-"কি ব্যাপার?তিন বছর পর আজ হঠাৎ কল করে এখানে আসতে বললে যে?" -"এই প্রশ্নের উত্তর তো রাত ১২টায় পেয়েছ।" -"(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) তিন বছর পর মনে করার আর কি দরকার ছিল বল।মাঝখানে এরকম আরও অনেক দিন অনেক সময় পার হয়ে গেছে।তখন তো ডাকনি।রাত ১২টায় আমাকে আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাওনি। গত মাসে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী গেল।সেটা না হয় বাদই দিলাম।কারণ মাঝখানে তিন বছর তো আর শুভেচ্ছা পাইনি।আজ হঠাৎ ডেকে মিছেমিছি মায়া বাড়িয়ে কি লাভ বল।" -"আমার উপর তোমার অনেক রাগ-অভিমান তাইনা?" শম্পা চুপ করে মাথা নিচু করে রইল।হয়ত এই কথা শুনে ওর চোখ দিয়ে অবিরাম বর্ষণ শুরু হবে। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে শম্পা আর আমান দুজন দুজনকে ভালবেসে পালিয়ে বিয়ে করে।তখন তারা অনার্সের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করত।দুজন একই ক্লাসের হওয়ার কারণে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে তাদের মধ্যে। প্রথমে তাদের পরিবার তাদেরকে মেনে নিতে রাজি হয়নি।কিন্তু পরে তাদেরকে মেনে নেয়।বেশ সুখে-শান্তিতেই তাদের দিনগুলো যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে প্রায় পাঁচ বছর কেটে যায়।সবাই শম্পা আর আমানকে বলে বাচ্চা নেয়ার জন্য।কারণ বিয়ের পর তারা অনার্স,মাস্টার্স গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে।আমান একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি পায়।তাদের আর কোনো ঝামেলা,চিন্তা নেই তাই সবার সাথে দুজনেরও অনেক ইচ্ছে একটি ফুটফুটে সন্তানের।শম্পা এবং আমান দুজনই দুই পরিবারের একমাত্র সন্তান তাই সবারই আশা নাতি বা নাতনির মুখ দেখবে। এর মাঝে শম্পার একটি বড় অসুখ হয়।অপারেশন না করলে পরবর্তীতে শম্পাকে বাঁচানো সম্ভব নাও হতে পারে।তাই শম্পাকে অপারেশন করানো হয়।তবে এই অপারেশনের পর শম্পা আর কোনোদিন মা হতে পারবেনা এই কথাও ডাক্তার আমানকে অপারেশনের আগেই জানিয়ে দেয়। কিন্তু শম্পাকে এই কথা জানাতে ডাক্তার না করে দিয়েছে।কারণ শম্পা এত বড় সত্যিটা মেনে নিতে পারবেনা।শুধু শম্পা কেন,কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারবেনা তার মা না হওয়ার ব্যর্থতা। আমান যখন এই কথাটি তার বাসার এবং শম্পার পরিবারকে জানাল,তখন সবাই অনেক কান্নাকাটি করল।শম্পাকে কিছু বলবেনা বলে সবাই কথা দেয়। কিন্তু আমানের মা এই কথা শোনার পর থেকেই শম্পার সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করল।আমান যখন অফিসে যায়,তখন মাত্রাতিরিক্ত খারাপ ব্যবহার করে।আমানের বাবা নিষেধ করা সত্ত্বেও খারাপ ব্যবহার করেই যায়।শম্পা কিছুই বুঝতে পারেনা তার শাশুড়ি তার সাথে হঠাৎ এরকম আচরণ করছে কেন।আমানকেও কিছু বলেনা সংসারে অশান্তি হবে এই ভেবে। একদিন আমানের মা শম্পাকে বলেই দেয় শম্পার মা না হওয়ার কথা।শম্পা শুনেতো আকাশ থেকে পড়ল।নিজের কানে কথাটি বিশ্বাস করতে পারলনা।আমান অফিস থেকে আসার পর শম্পা আমানকে জিজ্ঞেস করে।আমান তো রেগে গিয়ে তার মা,বাবাকে জিজ্ঞেস করতে যায়।শম্পা বাধা দেয়।আমানকে শত অনুরোধ করার পর আমান যখন সত্যিটা বলে,শম্পা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এরপর থেকে শুরু হয় আমানকে বিয়ে করানোর চাপ।আমানের মা প্রতিদিন আমানকে বলে শম্পাকে ডিভোর্স দিয়ে তার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে।আমান কিছুতেই রাজি হয়না।কিন্তু তার মা যখন এক প্রকার জোর করে,কান্নাকাটি করে আমানকে তার কসম খাওয়াল তখন আমান আর কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে রাজি হল। -"আমান!!!!!" -"হুমম?" -"তোমার প্রিয় খাবার বিরিয়ানি রান্না করে নিয়ে এসেছি।" আমান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শম্পার দিকে।মেয়েটি এখনও তাকে ভালবাসে।ভালবাসা না থাকলে আজ এত বছর পর তার প্রিয় মানুষের প্রিয় খাবার রান্না করে নিয়ে আসতনা। -"(অবাক হয়ে) কি হল?ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?নাও খেয়ে নাও।" -"(বিরিয়ানি নেয়ার পর) একটা কথা বলব?" -"হুমম বল।" -"তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ।চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।আগের মত আর নেই তুমি।" -"(মুচকি হেসে) তাই?হতে পারে।" -"তোমার হাজবেন্ড কি করে?" -"হাজবেন্ড!!!!!! হাহাহা!!!! আমিতো বিয়েই করিনি।হাজবেন্ড আসবে কোথা থেকে? হাহাহা!!!!" এই কথা শুনে আমান চুপ করে রইল। -"(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) আমান!!!!!! আমি শুধু তোমাকে ভালবেসেছি।আজও ভালবাসি।আর ভালবেসেই যাব।আমি জানি তুমি বাধ্য হয়ে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছ।কিন্তু তুমি তোমার মাকে আরও শক্তভাবে বোঝাতে পারতে।কিন্তু তুমি বোঝাওনি।হয়ত তুমিও মনে মনে এটিই চেয়েছিলে।আর চাইবেই বা না কেন,সবারই তো ইচ্ছে করে তার সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনার। কিন্তু আমি তোমার ইচ্ছেপূরণে অক্ষম ছিলাম।তোমার জীবনে নতুন কেউ এসে তোমার ইচ্ছেপূরণ করেছে।তুমি বাবা ডাক শুনেছ।কিন্তু আমি?এই হতভাগিনী তো কখনও মা ডাক শুনবেনা।আমাকে ডিভোর্স দেয়ার আগে একটিবারও ভেবেছ এই অসহায় মেয়েটি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে?কিভাবে বাঁচবে? (কাঁদতে কাঁদতে) একজন নারীর সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে তার মা না হওয়ার ব্যর্থতা।আমিতো মা হতে পারলামনা।আর তার সাথে আমার ভালবাসার অধিকার,ভালবাসার মানুষকে,ভালবাসাকেও হারিয়ে ফেলেছি। (আমানের দিকে তাকিয়ে) তোমার মনে পড়ে যখন পৃথিবীর সব বাধাকে উপেক্ষা করে আমারা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম?দীর্ঘ পাঁচ বছরের আমাদের সংসার জীবনের স্মৃতি?আমাদের ভালবাসা?নাকি সব ভুলে গেছ?হয়ত ভুলে গেছ।এসব মনে রেখেই বা কি লাভ বল।তোমার জীবনে আজ অন্য কেউ।কিন্তু আমিতো ভুলিনি।ভুলতে পারিনা।প্রতি মুহূর্তে স্মৃতিগুলো আমার হৃৎপিন্ডে,কলিজায় আঘাত করে। আচ্ছা,আমাকে ডিভোর্স না দিয়ে তোমার কাছে রেখে একটু ভালবাসা দিতে পারতেনা?আমাকে আলাদা না করে বিয়ে করতে।আমিতো না করতামনা।অন্তত তোমার কাছে তো থাকতাম।আর তোমার সন্তানকে না হয় একটু আদর করতাম।" শম্পা খেয়াল করল আমান কাঁদছে। -"সেকি!!!!! তুমি কাঁদছ কেন?তোমার তো সুখের দিন।(চোখের পানি মুছতে মুছতে) এই দেখ আমি কাঁদছিনা।ইশশশ!!!!!! বিরিয়ানি শেষ করে দিলে?তুমি খাইয়ে দিবে ভেবে আমি খেয়ে আসিনি।আচ্ছা সমস্যা নেই।এই তিন বছর একা একা খেয়েছি।বাকি জীবনটাও একা একা খেতে পারব। জানো,এখন আমি একটি স্কুলে চাকরি করছি।ইচ্ছে করলে ভাল বেতনের চাকরি করতে পারতাম।কিন্তু আত্মতৃপ্তি পেতাম না।এখন আমার স্কুলের সব বাচ্চারাই আমার সন্তান।আমাকে ভালবেসে ম্যাম মণি ডাকে।কি যে ভাল লাগে শুনতে।মামণি ডাক শোনার ভাগ্য তো আর হলনা।তাই ম্যাম মণি ডাক শুনেই মা ডাক শোনার কষ্টটুকু দূর করার চেষ্টা করি।" -"শম্পা!!!!!" -"হুমম বল।" -"আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।এই বেলী ফুলের মালাটা তোমার জন্য এনেছি।তোমার জন্মদিনের প্রিয় উপহার।" শম্পার তখন ইচ্ছে করছিল আমানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমানের বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে।কিন্তু অনেক কষ্টে শম্পা নিজেকে সামলিয়ে নিল। -"আমাকে ক্ষমা কর আমান।আমি তোমার দেয়া উপহার নিতে পারবনা।" -"(অবাক হয়ে) কেন?" -"কারণ তোমার স্মৃতি বুকে নিয়ে অনেক কষ্টে বেঁচে আছি।এই বেলী ফুলের মালা সেই স্মৃতিগুলোর সাক্ষী হয়ে থাকবে।তখন আমার আরও বেশি কষ্ট হবে।সহ্য করতে না পেরে হয়ত........." আমান হতাশ হল।সে সযত্নে তার পকেটে মালাটি রাখল। -"তাহলে এটি আমার কাছেই থাক।" -"না আমান।তুমি তোমার বউকে দিও।সে অনেক খুশি হবে।আর হ্যাঁ,তোমার ছেলে কিন্তু তোমার মতই সুন্দর হয়েছে মাশা আল্লাহ্!!!!!! প্লিজ জিজ্ঞেস করনা কিভাবে দেখেছি।সেটি না হয় নাই বা জানলে।বাসায় যাও আমান।তোমার জন্য তোমার বউ,ছেলে অপেক্ষা করছে।আর এই নাও,তোমার ছেলের জন্য চকলেট এনেছি।" -"(অবাক হয়ে চকলেট নিতে নিতে) আর তুমি?" -"(ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) আমি একটু পরে যাব।আমার জন্য বাসায় তো আর কেউ অপেক্ষা করছেনা।" আমান নিজেকে অপরাধী ভেবে মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকে।আর শম্পা আমানের চলে যাওয়া দেখে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে।