একটা টিকটিকি বসে আছে। আমি মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম টিকটিকিটা যেন টুপ করে তাঁর চুলের উপরে পড়ুক। কোঁকড়া চুলের ভেতরে সেটা ঘাপটি মেরে বসে থাকুক। ভদ্রলোক মাথায় হাত দেয়ার আগে আমি আমার মুখের সামনে উলম্বভবে আঙ্গুল চেপে ধরে ‘হিসসস!’ বলতে ডাক্তার সাহেব স্ট্যাচু হয়ে স্থিরভাবে বসে থাকবেন। আমি উঠে গিয়ে তাঁর মাথার দিকে হাত বাড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলবো, "ডাক্তার সাহেব, রিনি আপনার মতো এত পাগল হয়নি যে চুমু খাওয়ার সময় মুখে পানি রাখবে।" টিকটিকিটা ছাদে ঝুলেই থাকলো, পড়লো না। ডাক্তার ভদ্রলোকের দ্বিতীয়বার শুনতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে সোজা সাপ্টা উত্তর দিয়েছিলাম, "দুটোই খাবো। আগে পানি খাবো, পরে চুমু, উত্তর পেয়েছেন?" যেনো যুদ্ধ জয় করে ফেলেছেন এমনভাবে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে রিনিকে বলেছিলেন, "এ চেয়ারটায় বসুন। আমি নতুন একটা মাত্র ঔষধ লিখে দিচ্ছি, আগেরগুলা সব বাদ, কই বসুন!" (৫) এইতো দিন বিশেক আগে আমাকে আটকে রাখা দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত মোটা লোকটা আমার হাত-পায়ে জড়ানো শেকলের বাঁধন খুলতে খুলতে বলেছিলো, "ভেতরের রুমে একটা কাঠের চেয়ার আছে সোজা গিয়ে ওখানে বসবেন, কিছুক্ষণের মধ্যে বস্ আসবেন, উনি আপনার সাথে কথা বলবেন...দয়া করে পালাবার কোনো চেষ্টা করবেন না, এখানে পালানোর কোনো রাস্তা নাই। বুঝেছেন?" অপেক্ষাকৃত কম মোটা লোকটা একটা শর্টগান হাতে মেইন গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো। লোকটার গায়ের ভেস্টে কোমরের দিকে একটা বুলেট বেল্ট, কোমরের ডানপাশে চামড়ার হোল্ডারে একটা পিস্তল সাঁটা ছিলো। ড্রেসটা দেখতে অনেকটাই আমাদের ডিবি'র ইউনিফর্মের মতো। লোকটা চোখ ইশারায় আমাকে ভেতরের রুমে যেতে বললো। এ রুমের কাঠের চেয়ারেও দুহাত আরাম করে রাখার জন্য হাতল আছে। কয়েকহাত সামনেই আরেকটা দামী রেক্সিনের গদিওয়ালা রিভলভিং চেয়ার। আমাকে বলা হয়েছে কাঠের চেয়ারে বসতে। এ চেয়ারে কি আমি আয়েশ করে হাতল দুটিতে দুহাত ছড়িয়ে বসবো? বোধহয় ঠিক হবে না। বরং কাঁচুমাঁচু হয়েই বসি। কাঁচুমাঁচু ভঙ্গিতে বসলে অপরাধীর জন্য প্রতিপক্ষের একধরণের দয়া হয়। যদিও আমি ঠিক এখনো জানিনা কি অপরাধের জন্য আমাকে এরা তুলে এনেছে। আমি স্বাভাবিকভাবেই চেয়ারে বসে ভাবছিলাম এরা আমাকে নিয়ে কি করবে? আমি কি এমন করেছি এদের বিরূদ্ধে? এরাই বা কারা? মিনিট তিনেক পর একজন সাদা শার্ট পড়া ভদ্রলোক এলেন। চোখে সামান্য পাওয়ারি হাফফ্রেম চশমা। চুল আর্মিদের মতো ছোট ছোট করে ছাঁটা। রিভলভিং চেয়ারে বসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “হলি আর্টিজেনের পর আপনাদের নতুন টার্গেট কোনটা ছিলো?” কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমার নীরবতার লোকটা বিরক্ত না হয়ে একটানা বললেন, “ওয়েল, মিস্টার রুবাইয়াত হাসান, আমাকে একটা কথা বলুন, নিউইয়র্কে স্পেস স্টেশনে সাতাশ মেগাটনের বোমা কে কে রেখেছিলো? এজ্‌ ফার উই নো, এর সঙ্গে আরো তিনজন বাংলাদেশী জড়িত আছে। ফর্মুলাগুলো কে চুরি করেছিলো? কি মনে পড়ছে?.... আপনি শুধু ওদের নাম বলুন। আমি কথা দিচ্ছি, আপনার কিছু হবেনা।” ভদ্রলোকের কথা শেষ হতে না হতেই আমি বললাম, “আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি রুবাইয়াত হাসান না। আমার নাম ইশতিয়াক আহমেদ। আমি মাস্টার্স পাশ করে চাকুরী খুঁজছি। আমি কোনো হাসানকে চিনিনা” লোকটা হেসে দিলেন। বললেন, “তা, ইশতিয়াক সাহেব, আপনি ভালো আছেন তো?” (৬) রিনি মাঝে মধ্যেই আমাকে এভাবে প্রশ্ন করতো, “রূপক সাহেব, আপনি ভালো আছেন তো?” আমি উত্তরে বলতাম, “জ্বী ম্যাম, ভালো আছি।” অথচ আমরা কেউ ভালো ছিলাম না। ভালো থাকার জন্য কিছু মৌলিক সুযোগ দরকার। আমাদের সেরকম কোনো সুযোগ ছিলোনা। রিনির বড় বোনের ডিভোর্সের পর বাপের বাড়িতে শেকড় গেড়ে বসে থাকা বাবার একদম সহ্য হচ্ছিলোনা। রিনির বাবা মাঝে মধ্যেই উঁচুস্বরে বলতেন, “কোন ব্যাডাডা মহাপুরুষ দেহা তো! জামাইয়ের নাহয় একটু আকটু দোষ আছিলো, মাইয়া হইয়া জন্মাইছছ, এত্‌টুক সহ্য করবিনা?” একটা ছাপোষা সংসার চালাতে রিনির বাবা হাঁফসে উঠেছিলেন। প্রেসারের ঔষধ না কিনে রিটায়ারপ্রাপ্ত ভদ্রলোক নিয়মিত রোজা রাখতেন। রিনির মায়ের ইনসুলিন কেনা হতোনা। আমার খুব খারাপ লাগতো যখন দেখতাম রিনি কে-ক্রাফ্টের দোকানে বাচ্চাদের কাপড় উঁচিয়ে ভদ্রমহিলাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। সামান্য সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বেতন থেকে সিকিউরিটি কভারেজের জন্য ওরা এক হাজার করে মাসে কেটে রাখতো। আমার একদম সহ্য হতোনা। শত হতাশার মাঝেও বেকার জীবনের প্রতি সন্ধ্যায় আমি রিনিকে নিতে এলিফ্যান্ট রোড যেতাম। এসি থেকে বের হয়ে রিনি ওড়না দিয়ে চশমাটা মুছতো। গেরুয়া রঙা শিফনের ওড়নাতে কি ঘোলা চশমা মোছা যায়? যায় না বলেই আমাকে ঝাপসাভাবে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতো, “রূপক সাহেব, আপনি ভালো আছেন তো?” ওর হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে কাঁটাবনের দিকে এগুতে পাশ থেকে বিরিয়ানীর ঘ্রাণ আসতো। কি বিচ্ছিরি সুন্দর সে ঘ্রাণ! পকেটে সাকুল্যে বিশ বাইশ টাকা থাকতো হয়ত! দুপুরে রিনি কিছু খায়নি জেনেও না খাওয়ানোর জন্য ক্ষীণস্বরে বলতাম, “কিছু খাই চলো” রিনি শুনতে পেত না। বলতো, “কিছু বললে?” ভ্যাঁ-পুঁ ক্রিং ক্রিং আওয়াজের মাঝে আমাদের প্রস্তাবনা ও আগ্রহ মিশে যেতো। মনকে সান্ত্বনা দিতাম, আমি তো খাবার কথা বলেছিই, একটা সিঙারা খেলে এমন কিইবা হতো! না খেলে না খাক! আমার কী! সে রাতেই রিনির বড়বোন আত্মহত্যা করেছিলো। দুটো ছোট ছোট ছেলেকে তাদের নানুভাই বুকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছিলেন। ভদ্রলোকের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিলো। তবে তিনি সেটা স্বীকার না করে রিনির আহাজারিরত মাকে বকছিলেন, “আর কানবিনা হারামজাদি, ভাত তুইলা দে, বাচ্চা দুইডারে কেডা খাওয়াইবো?” বাসায় ঢুকে রিনি ওর মুক্তারঙা পার্টসটা সোফার একপাশে রেখে ভাত তুলতে রান্নাঘরে ঢোকে। কয়েকটা পাখা ছাড়া আরশোলা সিঙ্কের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিলো দেখেও রিনির গা ঘিনঘিন করলোনা। সে রাতে শুধু বাচ্চা দুটি ভাত খেয়েছিলো। রিনির বুড়ো আঙ্গুলে থ্যাললানো পাতলা ঝোলডালে মাখা নরম ভাত। (৭) আমি ভালো আছি কিনা জিজ্ঞেস করে মেজর চেহারার ভদ্রলোক রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর চারজন বিশালদেহী মুখোশ পরা লোক আমার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত টুপি পরিয়ে দিয়েছিলো। কয়েকদিনের ঘামে ভেজা চিটচিটে প্যান্ট থেকে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে। একজন একটা পুরোনো লুঙ্গি সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, “পড়ে নে...” সে চেয়ারেই হাতলের সাথে আমার দু’হাত আর পায়ার সাথে আমার দু’পা খুব আঁটসাঁট করে বাঁধা হয়েছিলো। আমি জ্ঞান হারানো পর্যন্ত ওরা উপর্যুপরি পেটাতে লাগলো। একবেলা ডিম-ডালের তৈরী শরীরে আর কতোই বা সহ্য হবে! তারপর আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, আমি মা’কে ডাকছিলাম, পরক্ষণেই সৃষ্টিকর্তাকে। জ্ঞান হারানোর শেষ মুহুর্তে মনে পড়েছিলো রিনির মুখ, কী নিখুঁত একটা মুখ! কি মায়াভরা ডাগর চোখের নিখুঁত মুখ! জ্ঞান ফিরলে দেখি অবসন্ন শরীরে অসাড় চারটা হাত-পা নিয়ে সেই আগের রুমে শুয়ে আছি। । এক পায়ে জড়ানো আগের লোহার শেকল। একটা চেয়ার, লোহাকাঠের জানালা আর দেয়ালে ওৎ পেতে বসে থাকা সেই টিকটিকি। আমি টিকটিকিকে ডেকে বলেছিলাম, “টিকটিকি ভাই, আজ থেকে তুই আমার ভাই, ও টিকটিকি ভাই, একটু এদিকে আয়, আমার লুঙ্গিটা খুলে দিয়ে যা! ভীষণ ভারী লাগছে রে, আয়না ভাই, একটু খুলে দিয়ে যা!” এভাবে কয়দিন কেটেছে আমার জানা নেই। এমন সন্ত্রস্ত্র সময়ের হিসাব রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। দিনগুলো এমন ছিলো যে, যে কোনো কারণে দরজায় শব্দ হলেই আৎকে উঠতাম। ভীষণ ভয়ে হাতদুটো পেটের মধ্যে লুকিয়ে কুঁকড়ে চেয়ারে বসে থাকতাম। ওরা আসতো। এক দু’দিন অন্তর অন্তর আমাকে একই ভাবে পেটানো হতো। ওরা চলে গেলে জ্ঞান ফিরলে আমি দিগম্বর হয়ে শুয়ে থাকতাম। প্রতিদিনই আমি ওদের বলতাম, আমার কি দোষ? তোমরা কেউ কি জানো আমার কি দোষ? ওরা কেউ আমাকে কিছু বলতো না। চারটা লোকের কোনো একজনও আমাকে কখনো কিছু বলতোনা। না মিথ্যে বললাম, একদিন একজন খুব রেগে বলেছিলো, “কুত্তারবাচ্চা, তোর বাল দেখার জন্য এখানে আসছি, নে লুঙ্গিটা পর্!” সপ্তাহখানেক পর একদিন মেজর চেহারার লোকটা ঠিক আমার চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, “ইশতিয়াক সাহেব, আপনি ভালো আছেন তো?” এবার তিনি হাসলেন না। হাতে বিরিয়ানীর একটা প্যাকেট ধরিয়ে কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলেছিলেন, “খেয়ে নেবেন।” ভদ্রলোক চলে যাবার আগে আমার দিকে হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বললেন, “আমাদের কিছুটা ভুল হয়েছিলো। কি করবো বলুন, আমাদের তো সরকারী হুকুম মানতে হয়।” আমি হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলাম। সুগন্ধি বিরিয়ানীর ঘ্রাণ নাকে যেতে রিনির কথা মনে পড়লো। একটা সিঙ্গারা বনাম বিরিয়ানীর তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। আমার মগজের যুদ্ধক্ষেত্রে তুমুল লড়াইয়ে সিঙ্গারা হেরে গেলো। পেট পুরে এক প্যাকেট বিরিয়ানী খেয়ে মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলাম। বিরিয়ানীর উচ্ছিষ্টাংশে একদল পিঁপড়ারা লাইন বেঁধে জড়ো হতে থাকলো। উপর থেকে নেমে আসা টিকটিকি আর আমি কতক্ষণ যে মুখোমুখি বসেছিলাম সেদিন তা কেউ হিসেব রাখিনি। টিকটিকিটা যেন কানের কাছে ফিসসিসিয়ে বলেছিলো, “কিরে ভাই, তুই এখনো লুঙ্গি পরে আছিস? ঘুরে শো, আয় খুলে দেই!” (৮) আজ তৃতীয়দিন সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোককে রিনি আবারও সব কথা গুছিয়ে খুলে বলছিলো। ধানমন্ডি বত্রিশের সামনে যেখান থেকে আমাকে তোলা হয়েছিলো, ফজরের আজানের পরপর একদিন সেখানেই কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে ফেলে রেখেছিলো। ওরা ভুল করে আমাকে ধরেছিলো সেকথাও বলা হয়েছে। ওদের ভুলের মাশুল আমাদের মতো সাধারণ মানুষের গুণতে হচ্ছে একথাও বলা হয়েছে। ডাক্তার ভদ্রলোকের সে ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব ছিলোনা। তিনি হাসিমুখে রিনিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনারা কবে বিয়ে করবেন?” রিনি বলতে না চেয়েও সংক্ষেপে আমাদের দুরাবস্থার কথা ডাক্তার সাহেবের কাছে বর্ণনা করে আমাদের অক্ষমতার কথা বলেছিলো। বলেছিলো, একটা সামান্য চাকরির জন্য আমার দ্বারে দ্বারে ঘোরার কথা। বলেছিলো, ওর বাবা মাকে নিয়ে ওর সংগ্রামের কথা। ভদ্রলোক কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে ছিলেন। বেশ কিছু সময় নিরব থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “রূপক সাহেব, এখন থেকে আমিও বারান্দায় দিগম্বর হয়ে দাঁড়াবো, আপনার ভাবী ঝামেলা করলে সোজা আপনার মেসে চলে যাবো। আপনার বারান্দায় আমার জন্য জায়গা হবে তো?” (৯) রিনি আমাকে সিঁড়ি ধরে নামাচ্ছে। টিকটিকিটা যেখানে ছিলো সে জায়গা পার হয়ে অনেক নিচে নেমে এসেছি। এখন তেমন ভয় লাগছে না। নীচতলায় আসতে আমার ছুটে যেতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে হলো, এক দৌড়ে ধানমন্ডি বত্রিশের সেই জায়গায় গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলি, "এইযে, আমি রুবাইয়াত হাসান, আমিই সেই টেররিস্ট। তোমরা রূপককে ছেড়ে দাও। আমাকে উলঙ্গ করে রূপককে ওর লজ্জা ফিরিয়ে দাও।" শরীরে একধরণের ক্ষিপ্ততায় গা কাঁপছিলো। রিনি শক্ত করে আমার হাতটা ধরে আবার বললো, "আস্তে রূপক!" (১০) রিনির কাছ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি। এক কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো কিছু ছেলে দেয়ালে সাঁটা চাকরির পত্রিকা গুলো হাত উঁচিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখছে। কিছু রিক্সাওয়ালা কৃষ্ণচূড়ার নীচের চায়ের দোকানে বসে মুক্ত হাতগুলোতে পিঠের শিড়দাঁরার ঘামের স্রোত মুছছে। একটা কালো ছোট্ট মেয়ে তার খোলা হাতে কয়েকটা গোলাপ নিয়ে আমার দিকে দৌড়ে এসে বললো, "স্যার...ফুলডা...ল'ন" আমি অল্প ঘুরে রিনির দিকে তাকিয়ে আছি। রিনি তাকিয়ে ফুলটার দিকে। ও হয়ত ভাবছে, ফুলটা দাম কম করে হলেও দশ টাকা হবে! কি মনে করে যেন পার্স থেকে একটা লাল দশ টাকার নোট বের করে কালো ছোট্ট মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলো। কালো হাতে লালের দৌড় দেখতে দেখতে রিনি লাজুক মুখে আমার দিকে ফুলটা এগিয়ে দিলো। আমি রিনির হাত আলতোভাবে ধরে বললাম, "তুমি চুলটা বেঁধে নাও; আমি কাঁটাগুলো বেছে দিচ্ছি।"