বাবা মার অপদার্থ ছেলে হিসেবে পরিচিত শুভ। অনার্স শেষ করে একটা চাকরির চেষ্টা করতেছে ইদানিং সে। কিন্তু কপালে তার চাকরি জুটেনা। তাই বাবা বলে,
--তোর মতো অপদার্থের কপালে কখনো চাকরি জুটবেনা। বাবা একটা আছে, সারাজীবন বাবার ঘাড়ে চড়েই কাটিয়ে দিবি।"
.
"নিজের বাবা যদি এমন অভিশাপ দেই, তাহলে সারাজীবন কেন, সাত জনমেও চাকরি পাবেনা সে" মনে মনে এই কথা বলে শুভ,, কিন্তু মুখে বলে:-
--বাবা, চাকরি করতে গেলে হয় পূর্ব অভিঙ্গতা লাগবে, আর নয়তো অনেক টাকা ঘুষ দিতে হবে। আচ্ছা তুমিই বলো বাবা, মানুষ কি জন্মের সময় অভিঙ্গতা নিয়ে জন্মায়? সব চাকরি করতে যদি অভিঙ্গতা লাগে, তাহলে তো আমাদের মতো কেউ চাকরি পাবেনা, আগে চাকরিটা করতে দিলেই না তারপর অভিঙ্গতা হবে, চাকরি না দিলে অভিঙ্গতা হবে কেমনে? আর ঘুষ দিয়ে চাকরি করতে চাইলে তো তুমি টাকা দেবেনা......"
--কেন দেব টাকা? অনেক টাকা খরচ করে তোকে লেখাপড়া করিয়েছি কি ঘুষ দিয়ে চাকরি করার জন্য? একটা টাকাও দেবনা।
--তাহলে বাবা আমি ব্যবসা করব, টাকা দিও কিছু....
--ব্যাংকে কিছু টাকা জমা আছে, ঐগুলো তুলে ব্যবসা শুরু কর।
--ঠিক আছে বাবা।
.
.
রাতে শুভর বাসায় খবর এল, শুভ মারাত্মকভাবে জখম হয়ে হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেরার সময় ছিনতাইকারীর হাতে পড়েছিল সে। পেটে ছুরি বসিয়ে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে ওরা।
.
.
শুভর বাবা জমি বিক্রি করে শুভর অপারেশন করল। সুস্থ হওয়ার পর বাসায় যখন ফিরল, তখন বাবা বলল:
--তুই শুধু অপদার্থই নই, তুই একটা অপয়াও। তুই আমাকে পথে বসায় দিলি।"
.
শুভ কিছু বললনা, নিরবে ভেতরে চলে গেল। বাবার অবস্থা সে বুঝতে পারছে। তাকে বকা দিয়ে যদি কিছুটা শান্তি পাই বাবা, তাহলে সে বকা শুনতে রাজি আছে।
.
.
পরদিন বাবা শুভকে একটা প্রস্তাব করল, এলাকার এক মেয়েকে অনেক টাকা যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে করতে হবে। শুভ রাজি হলনা, এ অন্যায় সে করতে পারবেনা। কিন্তু বাবার এক কথা, বিয়ে না করলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
.
.
বাবা কনেপক্ষকে কথা দিয়ে ফেলেছে। বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে এসেছে। কিন্তু বিয়েরদিন শুভকে খুঁজে পাওয়া গেলনা কোথাও। পরদিন বাসায় ফিরল সে। কিন্তু, বাবার এক কথা, বাড়ি থেকে শুভ বেরিয়ে না গেলে বাবার মরা মুখ দেখতে হবে। তাই শুভ অনেক কষ্ট নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
.
.
বাড়ি ছেড়ে সে শহরে এসে ঠাই নিল। শহরের একটা বাসায় সে লজিং থাকল, একটা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে পড়াতে হবে, ওদের বাসায় থাকবে, খাবে।
.
শহরে শুভর সময়টা ভালোই কাটতেছিল। সে আরো কয়েকটা টিউশনি করে। মাসে বার থেকে পনের হাজার টাকা সে পাই, টাকাগুলো সে জমা করে, একদিন সব বাবার হাতে তুলে দেবে।
.
.
ফ্যমিলি ছেড়ে চলে এসে তার খুব কষ্ট হয়। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই কেমন আছে কে জানে। তাদের কথা মনে পড়লে মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। তবু অনেক আশা নিয়ে সে বেঁচে আছে। একদিন বাবা নিশ্চয় নিজের ভুল বুঝতে পারবে।
.
***
এরই মধ্যে শুভর সাথে লজিং এর যে মেয়ে সে পড়ায়, তার প্রেম হয়ে গেল। মেয়েটার নাম ঐশী। শুভ যখন ঐশীকে পড়াতে বসে, ঐশী তখন একনজরে শুভর দিকে তাকিয়ে থাকত।
.
একদিন শুভ জিঙেস করল:
--কি ব্যাপার? আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছ কেন?"
ঐশী জবাব দিল:
--স্যার, আমার মোটেও পড়তে ইচ্ছে করেনা।
--তো কি করতে ইচ্ছে করে?
--সারাক্ষণ আপনার দিকে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। স্যার, একটা কথা বলব?
-বলো?
--স্যার, আজ আমায় নিয়ে একটু বাইরে বেড়াতে বের হবেন বিকেলে?
--না, তোমার বাবা-মা জানতে পারলে আমাকে আর এখানে থাকতে দেবেনা।
-আম্মুকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। আর আব্বু জানতে পারবেনা। আপনি শুধু রাজি কিনা বলেন?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
.
.
বিকেলে ওরা বের হলো। একটা পার্কে বসে বাদাম খেতে খেতে দু'জন আড্ডা দিতে লাগল। হঠাৎ ঐশীর কি হল জানিনা, উঠে গিয়ে অচেনা একটা মেয়ের মুখে চড় বসায় দিল। তারপর শুভকে দেখিয়ে বলল:
--এই মেয়ে, তুমি উনার দিকে এইভাবে হা করে তাকাইছিলা কেন? জীবনে কি কোন পুরুষ মানুষ দেখনি? মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ঐশীর দিকে। পরে শুভ এসে পরিস্থিতি সামাল দিল। মেয়েটাকে বুঝিয়ে, "স্যরি" বলে বিদায় করল।
তারপর ঐশীকে বলল:
--মেয়েটার সাথে কাজটা ঠিক করলেনা।
--কেন স্যার? মেয়েটা আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে, আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব?
--আমার দিকে কোন মেয়ে তাকালে তোমার তাতে কি?
--আমার ওসব সহ্য হয়না স্যার। আমি আপনাকে ভালবাসি।"
.
ঐশীর এ কথায় শুভ ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল তার গালে। তারপর বলল:
--আমি তোমার স্যার, ভুলে যেওনা।
--আমি এতকিছু বুঝিনা। আমাকে মারেন কাটেন, যাই করেন, আমি শুধু আপনাকে চাই।" এই কথা বলে কান্না করতে করতে ঐশী দৌড়ে চলে গেল বাড়ির দিকে। রাতে সে কিছুই খেলনা। পড়তেও বসলনা। তার মা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে, কিন্তু কিছুই বললনা।
.
***
.
গভীর রাত পর্যন্ত জেগে গল্পেরবই পড়া অভ্যাস হয়ে গেছে শুভর। সেইরাঁতেও গল্পের বই পড়ছিল সে। হঠাৎ দরজায় ঠোকা পড়ল। দরজা খোলার সাথে সাথে ঐশী একটা বালিশ নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর শুভর বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শুভ অবাক হয়ে জিঙেস করল:
--এইসবের মানে কি ঐশী?
--তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা বলো? নইলে আজ সারারাত তোমার রুমেই থাকব।" সরাসরি "আপনি" থেকে "তুমি" তে চলে এল ঐশী।
--দেখ ঐশী, পাগলামি করোনা, তোমার রুমে চলে যাও।
--না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার ভালোবাসা আদায় করতে না পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত এইরুম থেকে একপাও নড়বনা। বলো আমায় ভালোবাসো?
--আমার মতো অপদার্থকে ভালোবেসে তুমি কিছুই পাবেনা।
--আমি অতকিছু বুঝিনা।প্লিজ আমাকে দয়া করে হলেও ভালোবাসো? তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমি বাঁচবনা।
--কারো ভালোবাসা না পেলে কেউ মরেনা।
--অবশ্যই মরে। তুমি কি ভেবেছো, শুধু দেহ থেকে প্রাণ চলে যাওয়াটাকেই মরে যাওয়া বলে? এইটা ভুল। মানুষ জন্মে একবার, কিন্তু মরে একাধিকবার। মানুষ যখন কোনো স্বপ্ন দেখে কাউকে নিয়ে সেই স্বপ্নের মৃত্যু হলে মানুষের একবার মৃত্যু হয়, খুব আপন কেউ ছেড়ে চলে গেলে মানুষের আরেকবার মৃত্যু হয়, যখন মানুষ তার মনের কথা মনের মানুষকে বলতে পারেনা, মনের কথা মনেতেই মরে যায়, তখন মানুষের আরও একবার মৃত্যু হয়। এইরকম মানুষ অনেকবার মরে। যখন দেহ থেকে প্রাণ চলে যায়, তখন মানুষ শেষবারের মত মরে। তোমাকে না পেলে আমিও জীবন্ত লাশ হয়ে যাব, প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। আমাকে
ভালোবাসতে না পারো, অন্তত সারাজীবন ভালোবাসার অভিনয় করে যাও।" কথাগুলো বলে ফুফিয়ে কান্না করতে লাগলল ঐশী। শুভ বুঝতে পারল, ঐশীর ভালোবাসা পবিত্র। সে তাকে সত্যিই ভালোবাসে। শুভকে চুপ থাকতে দেখে ঐশী বলল:
--প্লিজ শুভ, বলো আমায় ভালবাসো?
--কিন্তু ঐশী, তোমার বাবা-মা যদি জানতে পারে, আমাকে এইখানে থাকতে দিবেনা।
--জানবেনা, বলো আমাকে ভালোবাসো?
--হ্যা, ভালবাসি।
.
শুভর কথাশুনে ঐশীর হাসি-কান্না এক হয়ে গেল। মুখে হাসি, চোখে অশ্রু। খুশিতে শুভকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে থেমে গেল ঐশী। এমনভাবে সে শুভর দিকে তাকালো, যেন চোখ দিয়ে সে মিনতি করতে চাইল, "শুভ একবার জড়িয়ে ধরি তোমায়?"
.
ঐশীর অবস্থা বুঝতে পেরে শুভ বলল:
--থেমে গেলে কেন? জড়িয়ে ধর?"
ঐশী তখন হেসে উঠে জড়িয়ে ধরল শুভকে।
.
.
সেইরাতটা দু'জনের ভালোভাবেই কাটল। একদিন দুজনে বসে আছে পার্কে। শুভ অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবতেছে। ঐশী জিঙেস করল:
--কি ভাবছ?
--কিছুনা
--বলোনা?
--আম্মু ফোন করেছিল। বাসায় টাকার খুব প্রবলেম। আব্বুও নাকি চোখে ঠিকমতো দেখতে পাইনা এখন আর। চোখে অপারেশন করতে হবে। কি করব
বুঝতেছিনা।
--আমি বলি কি, তোমার কাছে জমানো যা টাকা আছে, তা নিয়ে বাবাকে একবার দেখে এসো।
--আমি যাবনা, আমি গেলে বাবার মরা মুখ দেখতে হবে। আমি বেঁচে থাকতে বাবার মরা মুখ আমি দেখতে পারবনা। বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি ঐশী। আসলে কি জান, কাছে থাকলে আপন মানুষগুলোর ভালোবাসার মর্ম বুঝা যায়না, দূরে এসেই বুঝতে পেরেছি আমি তাদের কতটা ভালোবাসি, আমার জীবনে তাদের ভালোবাসা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।" কথাগুলো বলতে বলতে শুভর চোখ দিয়ে অশ্রু বেরিয়ে আসল। ঐশীর আড়ালে তা মুছে ফলতে চাইল, কিন্তু পারলনা। তবে ঐশী তা দেখেও না দ.েখার ভান করল। ঐশী বলল:
--তাহলে এখন কি করবে?
--টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। দেখি, বাবার চোখের অপারেশনের পর কি হয়। চলো বাসায় ফেরা যাক।
--হূৃমমমম..... চলো...." দুজনে পাশাপাশি হাটতে হাটতে চলে এলো বাসায়।
.
***
.
কয়েকদিন পরের ঘটনা। শুভ সারাদিন বাসায় ফিরলনা। রাতেও আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ঐশীর ফ্যামিলির সবাই চিন্তা করতে লাগল। ফোন অফ তার, তাই যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছেনা। রাতে অনেক্ষণ পর বাসায় ফিরল সে। ঐশীর মা জিঙেস করল:
--কোথায় ছিলে বাবা এতক্ষণ?
--আন্টি, একটু অসুস্থ লাগছিল, তাই হসপিটালে যেতে হয়েছিল।" বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল শুভর।
--তো বাবা, এখন ঠিক আছ তো?
--হ্যা আন্টি, ঠিক আছি।
--খেতে বসো, আমি খাবার দিচ্ছি।
ঐশী বলল:
--মা, আমি খেতে দিচ্ছি, যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়।
.
মা ঘুমাতে চলে গেল। খাওয়ার সময় ঐশী প্রসঙ্গটা আবার তুলল। গলাটা নিচু করে জিঙেস করল:
--হসপিটালে কেন গেছ সত্যি করে বলো?
--এমনি।
-এমনি হলে ঐটা বলার সময় তোমার গলা কেঁপে উঠতনা।
--কই গলা কাঁপল?
--কেঁপেছে। আমি দেখেছি। সত্যিটা বল এখন।
--বললাম তো একটু অসুস্থ হয়ছি তাই।
--একটু অসুস্থ হলে সারাদিন সারারাত হসপিটালে কি?
--সারাদিন কোথায়? আমি তো একটু পার্কে ঘুরছিলাম একা একা।
--মিথ্যে বলে পার পাবেনা। সত্যিটা আমি জেনেই ছাড়ব। খাওয়া শেষ, এইবার ঘুমাতে যাও, গল্পের বই পড়ে রাত জাগারর কোনো দরকার নেই।
--ওকে মহারাণী। তুমিও যাবে কি আমার সাথে? দু'জন একসাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব?
--ইস, শখ কতো?
শুভ তখন ঐশীকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে কিস করার জন্য ধীরে ধীরে নিজের। ঠোঁটটা এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ঐশী চোখ বন্ধ করে ফেলল লজ্জায়। অনেক্ষণ পরও যখন শুভর ঠোঁটের স্পর্শ পেলনা, তখন চোখ খুলল সে। দেখল, শুভ এক নজরে তাকিয়ে আছে তার দিকে....
--ওভাবে তাকিয়ে আছ কেন?" জিজ্ঞেস করল ঐশী।
--তুমি কি জানো, তুমি কতো সুন্দর?
--হয়েছে, আর বলতে হবেনা। ভেবেছিলাম, একটু আদর করবে, সেই সৌভাগ্য আমার নেই।"
.
ঐশীর কথা শেষ হতেই শুভ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমে যেতে লাগল হঠাৎ। ঐশী বলল:
--এই কি করছ? ছাড়ো....
--আদর করার জন্য রুমে নিয়ে যাচ্ছি।
--লাগবেনা আদর। তুমি নিজে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি আমার রুমে যাবো।
--ওকে যাও"
ঐশীকে ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো শুভ।
.
.
রুমে এসে শুয়ে পড়ল সে। তারপর ভাবতে লাগল, ঐশীকে মিথ্যে বলা উচিত হয়নি তার। সত্যি কথাটায় বলে দেওয়া উচিৎ ছিল। একদিন তো সবাই জেনেই যাবে যে তার কিডনি দুইটা ড্যামেজ হয়ে গেছে। আজ সারাদিন সে হাসপাতালে ছিল। শরীরের বিভিন্ন টেস্ট করল। কিন্তু রেজাল্ট পেল নেগেটিভ। ডাক্তারের পরামর্শ নিল। কিডনি প্রতিস্থাপন করার মতো অত টাকা সে পাবেনা। ডাক্তার বলেছে ডায়ালাইসিস করে বাঁচিয়ে রাখা যাবে, কিন্তু এতেও প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দশহাজার টাকা লাগবে। এতটাকা সে কোথায় পাবে? সবদিকদিয়ে বাঁচার আশাটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে শুভর। এই কথাগুলো ঐশীকে বললে সে সামলে নিতে পারতনা, না বলে একপ্রকার ভালো করেছে।
.
চিন্তা করতে করতে সারারাত ঘুমাতে পারলনা সে। পরদিন শুভর আম্মু ফোন করে আরেকটা খারাপ নিউজ দিল। তার আব্বুর চোখ পরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। চোখ প্রতিস্থাপন করতে হবে। এতো টাকা নাই, তাই অপারেশন হয়নি। টেনশনের উপর টেনশন! কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারলনা। ঐশী এসে স্বান্তনা দিতে লাগল। শুভর মলিন মুখটা দেখে সে জিঙেস করল:
--শুভ, কি হয়েছে বলবে?
--ঐশী, আমার আব্বু চিরতরে অন্ধ হয়ে গেল। আব্বুর অপারেশন হয়নি।
--তোমার আব্বুকে আমাদের এইখানে নিয়ে এসো। আমার আব্বুকে বলে অপারেশন করাব।
--কিন্তু তোমার আব্বুর টাকায় আমি আমার আব্বুর অপারেশন করবনা।
--পাগলামি করোনা শুভ। প্লিজ নিয়ে এসো।
--কিন্তু আব্বুর সামনে আমি কি করে যাবো?
--তোমার আব্বু তোমাকে চোখের সামনে না যেতে বলেছে, কিন্তু এখন তো তোমার আব্বু চোখে দেখেনা। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো...
--ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
--হুমমমম...... যাও।
.
***
.
বাড়িতে এসে শুভ তার আব্বুকে সব বুঝালো। কিন্তু কোনমতে রাজি করাতে পারলনা। বরং শুভকে অপমানিত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হলো।
.
শহরে ফিরে এলো সে। হসপিটালে গিয়ে এক ডাক্তারের সাথে তার আব্বুর ব্যাপারে কথা বলল। তারপর বাসায় ফিরল। ঐশী বা কারো সাথে কথা বললনা। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগল।
.
গভীররাতে উঠে সে দুইটা চিঠি লিখল। একটা ঐশীর জন্য, আরেকটা তার বাবার জন্য। তারপর চিন্তা করতে করতে সারারাত কাটিয়ে দিল।
.
.
সকালের দিকে শুভ তার আম্মুকে ফোন দিল। ফোন রিসিভ করে মা বলল:
--হ্যালো শুভ।
--হ্যালো মা" বলে ফুফিয়ে কেঁদে ফেলল শুভ।
--কি ব্যাপার কাঁদছিস কেন?
--এমনি মা, কেমন আছো?
--ভাল আছি বাবা, তুই কেমন আছিস?
--আমি? হ্যা মা ভালো আছি।" বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠল তার।
--আমি জানি তোর মন খারাপ শুভ।
--না মা, মোটেওনা। মা, কাল আব্বুকে বুঝিয়ে এইখানের হসপিটালে নিয়ে আসবে।
--কিন্তু তোর বাবা রাজি হবে তো?
--আমার কথা না বললে রাজি হবে। বলবে, শহরে একটা খুব ভালো ডাক্তার এসেছে। যে টাকার জন্য না, মানুষের সেবার জন্য চিকিৎসা করে।
--ঠিক আছে, আমি বুঝিয়ে বলব।
--ওকে মা, রাখি তাহলে। ভালো থেকো।" বলেই ফোন রেখে দিল শুভ।
.
***
.
বিষন্ন মনে পার্কে বসে আছে শুভ আর ঐশী। শুভ হঠাৎ ঐশীকে প্রশ্ন করল:
--বাবা দিবসে তোমার আব্বুকে কিছু গিফট করবেনা?
--করব, একটা দামি কিছু গিফট করতে হবে।" জবাব দিল ঐশী
--আমিও একটা দামি জিনিস আমার আব্বুকে গিফট করব।
--কি?
--এখন বলা যাবেনা। বাবা দিবসের দিন দেখবে।
--ওকে।
--তোমায় খুব সুন্দর লাগতেছে আজ।
--মনে হয় প্রথম দেখতেছ?
--না, শেষবার দেখতেছি।
--মানে?
--মানে? মানে হল.... মা....নে..." বলতে বলতে ঠোঁটটা এগিয়ে নিয়ে গেল ঐশীর মুখের দিকে। তারপর আলতো করে চুমু খেলো তার কপালে। আচমকা শুভর এই আলতো ছোয়ায় শিহরণ বয়ে গেল ঐশীর সারা শরীরে। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। নিঃশ্বাস বেড়ে গেল তার। বুক উঠানামা করতে লাগল ঘনঘন। ঐশীও শুভকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে কিস করল গালে। তারপর বলল:
--তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসি শুভ।
--আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি ঐশী। এইবার চলো, বাসায় ফেরা যাক।
--হুমমমম.... চলো।" দু'জনে বাসার দিকে পা বাড়াল।
.
***
.
পরদিন সকাল থেকে শুভকে খুঁজে পাওয়া গেলনা। সারাদিন বাসায় ফিরেনি, রাতেও না। ফোনও তার অফ। ঐশী খুব টেনশন করতে লাগল। এর পরের সকালে সে শুভর রুমে ঢুকল। দুইটা চিঠি পেল সে। একটা তার নামে, অন্যটা শুভর আব্বুর নামে। তার নামের চিঠিটা সে খুলে পড়তে লাগল:-
.
প্রিয় ঐশী,
প্রথমেই আমি তোমার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারন, আর কখনো ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাবো কিনা জানিনা। তোমাকে যে কথাগুলো বলতে যাচ্ছি তা মুখে বলার সাহস আমি পাইনি, তাই পত্রের মাধ্যমে বলতেছি। জানি, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, অামিও তোমাকে কম ভালোবাসিনা। তোমাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছি, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারলামনা বলে আমি দু:খিত। আসলে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাটা কাউকে মানায়না। আমার দুইটা কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। আমার আর বাঁচার কোন উপায় নেই....
.
জানিনা এই পত্রটা তুমি পাওয়ার পর আমি আর বেঁচে থাকবো কিনা। সবাইকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এই ভেবে শান্তি পাচ্ছি, বুকের ভেতর এতদিন তিলতিল করে গড়ে উঠা কষ্টের অবসান হতে যাচ্ছে।
.
জানো ঐশী, তোমাকে নিয়ে খুব স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু বিধাতা তা চাইনি। এই জনমে তোমার আমার মিলন হবেনা ঠিক, কিন্তু আখিরাতে নিশ্চয় বিধাতার কাছে তোমাকে আমি চেয়ে নেব।
.
আমার পত্র পাওয়ার পর সেন্ট্রাল হসপিটালে একবার এসো, আমার আব্বুর চোখের অপারেশন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা দেখে যেও।
.
আর একটা কথা, পারলে আমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করিও, আর নতুন করে অন্য কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিও। কিন্তু আমার ভালবাসার কসম রইল, নিজের কোনো ক্ষতি তুমি কখনো করবেনা।
.
ভাল থেকো, দূর থেকে তোমাকে সবসময় আমি ভালবেসে যাবো।
ইতি
শুভ
.
.
চিঠিটা পড়ে ঐশী জোরে জোরে কান্না করতে লাগল। তারপর বাবা-মাকে নিয়ে সেন্ট্রাল হসপিটালে ছুটে গেল। ততক্ষণে শুভর বাবার চোখের অপারেশন শেষ। চোখের ব্যান্ডেজ খুলতেছে ডাক্তার। তখন কান্না করতে করতে ঐশী ঢুকল। চিৎকার করে বলল:
--ডাক্তার, ডাক্তার আমার শুভ কোথায়?"
.
*ডাক্তার নিশ্চুপ। কোন কথা বললনা।*
.
--কি হয়েছে আমার শুভর?" শুভর মা জিঙেস করল।
.
*ডাক্তার নিশ্চুপ"
.
শুভর বাবা জিঙেস করল:
--ডাক্তার, আমার এতবড় উপকারটা কে করল? কে এই মহান ব্যক্তি, যে আমাকে চোখ দান করল? আমি তাকে একবার দেখতে চাই..."
ডাক্তার এইবার বলল:
--দেখতে চান? আসুন আমার সাথে।"
.
.
ডাক্তার সবাইকে একটা কক্ষে নিয়ে গেল, যেখানে লাশ রাখা হয়। তারপর একটা লাশের উপর থেকে সাদা পর্দা সরিয়ে বলল:
--ইনিই আপনাকে চোখ দান করেছেন।"
.
শুভর নিস্তেজ দেহকে পড়ে থাকতে দেখে সবাই "না...আ....আ" বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। শুভর বাবা সবার চেয়ে জোরে কান্না করতে লাগল। সবার আর্তচিৎকারে রুম যেন ফেটে যাবে,
কিন্তু শান্ত হয়ে শুয়ে আছে শুধু শুভ। আর কখনো সে জাগবেনা, ভাবতেই অবাক লাগে।
.
.
ঐশী শুভর বাবার দিকে পত্রটা এগিয়ে দিল। শুভর বাবা পড়তে লাগল:
.
প্রিয় বাবা,
প্রথমেই বাবা দিবসের শুভেচ্ছা রইলো। আশা করি ভাল আছো। বাবা, তোমাকে আমি কি বলব বুঝতেছিনা। সারাজীবন আমি তোমার অপদার্থ ছেলে হিসেবে কাটিয়েছি। আমি আসলেই অপদার্থ বাবা। নিজের বাবার ভালোবাসা পর্যন্ত যার কপালে জুটেনা, তার মতো বড় অপদার্থ আর কে হতে পারে?
.
কিন্তু বাবা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি বলেছো, আমি তোমার সামনে আসলে তোমার মরা মুখ দেখতে হবে। কিন্তু বাবা, আমি তা দেখতে পারবনা কখনো। তাই তোমার সামনে কখনো আসবনা, হয়তো আসার সুযোগও পাবোনা।
.
বাবা, আমি জানি, তুমি চোখ নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছো। আমি তো আর বাঁচবনা আমার দুইটা কিডনিই ড্যামেজড। তাই আমার চোখ দুইটাও আর প্রয়োজন নেই।
.
সেন্ট্রাল হসপিটালের ডাক্তারবাবুকে আমি সব বলে রেখেছি। উনি সব ব্যবস্থা করে দিবেন আমার চোখ দুটো তোমাকে প্রতিস্থাপন করার ব্যাপারে। বাবা দিবসে তোমাকে আমার পক্ষ থেকে এই ছোট্ট উপহার বাবা। আমার চোখ দিয়ে তুমি আবার বিশ্বকে দেখো বাবা। আর আমাকে ক্ষমা করে দিও....
.
সারাজীবন তোমার জন্য কিছুই করতে পারলামনা বাবা। বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আজ খুব ইচ্ছে করতেছে, তোমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে শুধু "বাবা বাবা" বলে ডাকতে। কিন্তু আফসোস! আমি অপদার্থ এতো বড় কপাল নিয়ে জন্ম নিইনি।
.
মা, আর ছোট ভাইবোনদের নিয়ে সুখে থেকো বাবা....... ভালো থকো।
ইতি
তোমার অপদার্থ ছেলে।
.
.
চিঠিটা পড়ে শুভর বাবার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। সারাজীবন যে ছেলেকে তিনি অপদার্থ বলে গালমন্দ করেছেন, সেই ছেলে তার জন্য এতবড় ত্যাগস্বীকার করবে বুঝতে পারেননি তিনি।
.
.
সবাই কান্না করতে লাগল। অথচ কি শান্ত হয়ে পড়ে আছে শুভর নিস্তেজ দেহ! একটুও নড়চড় নেই। হয়তো তিলেতিলে গড়া কষ্টগুলোর অবসান হয়েছে তার। আজ সে মুক্ত!
.
.
সবার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। কিন্তু ঐশীর কান্না থেমে গেল হঠাৎ, কান্না করতে করতে সে যে শুভর লাশের উপর বেহুশ হয়ে পড়ে আছে, তা কেউ খেয়াল করেনি।