আমি অবন্তি। ঢাকা সিটি কলেজে পড়ি। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে চট্টগ্রামে ৫ দিনের ট্যুরে যাচ্ছি। আম্মু-বাবা প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না, কেনোনা কখনো বাসা থেকে দূরে আম্মু-বাবাকে ছাড়া কোথাও যাইনি। আর আমি একটু বেশি রাগী। অল্পতেই মাথায় রক্ত উঠে যায়। কম কথা বলি,অমিশুক। এজন্য না করছিলো। আমি আম্মু-বাবাকে বুঝালাম আমি নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে রাখবো। তবুও ভরসা পাচ্ছিলো না। তখন আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড নিশি রাজি করালো। আমার ডিপার্টমেন্টে আমার একমাত্র ফ্রেণ্ড নিশি। কারো সাথেই খুব একটা কথা বলি না। আর ওরাও খুব একটা মিশে না আমার চুপচাপ স্বভাবের জন্য। তবুও যে নিশি কিভাবে আমার বেস্টফ্রেণ্ড হলো সেটা ভাবলে অবাক লাগে। আমি গতকাল রাতেই ব্যাগ প্যাক করে রেখেছি, তবুও বের হতে আমার প্রতিবারের মতোই লেট হলো। কোথাও যেতে নিলে আমি লেট করবোই,এটা মনে হয় আমার স্বভাব হয়ে গিয়েছে। এদিকে নিশি বার বার ফোন করেই যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি প্রথম বাস একদম ভর্তি। আর ওটা তে নিশি বসে আছে। ---স্যরি রে,তোর জন্য জায়গা রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু জায়গা রাখতে দেয়নি। তুই কিছু মনে করিস না রে। ---আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দ্বিতীয় বাসের দিকে গেলাম। বাসে উঠে দেখি সব সিটেই কেউ না কেউ বসে আছে। একটা মাত্র সিটই ফাঁকা আর জানালার ধারের সিট টাতে একটা ছেলে বসে আছে। ছেলেটার চোখে চশমা। হাতে গিটার। চেহেরার মাঝে কেমন যেন বাচাল বাচাল ভাব। ছেলেটা কে তো কখনো দেখিনি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের না। নিশ্চয় আমাদের ডিপার্টমেন্টের কারো ফ্রেণ্ড হবে। আমি সিট টার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ---এই যে শুনছেন? আমার ডাক শুনেও কোনো উত্তর দিচ্ছিলো না। রাগ লাগছিলো। আমি আবার ডাকলাম তাও উত্তর দিচ্ছিলো না। আমি এক পর্যায়ে রেগে গেলাম। ---এই তোমার সমস্যা কি? এতক্ষণ ধরে ডাকছি তবুও উত্তর না দিয়ে ভাব নিচ্ছো কেনো? ---এতক্ষণে মনে হলো আমায় ডাকছো। আমায় কি তোমার আঙ্কেল লাগে যে আপনি করে ডাকছিলে? অনেকটা রেগেই উত্তর দিলাম ---শুধুমাত্র আপনি ডাকার জন্যই আমার ডাকের উত্তর দাও নি? নিজেকে কি ভাবো? ---আপাতত নিজেকে প্রিন্স চার্মিং মনে হচ্ছে। আমি মনে মনে বলছিলাম আসলেই আজব। এই কিম্ভুত কিমাকার এর পাশে বসে আমায় যেতে হবে। বুঝতে পারছিলাম পুরোটা সময় ও আমার মাথা খাবে। --- তো মহারাণী আমায় ডাকছিলে যে,কিছু বলবে? আমি কোনো উত্তর দিচ্ছিলাম না। আমি মোটামুটি শিওর যে ওরে বললে কখনোই আমায় জানালার ধারে বসতে দেবে না। উল্টো আরও ভাব নিবে। তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ---কি হলো মহারাণী? চুপ হয়ে গেলে যে? ---এই ছেলে,এতো মহারাণী মহারাণী বলে ডাকো কেনো? আমার নাম কি মহারাণী? (অনেকটা রেগে গিয়ে) ---তোমার নাম মহারাণী নাকি অন্য কিছু,আমি কেমনে জানবো? ---আসলেই আজব। ---ও তোমার নাম কি তাহলে? মেডাম ফুলি, কাজল লতা নাকি অনিন্দিতা? কোনটা বলে ডাকবো মহারাণী? ওর বক বকে আমার রাগ লাগছিলো। আমি বললাম---অবন্তি, এটাই আমার নাম। এখন শান্তি তো? ---হুম শান্তি। বাই দ্যা রাস্তা আমি ফারাবী। ---আমি কি জানতে চেয়েছি? ---তুমি না জানতে চাইলেও আমি বলতে চেয়েছি। এটা বলে ও হাসছিলো। আমি অবাক হয়ে ওর হাসি দেখছিলাম। কারো হাসি এমন সুন্দর হয় জানা ছিলো না। আমি ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বাস চলছে। আর ফারাবী একটানা বক বক করেই যাচ্ছে। আমার একটু খারাপ লাগছিলো কেনোনা সব সময় জানালার পাশে বসে অভ্যাস। ফারাবী আমার দিকে তাকিয়ে আমায় অবাক করে দিয়ে বললো--- খারাপ লাগছে বুঝি? আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। ও নিজে থেকেই আবার বললো---এক কাজ করো,একটু বের হওতো। ---কেনো? ---বের হও,কাজ আসে। তারপর বলছি। আমি সিট থেকে সরতেই ও বের হয়ে এলো আর আমায় বললো--- যাও জানালার ধারে গিয়ে বসো। আমি পুরোই অবাক। ও আবারো বললো---যাও জানালার ধারে বসো,ভালো লাগবে। আমি হ্যা সূচক মাথা নেড়ে জানালার ধারে বসলাম। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থ্যাংস বলতে নিবো, ঠিক তখনি ও বলে উঠলো--- থ্যাংস বলতে হবে না মহারাণী। আমি ফারাবীকে বললাম---তোমায় থ্যাংক ইউ বলতে বয়েই গেছে,হাহ্। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি এই ফারাবী এতো কথা কেমনে বলে। আর আমার পিছে এতো লাগছে। উফ্, একদম অসহ্য। ফারাবী কখনো গান গাইছিলো তো কখনো বাসের অন্য সবার সাথে বক বক করছিলো। আমি ভাবছিলাম ফারাবী এতো মিশুক কেনো। বাহির থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আমার চোখে মুখে লাগছিলো। খুব ভালো লাগছিলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম ফারাবী আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমার খোলা চুলগুলি ওর মুখে উড়ে লাগছে। ---ও সরি,খেয়াল করিনি আমার চুলগুলি তোমার মুখে লাগছে। এটা বলেই খোপা করতে নিলাম। ফারাবী আমায় অবাক করে দিয়ে বললো---থাক না চুল গুলো খোলা, ভালোই লাগছে তো। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চুল গুলি বেঁধে ফেললাম। ফারাবীকে দেখে মনে হলো ও কিছুটা মন খারাপ করে আছে। আমি বুঝতে পেরেও অবুঝ থাকলাম। এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি। ঘুম ভাঙলো গাড়ি থামাতে। তাকিয়ে দেখি আমি ফারাবীর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছিলাম। আমি অনেক লজ্জা পাচ্ছিলাম। ---সরি, ফারাবী। বুঝতে পারিনি কখন ঘুমিয়ে তোমার কাঁধে মাথা... এতোটুকু বলতেই ফারাবী আমার কথা শেষ না হতেই বললো---চুপ,সরি বলতে হবে না। তুমি তো আর ইচ্ছা করে মাথা রাখোনি। ---আমায় ডাক দিলেই তো জেগে যেতাম। ---ঘুম থেকে তোমায় জাগাতে ইচ্ছা করলো না তাই ডাকিনি। ফারাবী বাস থেকে নামলো। এদিকে নিশি জানালার ধারে এসে বললো---কিরে অবন্তি,বাস থেকে নামার ইচ্ছা নেই নাকি? ---হুম নামছি। নির্ধারিত রুমে গিয়ে আমি আর নিশি রেস্ট নিচ্ছি। আম্মু-বাবাকে ফোন দিয়ে পৌঁছানোর কথা জানিয়ে দিলাম। আমাদের হোটেল টা সমুদ্র সৈকতের পাশেই। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিলাম। আমি বেলকুনিতে গিয়ে দাড়িয়ে আছি। আকাশে চাঁদ উঠেছে। সমুদ্রের ঢেউ এর ওপর চাঁদের আলোর প্রতিফলন- সে অসাধারণ এক দৃশ্য। মনে হচ্ছে সারাটা জীবন এমন মনোরম দৃশ্য দেখে পার করে দেই। চারিদিকে ঠাণ্ডা বাতাস। বাতাসে আমার চুল গুলি উড়ছে, হুট করেই ফারাবীর কথা মনে পড়ে গেলো। ও বলেছিলো খোলা চুলে নাকি আমায় ভালো লাগে। এটা মনে হতেই লজ্জা লাগছিলো। হঠাৎ গীটারের আাওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু দূরে বন ফায়ারের সামনে একটা ছেলে গীটার হাতে বসে আছে। ছেলেটা উল্টো দিক হয়ে বসে আছে,এজন্য ওর চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। সুর শুনেই বুঝতে পারলাম কণ্ঠটা চেনা। ও গান গাইছে--- "আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না... চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না" ফারাবী আসলেই সুন্দর গায়। আর চাঁদের আলোয় ওর গান শুনতে বেশ ভালো লাগছে। আমি নিশি কে বললাম চল না কাছে গিয়ে গান শুনি। ওকে সাথে করে ফারাবীর সামনে গেলাম। ও আমায় দেখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। ---এই অবন্তি তোমার রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ,তাই না? আমি আবার ও অবাক হলাম, ও কিভাবে জানলো যে আমার রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রিয়। ও আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে ও আমার পছন্দের গান টা গাওয়া শুরু করলো--- "তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম তুমি রবে নীরবে... নিবিড়ও নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী সম... তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম তুমি রবে নীরবে" ও কীভাবে জানলো এটা আমার প্রিয় গান? হয়ত কাকতালীয় ভাবে এটা গেয়েছে। রাতে ডিনার করে নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। রাত চারটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি নিশি কে ডাকলাম ---চল না সমুদ্র সৈকতে হাটি। নিশি ঘুমের ঘোরে উত্তর দিলো---তুই পাগল হয়ে গেছিস অবন্তি, এতো রাতে কে হাটে বলে আবার ঘুমিয়ে গেলো। আমি মন খারাপ করে বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। দূরে অল্প কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে কিন্তু একা একা বের হতে ভয় পাচ্ছিলাম। দূর আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছি আমি। ---এই যে মহারাণী, এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছো যে? আমি ফারাবীর ডাকে চমকে উঠলাম। ---তু...তুমি? এখানে? ---ঘুম আসছিলো না মহারাণী। তাই ভাবলাম একটু হাটাহাটি করি বাহিরে। তখন তোমায় দেখতে পেলাম। ভালোই হলো। একা একা হাটার চেয়ে তোমার সাথে হাটা যাবে আর গল্প করা যাবে। ---এই তুমি আমায় মহারাণী কেন ডাকো? ---তোমায় এটা বলে ডাকতে ভালো লাগে তাই। এখন চলো সমুদ্র সৈকতের বালি তে খালি পায়ে হাটি। আমি ভাবছি যাবো কি যাবো না? ---কি হলো? যাবে না আমার সাথে? (মন খারাপ করে বললো) আমি কেনো যেনো ফারাবীকে না করতে পারলাম না। আর সত্যি বলতে আমারও খালি পায়ে হাটতে ইচ্ছা করছিলো। ভোর হলেই তো মানুষজনে ভরে যাবে। তখন ভীরের মাঝে এতোটা ভালো লাগবে না। আমি ফারাবীর পাশে হাটছি। এই প্রথম কোনো অচেনা মানুষের সাথে এভাবে হাটছি। এটা সম্পূর্ণই আমার স্বভাবের বিপরীত। আমি তো কোনো ছেলে কে আমার পাশে দাড়াতেও দেই না। কিন্তু কেন যেন ফারাবীর পাশে হাটতে বেশ ভালো লাগছে। আমি শুধু ওকে একদিন ধরে চিনি। তাও এমন হচ্ছে কেন? আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ফারাবী বলে উঠলো কি হলো মহারাণী,চুপ কেনো? ---একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তোমায়? ---হুম বলো,এতো ফরমালিটির কি আছে? ---তুমি কিভাবে জানলে রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার অনেক ভালো লাগে? ফারাবী আমার দিকে তাকিয়ে আবার একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো---এক মিনিট,এখানে দাড়াও,আসছি। এটা বলে ফারাবী দৌড়ে একদম ঢেউ এর কাছে চলে গেলো। আমি ভাবছি ও ওদিকে কেনো গেলো। ও কি যেনো নিলো ওখান থেকে। তারপর দৌড়ে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বললো---তোমার হাতটা দাও তো। আমি অবাক হয়ে ---কেনো? ---আরে দাও তো,এতো কথা কেনো বলো? ---আমি বেশি কথা বলি নাকি তুমি বেশি কথা বলো? ---হুম হইছে,দাও তোমার হাত দাও। আমি তাও হাত দিচ্ছিলাম না। ও জোর করেই আমার হাতটা ধরলো। আমি রেগে তাকালাম। ---ও বললো,একদম রাগ করতে হবে না। তোমায় যেটা দিবো,এটা দেখলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। ও আমার হাতে একটা শামুকের খোলক দিয়ে বললো---আমি জানি শামুকের এমন অনেক খোলক কিনতে পাওয়া যাবে কিন্তু সমুদ্রতট থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এই শামুকের খোলক টা সব সময় তোমায় আমার কথা মনে করিয়ে দেবে। এটা বলেই ও আবার সেই রহস্যময় হাসি দিলো। আমি ওকে নিয়ে না ভেবে শামুকটা দেখছিলাম। শামকুটা আসলেই অনেক সুন্দর। এদিকে সূর্যোদয় হচ্ছে। অসাধারণ এক দৃশ্য। এর কয়েকটা ছবিও তুলে ফেললাম। এর মাঝে নিশি চলে আসলো। ---কি রে অবন্তি,তোকে কখন থেকে খুঁজছি আর তুই এখানে। ---তোরে তো ডেকেছিলামই কিন্তু তুই ঘুমের জগৎ থেকে বের হলে তবে তো প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করবি। ---আচ্ছা নে চল সমুদ্রের শীতল পানিতে পা ভেজাই। ---হুম চল। হঠাৎ ফারাবীর কথা মনে হলো। পাশে তাকিয়ে ওকে দেখতে না পেয়ে রাগ লাগলো, কেমন ছেলে! যাওয়ার সময় বলেও যেতে পারে না। ওর কথা ভাবা বাদ দিয়ে সমুদ্রতট দিয়ে হাটছি। পায়ের ওপর ঢেউ আছড়ে পড়ছে, তখন মনে হয় পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর রুমে গিয়ে গোসল করে নাস্তা সেরে সবাই শীতাকুণ্ড সুপ্ত ধারা ঝর্ণা দেখার জন্য রওনা দিলাম। এবার বাসে নিশি আমার পাশে আর সামনের সিটে ফারাবী বসে আছে। পুরাটা সময় ও ঘুড়ে আমার মাথা খেয়েছে আর নিশির সাথে বক বক করেছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে বাস থেকে আমাদের নামতে হলো। অটো তে করে যেতে হবে। আমি, নিশি, ফারাবী, রনি এক অটোতে উঠলাম। ফারাবী চারপাশ দেখা বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। মনে হচ্ছে ওরে ধরে আছাড় লাগিয়ে দেই কিন্তু কোনো রিয়াক্ট করলাম না রনি আর নিশির জন্য। শুধু চোখ গরম করে তাকালাম। কিন্তু দেখে মনে হলো ও মজা পাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময় পর পৌঁছে গেলাম শীতাকুণ্ড ঝর্ণার কাছে। এখন পায়ে হেটে যেতে হবে। উচু নিচু রাস্তায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে অনেক। মনে হচ্ছে পড়ে যাবো। একবার তো পড়ে যেতেই নিলাম। কিন্তু ফারাবী হাতটা ধরে ফেললো। আমি থ্যাংক্স বলার আগেই ও বললো থ্যাংক্স বলতে হবে না মহারাণী ,একটু সাবধানে হাঁটলে কি হয় তোমার। ---আমি কি ইচ্ছা করে পড়েছি নাকি। ---এতো কথা কেনো বলো। চুপ করে নিশির হাত ধরে হাটো। ---কেনো? ---নিশি,অবন্তির হাত ধরে হাটো। তোমার বান্ধবী তো ছোট পিচ্চি, যে কোনো সময় পড়ে যাবে। ---কারো হাত ধরবো না আমি। (রেগে বললাম) ফারাবী কিছু না বলে আমার হাত ধরে হাটছিলো। ---আমার হাত ছেড়ে দাও। ---ছাড়বো না। পড়ে গেলে তখন বুঝবা। ---পড়লে পড়বো,তোমার কি? ---আমার অনেক কিছু। ---কি? কি বলতে চাও তুমি? ---বুঝতে পেরেছি তো আমি। তুমি চাও পড়ে গিয়ে তোমার হাত-পা ভাঙ্গুক আর তোমার যত্ন আমি নেই। বললেই তো হয়,ফারাবী তুমি প্লীজ আমায় দেখে রাখো। এর জন্য হাত-পা ভাঙ্গার কি দরকার। এটা বলে ফারাবী হাসতে লাগলো। আমি রেগে গেলাম। ---কি বললা তুমি? তুমি এতো পাজি কেনো? আমি কখন এটা বললাম তোমায়? ---এই যে হাত ধরে হাটছো না। এর মানে তো এটাই হচ্ছে। আমি কিছু আর বললাম না। রেগে তাকিয়ে আছি। ---রেগে তাকাতে হবে না। চলো এখন। ঝর্ণার কাছে আমরা পৌছে গেছি। আমি গিয়েই ঝর্ণার কয়েকটা ছবি তুললাম। এখন ঝর্ণার পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছি। খুব ভালো লাগছে। পানির দিকে তাকিয়ে দেখি কেমন যেন লালচে দেখা যাচ্ছে। ফারাবী পাশেই ছিলো। --- পা তুলো বলছি। ---কেনো? ---মনে হয় পায়ে জোঁক লেগেছে। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম। ---একদম ভয় পেতে হবে না। আমি আছিতো। পা তুলতে দেখি পায়ের পাতায় একটা জোঁক লেগে আছে। আমি ভয় পেয়ে কান্না করছিলাম। ---একদম ভয় পাবা না। কিছুই হয়নি তোমার। আমি তাও ভয় পাচ্ছিলাম কেনোনা আমি পোকা মাকড় দেখে মারাত্মক ভয় পাই। ফারাবী একটা কাঠি দিয়ে জোঁক ছাড়ালো। আমাদের ব্যাচের স্কাউটের কাছে ফার্স্ট এইড বক্স থাকে। ওর থেকে স্যাভলন এনে দিলো। আমি স্যাভলন লাগালাম। --- থ্যাংক্স ফারাবী। ---কেনো? ---আমায় সব সময় সাহায্য করবার জন্য। ---এর জন্য কি থ্যাংক্স বলতে হয় নাকি মহারাণী। আচ্ছা চলো এখন ফেরা যাক। রাতে বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। ফারাবী এসে পাশে দাড়ালো। মনে হলো ও কিছু বলতে চায়। ---কিছু বলবে ফারাবী? ---হুম। ---বলে ফেলো। ---আমার সাথে কি একটু হাটবে? আমি ভাবছিলাম ফারাবীকে কি উত্তর দিবো? ওর সাথে কি যাবো? যাকে আমি মাত্র দুদিন হলো চিনি। তবে আমি এতোটা জানি,ফারাবী আশেপাশে থাকলে অনেক নিরাপদ ফিল করি। ওর দুষ্টামি গুলি অনেক ভালো লাগে। আমায় সব সময় জ্বালায় কিন্তু সব সময় পাশে থাকে। ---কি হলো? যাবে না? ---হুম চলো। আমি আর ফারাবী সমুদ্রতটে বালুর মাঝে বসে আছি। আকাশে চাঁদ মেঘের মাঝে লুকোচুরি খেলছে। কখনো কখনো চাঁদের আলো ফারাবীর মুখে পড়ছে। ফারাবীকে অনেক সুন্দর লাগছে। চেহেরাটা একদম মায়া মায়া। একটু পরেই মনে হলো আমি ফারাবী কে নিয়ে ভাবছি কেনো? কেমন যেন নিজের ওপর রাগ লাগছিলো। ফারাবীকে কিছু না বলেই উঠে চলে আসছিলাম। ---কি হলো মহারাণী? আমার ওপর কি রাগ করেছো? এভাবে চলে যাচ্ছো যে? ---কিছু না। ঘুম পাচ্ছে। এটা বলে রুমে চলে আসলাম। পরেরদিন ভোরে রওনা দিলাম সব কুয়াকাটা সমুদ্র বন্দরের দিকে। ওখান থেকে সূর্যোদয় দেখা এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। ফারাবী আজও আমায় কিছু ভিন্নরকম শামুক দিলো। এতো সুন্দর শামুক ও নিজের কাছে রাখলেও তো পারতো। সব আমায় দিয়ে দিলো। ---ফারাবী শোনো? ---হ্যা মহারাণী বলো,তোমার কথা শুনবার জন্য আমি সব সময়ই প্রস্তুত। --- এই তুমি এভাবে কথা কেনো বলো? সব মেয়েদের সাথেই বুঝি এভাবে কথা বলো? ---না তো,সব মেয়ে আর তুমি তো এক না। ---মানে? ---কিছু না। কি যেন বলতে চাইলে আমায়? ---ও হ্যা, তুমি সব সুন্দর শামুক আমায় দিয়ে দিলে যে? তুমি কিছু রাখবে না? ---তোমার কাছে থাকা মানেই আমার কাছে থাকা। এটা বলেই ও আগের মতো হাসলো। ---তুমি এতো রহস্যময় কেনো? ও কিছু না বলে ছবি তুলবার বাহানা করে চলে গেলো। আমিও এটা নিয়ে না ভেবে চারপাশের সৌন্দর্য দেখছিলাম। আশেপাশের জায়গায় ঘুরে আমরা সবাই বিকালের মাঝেই ফিরে আসলাম। ফারাবী আমায় ডেকে বললো--- একটু আমার সাথে আসো? ---কেনো? ---একটা জায়গা দেখাবো। প্লীজ না বলবা না। ---আচ্ছা চলো, দাড়াও নিশি কে ডেকে নেই। নিশি আর আমায় নিয়ে সমুদ্রতট থেকে একটু দূরে টিলার মত একটা ছোট্ট জায়গায় নিয়ে গেলো। আসলেই জায়গাটা অসাধারণ। দূরে সমুদ্রতট ও দেখা যাচ্ছে। ফারাবী বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ---বার বার ঘড়ির দিকে কেনো তাকাচ্ছো? --- ৫টা মিনিট অপেক্ষা করো। নিজেই বুঝতে পারবে। আমি চারপাশের ছবি তুলছিলাম। ফারাবী বললো---মহারাণী,এখনি সমুদ্রকূলের দিকে তাকাও। আমি তাকিয়ে দেখি সূর্যাস্ত হচ্ছে। এতো সুন্দর। ছবি তুলতে ভুললাম না। ---কেমন লাগলো মহারাণী? ---অসাধারণ। তোমায় এতোগুলি থ্যাংক্স দিলেও থ্যাংক্স কম পড়বে। ---থ্যাংক্স দিতে হবে না। তুমি সব সময় এমন হাসি খুশি থাকো,এটাই চাই। এর জন্যই তো তোমায় এখানে নিয়ে এসেছি। রাতে আমরা সবাই ডিনার করে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। আজ রাতেই খাগড়াছড়ির সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। মেঘপুঞ্জি নামক রিসোর্টে একদিনের জন্য বুকিং দেয়া হয়েছে। বাস চলছে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। নিশি বার বার জানালা চাপায় দিতে বলছে কিন্ত আমার ইচ্ছা করছে না। নিশি হুট করেই ফারাবীকে বললো--- তোমার সাথে সিট বদলাতে পারি? ফারাবী এক কথায় রাজি। ---এই নিশি,সিট বদলাবি কেন? ---তোর জ্বালায়। রাতে এমন ঠাণ্ডা বাতাস লাগলে আমার গলা বসে যাবে। ---আচ্ছা আমি জানালা বন্ধ করে দিচ্ছি। ---বন্ধ করতে হবে না। আমি পাশের সিটেই বসবো তো। ফারাবীটা এসে আমার পাশে বসলো। ---এই তুমি নিশি কে না করলা না কেনো? ---কেনো না করবো মহারাণী? ---ধ্যাত,ভালো লাগে না। ফারাবীর সাথে কোনো কথা না বলে ঘুমায় গেলাম। এমন ঝাকুনি খেলাম যে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মেজাজ টাই খারাপ। বাইরে তাকাতেই দেখি পূর্ণিমার আলো। রাগ কমে গেলো। আবার এক ঝাকুনি। সামনের সিটের সাথে মাথায় ধাক্কা খেতে নিলাম কিন্তু ফারাবী হাত দেয়ায় ওর হাতের ওপর মাথা পড়লো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ও আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো।ওর হাসি দেখে মনে হলো ও বুঝাতে চাইলো যে ও থাকতে আমার কোনো কষ্ট হবে না। আমি ফারাবীকে যতই জানছি,ততই অবাক হচ্ছি। ওর প্রতি বিরক্তের বদলে ভালো লাগা বাড়ছে। রিসোর্টে আমরা পৌঁছে গিয়েছি। রিসোর্টটা আসোলেই সুন্দর। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সাজেক ভ্যালিতে পৌঁছে বুঝলাম কেনো একে দার্জিলিং এর সাথে তুলনা করা হয়। এত সুন্দর জায়গা হতে পারে তা আমার কল্পনার বাহিরে। মনে হচ্ছে মেঘ ছুঁতে পারবো। ফারাবী পাশে এসে দাড়ালো। ---কেমন লাগছে? ---অসাধারণ। মনে হচ্ছে সারাটি জীবন এখানে এভাবেই পার করে দেই। ---চলো তোমায় জায়গাটা ঘুড়ে দেখাই। ---তুমি আগেও কি এখানে এসেছো? ---হুম এসেছি। এজন্যই বলছি আমার সাথে চলো। আমি ফারাবীর সাথে সাজেক ভ্যালি আর তার আশেপাশে ঘুরে দেখছিলাম। ছবি তুলছিলাম।ফারাবী আমার দিকে তাকিয়ে আছে চারপাশের মনোরম দৃশ্য দেখা বাদ দিয়ে। ---কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো যে? ---ভাবছিলাম এই উচু পাহাড় থেকে যদি তোমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই,তখন কি হবে? এটা বলেই হাসতে লাগলো। আমি জানি ও দুষ্টামি করছে। ---তুমি কখনোই আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে না,আমি জানি। ---আমার ওপর এতো বিশ্বাস। আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে বললাম চলো বাকিদের কাছে ফেরা যাক। আমি ওকে কোনো উত্তর দিলাম না কিন্তু মনে মনে ভাবছি,আমি যে ছেলেকে মাত্র কিছুদিন হলো চিনি,তার প্রতি আমার এতো বিশ্বাস কেনো? এর কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না। সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে রিসোর্টে গিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ভোরে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমার পাশে নিশি বসে আছে। আজ আমাদের বাসে ফারাবী নেই। কেন যেন ফারাবীর বক বক,ওর দুষ্টামি মিস করছিলাম। মনে হচ্ছিলো ও যদি পাশে থাকতো। ফারাবীর ওপর খুব রাগ লাগছিলো। এ কয়দিন তো সব সময় আমার আগে পিছে থেকেছে, তাহলে আজ কেনো অন্য বাসে ওর যেতে হলো। ধ্যাত, মনে হচ্ছে ওর চুল ছিড়ে মাথা ফাটায় দেই। ---এই অবন্তি,কি হয়েছে রে তোর? এত চুপচাপ? মনে হচ্ছে রেগে আছিস? ---কই রেগে আছি। তোর এমনি মনে হলো। ---ও আচ্ছা। ---আমি একটু ঘুমাবো। এই বলে চোখ বন্ধ করলাম। ভালো লাগছিলো না কিছু। বার বার ফারাবীর কথা মনে পড়ছিলো। পুরো জার্নি মুড অফ ছিলো আমার। ঢাকায় পৌঁছে গিয়েছি। বাস থামতেই নামবার আগেই ফারাবী আমার জানালার ধারে এসে দাড়ালো। ওর হাতে একটা খাম। খামটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে --- মহারাণী, এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য গিফ্ট,এতো সুন্দর কিছু সময় আমায় দেওয়ার জন্য। আমি কিছু বলার আগেই জানালা দিয়ে খামটা দিয়ে আসি বলে দৌড়ে চলে গেলো। আমি ওকে আটকাতেও পারলাম না। ও চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে কি যেনো হারিয়ে ফেললাম। বাসায় পৌঁছে আম্মু-বাবাকে ট্যুরের কথা বর্ণনা করে রুমে চলে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে ফারাবীর কথা ভাবছি। হঠৎ ফারাবীর দেওয়া খামের কথা মনে পড়লো। খাম খুলতেই প্রথমে ছোট্ট একটা চিরকুট পেলাম। মহারাণী.... আমি জানি এ কদিন আমি তোমায় বড্ড বেশি জ্বালিয়েছি। তবে তোমার সাথে কাটানো সময় গুলি আমি সারা জীবন মনে রাখবো। আমার জীবনের সব থেকে সুন্দর স্মৃতি এই ট্যুর। স্যরি তোমায় বিরক্ত করবার জন্য। ইতি ফারাবী খামের ভেতর অনেকগুলি ছবি পেলাম। সব ছবি আমার। কোনোটা সূর্যোদয়ের সময় তুলেছে তো কোনোটা চাঁদের আলোয়। কোনোটাতে বাতাসের কারণে আমার অবাধ্য চুলের ছবি। প্রত্যেকটা ছবিই অসাধারণ। আমি অবাক হচ্ছিলাম। ও কখন ছবি তুললো? আমি বুঝতেই পারিনি। এখন নিজের বোকামির ওপর আফসোস হচ্ছে। ফারাবীর একটা ছবিও আমার কাছে নেই। আর না আমি ওর সম্পূর্ণ নাম বা পরিচয় জানি। ফারাবীর দেয়া শামুক গুলো ঘরে গুছিয়ে রেখেছি। সব সময় ফারাবীর কথা মনে পড়ে। ওর দুষ্টামিগুলি,ওর মহারাণী ডাকটা অনেক মিস করছিলাম। সব সময় মনে হতো এই বুঝি ফারাবী এসে বলবে---মহারাণী আমায় খুঁজছো? কিন্তু ও নেই। আমি বুঝতে পারছিলাম ফারাবী এ কদিনে আমার জন্য অনেক কিছু হয়ে দাড়িয়েছে। একটা সময় ছিলো যখন আমি হুমায়ন স্যারের নীলপদ্ম থিওরিতে বিশ্বাস করতাম না। উনি হিমুর নীলপদ্ম উপন্যাসে বলেছিলেন---"প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই পাঁচটা নীলপদ্ম থাকে। সেই নীলপদ্ম কেউ একটা দেয় তো কেউ একজনকেই পাঁচটা পদ্ম দিয়ে দেয়।" কিন্তু এখন আমি বিশ্বাস করি এটা। আমিও আমার সবগুলি নীলপদ্ম হঠাৎ পরিচিত হওয়া ফারাবীকে দিয়ে দিয়েছি। জানি না, ফারাবী আমায় ভালোবাসে কি না, ওকে ফিরে পাবো কি না কিন্তু সব সময় আমার মনের মাঝে ফারাবীই থাকবে আর সারা জীবন আমি ফারাবীকেই ভালোবেসে যাবো। [ বি.দ্র: আমি কখনো চট্টগ্রাম যাইনি। গুগল আর কিছু ফ্রেণ্ডের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে লেখা। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আরেকটা কথা,চলার পথে কাউকে হঠাৎ ভালো লাগতেই পারে বা কাউকে ভালোবাসতেই পারেন। তবে চোখ বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করবেন না। কেনোনা এখনকার সময়ে ভালো মানুষের মুখোশধারী কিছু খারাপ মানুষ আছে। তাদের থেকে সবাই সাবধানে থাকবেন। ]