দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হিয়া বলল,

-বাবা, আমার বিদায়ের সময়ে তো কেঁদে কেঁদে খুব বলেছিলে তোমার সাধ্য থাকলে আমাকে সারাজীবন রেখে দিতে। নাও, চলে আসলাম সারাজীবনের জন্য।

লাবিব সাহেব অনেকটা হতভম্ব ভাবে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। হিয়ার এক হাতে লাগেজ আর অন্য হাতে রোহানের হাত ধরা। এই প্রথমবারের মত বিয়ের পর তার মেয়ে তার স্বামী ছাড়া এই বাড়িতে পা রেখেছে।

-তুই এভাবে চলে আসলি কেন?
-কেন আমি কি আসতে পারি না?

মা দরজায় হিয়া আর নাতি রোহানকে দেখে খুশিতে এসে হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। রোহান বলল,
-নানু, তুমি তো আমাকে দেখছোই না।

রেহানা বেগম তখন রোহানকে কোলে তুলে নিয়ে মজা করে বলল,
-ওলে পুচকুটারে...তোমাকে তো আমি দেখি ই নি।
-যাও..আমি থাকবো না।
-আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে। কান ধরছি। আসো ঘরে আসো।
এরপর হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-কিরে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবি? আয় ভিতরে আয়।

লাবিব সাহেব তখনো বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভিতর থেকে হিয়া ডাক দিল,
-বাবা, ভিতরে আসো। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? আর কেউ আসবে না।

লাবিব রেগে রেহানাকে বললেন,
-তোমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে একেবারের জন্য চলে এসেছে তুমি কি বুঝতে পারছো না?
-হয়ত ওই বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে।
-ঠিক হলেই ভালো। তোমার ছেলের টাকায় আমরা চলছি। সেটা খেয়াল রেখো।
-মাহবুব কি তার বোনকে ফেলে দিবে?
-ও বাসায় ফেরার পর বুঝা যাবে সেটা।
-একটু আস্তে কথা বলো। মেয়ে শুনতে পাবে।

হিয়ার কানে অবশ্য সব কথাই গেছে। রুমের সামনেই যে দাঁড়িয়ে ছিল তারা খেয়াল করে নি।
মা দেখে বলল,
-তুই দাঁড়িয়ে কেন? কিছু বলবি?

হিয়া একটু শুকনো হেসে বলল,
-না তেমন কিছু না।
বাবা কিছু না বলে বেড়িয়ে গেলেন। অন্য সময় সন্ধ্যা বেলায় তিনজনে চুটিয়ে আড্ডা দিতো।

সন্ধ্যায় মাহবুব যখন শুনলো তার বোন এসেছে তখন খুশিই হলো। কিন্তু পরবর্তীতে মা যখন বলল একেবারের জন্য তখন রাগী ভাব চেহারায় ফুটে উঠলো।

-শুনলাম তুই নাকি একেবারের জন্য চলে এসেছিস?
মাহবুবের কণ্ঠস্বর শুনে ভাইয়ের দিকে তাকালো হিয়া। এরপর হেসে বলল,
-কেমন আছিস ভাইয়া?
-আমার কথার উত্তর দে।
-হ্যা চলে এসেছি। আর যাবো না।
-কেন?
-এমনি।
-ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারবো। ইয়ার্কি পেয়েছিস? কয়েকদিন বাদে আমার বিয়ে। এর মধ্যে তুই আমার ঘাড়ে এসে চাপবি?
হিয়া চুপ করে গেল।

খাবার টেবিলে তেমন কিছুই ছিল না। শুধু ডাল আর ভাত। অন্য যে কয়বার তার স্বামী হাসানের সাথে এসেছে পুরো ডায়নিং টেবিল ভর্তি খাবার থাকতো।

রোহান বলল,
-নানু, আমাকে একটা ডিম ভেজে দাও।

মেয়েকে হাজারবার বুঝানো সত্ত্বেও যখন মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর জন্য রাজি করাতে পারলেন না, তখন তার মেজাজটাও খারাপ হতে শুরু করেছে।

তিনি রাগী স্বরে উত্তর দিলেন,
-যেটা আছে সেটা খাও। এখন ডিম ভাজতে পারবো না।

রোহান মাথা নিচু করে ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নিল। হিয়া শুধু একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

আজকে বাড়িতে উৎসবের আমেজ। তার মা তাকে কোনো কাজেই থাকতে দিচ্ছেন না। কোন এক আত্মীয় বলেছে তার মেয়ে অপয়া। সে কোনো কাজে হাত দিলে তার ছেলের অমঙ্গল হবে।

রোহানের হাত ধরে বাবার সামনে এসে বলল,
-বাবা, তুমি কি ব্যস্ত?
-কিছু বলবি?
-হ্যা বাবা। আমি চলে যাচ্ছি।

এতক্ষণ মুখের দিকে না তাকিয়েই কথার জবাব দিচ্ছিলেন। এবার মুখ তুলে তাকালেন।
-তোর ভাইয়ের বিয়ে আজকে। তুই থাকবি না?

-আমি থাকলে হয়ত তোমার ছেলের অমঙ্গল হবে বাবা৷ বিয়ের চার বছরের মাথায় হাসানকে হারালাম। এতদিন শ্বশুরবাড়িতে অপয়া, অলক্ষুণে কতসব নামে ডাকা হতো আমাকে। অভিযোগ, অন্যায়, অবহেলা সহ্য করে ছিলাম। আর পারিনি বলে তোমার বাড়ি চলে এসেছিলাম।

-তোর মানিয়ে নেয়া উচিত ছিল। তারা তাদের ছেলেকে হারিয়েছে বুঝতে পারছিস না কেন?

হিয়া একটু হাসলো। এরপর বলল,
-হ্যা বাবা৷ তারা তাদের ছেলেকে হারিয়েছে। আর আমি হারিয়েছি আমার স্বামীকে। মানিয়ে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু পারিনি।

যখন চলে আসছিলো মা পেছন থেকে ডাকলেন। হিয়া ঘুরে তাকালো। চোখে পানি নিয়ে বলল,

-তুমি তো আমার বিদায়ের সময়ে বলেছিলে বাবা, তোমার যদি সাধ্য থাকতো তাহলে আমাকে সারাজীবনের জন্য রেখে দিতে। সুযোগ তো এসেছিলো।  রাখতে পারলে না আমাকে।

বাবা মা নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। হিয়া চোখ মুছতে যেয়ে ফুল হাতার ভিতর থেকে আঘাতের চিহ্ন উঁকি দিলো।

এবারের মেয়ের বিদায়ে তাদের চোখে আজকে কোনো পানি নেই, আছে স্বস্তি।

পরের দিন হিয়ার শ্বশুরবাড়ি তে ফোন দিয়ে জানা গেল রোহান আর হিয়া তাদের বাড়ি যায় নি।