আজকের রান্নার স্বাদটা একটু অন্যরকম লাগছে দেখে জাফর ভাইকে বললাম, 'ভাই, আজ কে রান্না করেছে?’
জাফর ভাই তার কনুইয়ে গড়িয়ে পড়া ডাল চেটে খেতে খেতে ছোট্ট করে বললেন, ‘খাবার জিনিস খেয়ে যান। এত প্রশ্ন করবেন না’।
অদ্ভুত জাফর ভাই এভাবেই ডাল খান। ডালের ভেতর যতক্ষণ ভাত থাকবে ততক্ষণ হাত দিয়ে সে ভাতগুলো তুলে তুলে খাবেন। পরে দু’ঠোঁটের ফাঁকে প্লেটকে চাপিয়ে সজোরে ‘শুউত্‌’ করে চুমুক দেবেন। এমুহূর্তেও মেলামাইন প্লেটের অবশিষ্ট ডালে চুমুক দিলেন। আমি আরেকবার ভাত মুখে দিতে রান্নার স্বাদে আবারো স্পষ্ট ভিন্নতা অনুভব করলাম। বললাম, ‘ভাই, কখনোই তো এমন মনে হয়না। আপনার কাছে আজকের রান্নাটা একটু অন্যরকম লাগছে না?’
জাফর ভাই স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বুয়ার এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন হয়েছে, ওর মেয়ে এ কয়দিন রান্না করবে, আজ থেকে শুরু করেছে’।
এবার স্বস্তি পেলাম। মানুষ অভ্যস্ত অনুভূতিতে স্বাভাবিক থাকে। ইন্দ্রিয়গত অনুভূতিতে যখন ভিন্নতা আসে তখন তারা অস্বস্তিতে ভোগে। ভিন্নতার একটা যুক্তিনির্ভর গ্রহণযোগ্য সমাধান না পেলে মনের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে। এজন্যই হয়ত মানুষকে ‘রেশনাল (Rational) এনিম্যাল’ বলা হয়। আরো একটা ব্যাপার থেকে যায়, প্রতিটা মেয়ের দু'টিমাত্রই হাত থাকে, আমাদের ক্ষুধার তাগিদে প্রতিটা হাতের পাঁচ আঙুলের কারসাজিতে তারা নিত্যনৈমিত্তিক খাদ্যপোযোগী রান্নাবান্না করে। একই পেঁয়াজ, একই মরিচ, একই লবণ তবুও প্রত্যেকের রান্নার স্বাদ ভিন্ন হয়। এই ভিন্নতার রহস্য সৃষ্টিকর্তা ছাড়া বোধহয় অন্য কেউ জানেন না।
জাফর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রূপক সাহেব, আপনি কখন যেনো অফিস থেকে ফেরেন?’
‘ছয়টার আশেপাশে, কেনো ভাই?’
‘বুয়া যতদিন না সুস্থ্য হয়ে আসে ততদিন আমি না ফেরা পর্যন্ত আপনি বাসায় ফিরবেন না’
জাফর ভাইয়ের কথার অর্থ ঠিক বুঝলাম না। বললাম, ‘কি সমস্যা ভাই? বাসায় ফিরলে সমস্যা কি?’
ডালে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আপনাকে অত কিছু বুঝতে হবে না’।
প্লেট নিয়ে উঠে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘শুনুন রূপক সাহেব, সতের আঠারো বছরের মেয়েরা এমনিতেই সুন্দরী হয়। বুয়ার মেয়ে হলেও, এ মেয়েটা একটু বেশী সুন্দরী। আশা করি বুঝতে পেরেছেন’।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। জাফর ভাই আমাকে এমন ভাবেন? দীপার সাথে আমার সম্পর্কের কথা জেনেও আমাকে এমন ভাবলেন? এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। আমার খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, খাবারে আবারও ভিন্নতার স্বাদ অনুভব করলাম। আমি সতের আঠারো বছরের একটি মেয়ের হাতের রান্না খাচ্ছি। মেয়েটা দেখতে কেমন হবে? জাফর ভাইয়ের তথ্যমতে, মেয়েটা সুন্দরী এবং কমবয়সী, কমবয়সী মেয়ে আর বেশীবয়সের মেয়ের মধ্যে পার্থক্য কি কি? মেয়ে আর মহিলার পার্থক্য কি?
নিজের কাছে খটকা লাগলো, ছিঃ! কি ভাবছি এসব? সমাজের নিম্নবিত্ত এক কায়িক শ্রমজীবী মেয়েকে নিয়ে কি ভাবছি এসব! যাদের গায়ে কোনো পার্ফিউমের স্মেল থাকেনা, থাকলেও সস্তা কড়া পার্ফিউমের ঝাঁঝালো স্মেল অথবা পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সরিষার তেলের সাথে গায়ের ঘাম মিশে কাপড়ের পরতে পরতে তেল চিটটিটে বোঁটকা গন্ধ থাকে, এমন একটা মেয়েকে নিয়ে ভাবছি? আমি?
জাফর ভাই মেয়েটার কথা বললেন তাই চিন্তাচেতনায় কিছুটা কল্পনাপ্রসূত অস্তিত্বের আগমন এসেছে, তার মানে এই না, আমি এমন একটা মেয়েকে নিয়ে ভাববো। দীপা থাকতে আমি অন্য কারো চিন্তা করবোই বা কেন? জাফর ভাই এমনটা ভাবতে পারেন না আমার সমন্ধে! লোকটার উপর চাপা অভিমানের সাথে চাপা রাগ হলো, ইচ্ছে হলোনা তাঁর সাথে আর কোনো কথা বলি।
বিছানাতে পিঁপড়া উঠেছে। বালিশ সরিয়ে চাদর ঝাড়ার সময় একটা লম্বা চুল চোখে পড়লো। আমার বিছানায় মেয়েদের চুল! কোত্থেকে আসতে পারে? এমনও তো হতে পারে, রুম ঝাড়ু দেয়ার সময় মেয়েটি আজ আমার ঘরে ঢুকেছিলো, পরে কোনো কারণে এ বিছানায় বসেছিলো, সেখান থেকেই চুল ঝরে পড়া অমূলক কিছু নয়। সতের আঠারো বছরের একটা মেয়ে আমার বিছানায় বসেছিলো! মেয়েটা বুয়ার মেয়ে হলেও শুনেছি মার্জিত সুন্দরী একটা মেয়ে! আবার আক্ষেপ লাগলো। ছিঃ! কি ভাবছি এসব, মেয়েটা আমাদের কাজের বুয়ার মেয়ে!
ভোর বেলায় জাফর ভাইয়ের দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙলো। তিনি অফিসের জন্য বের হয়েছেন। যাবার আগে তাই নক করে বললেন, ‘রূপক সাহেব, মনে আছে তো, আটটার আগে বাসায় ঢুকবেন না, মেয়েটার কাছে চাবি আছে, সে রান্না করে চলে যেতে পারবে, আপনি কোনো অজুহাত দেখিয়ে বাসায় আসবেন না যেনো!’
আমি চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এখনো দু’ঘন্টা সময় আছে, আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক। এই স্বল্প ঘুমে একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, আমি গ্যাসের চুলার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এ চুলার পাশ দিয়ে একটা দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে বের হয়ে সোজা একটা রাস্তা বাগানের ভেতর ঢুকে গেছে। আমি আলু বা আলুজাতীয় কোনো একটা সবজি পলি পলি করে কেটে হালকা পানি দিয়ে সামান্য সেদ্ধ করছি। কড়াই ধুয়ে চুলায় চাপিয়ে তেল ঢালবো এমন সময় সতের আঠারো বছরের এক মেয়ে দৌড়ে এসে বললো, ‘স্যার, তেল ঢালবেন না, তেলে আর জলে মেশেনা। আপনি জলের মধ্যে তেল ঢালবেন না স্যার!’
একথা বলে মেয়েটা হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দৌড়ে দরজা দিয়ে বাগানের ভেতরে চলে গেলো। আমি পিছু পিছু গিয়ে দেখি আশেপাশে কেউ নেই। এখানকার গাছপালাগুলোর সব পাতা কালো। পাশেই লেকের মতো একটা পুকুর আছে, সে পুকুরের পানি রূপালি-সাদা রঙা হয়ে আছে। একটা বড় আম গাছের ডালের দিকে তাকাতে দেখি সে মেয়েটা ঝুলছে। গলায় ঈষৎ রূপালী রঙা নাইলনের মোটা দড়ি। খিলখিল করে হেসে বলছে, ‘স্যার, বলেছিলাম না জলের সাথে তেল মেশাতে যাবেন না’।
পুরোটা শরীর ঘেমে ঘুম ভাঙলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এমন স্বপ্ন দেখলাম কেন আমি? আমি এমন কিছুইতো ভাবিনি। শুয়ে শুয়ে ভাবছি জাফর ভাইকে এ স্বপ্নের কথা বলবো কিনা!
কেমন যেন একটা ভয়ভয় কাজ করেছে। এমন ভয় মানে মন কুঞ্চিত হয়ে যাওয়া, যেমন কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে অনেকদিন মুখ বেঁধে রাখা বেলুন সময়ের সাথে সাথে কুঞ্চিত হয়ে যায়। মনে হচ্ছে আমার মনের গলায় কে যেন নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে, ধীরে ধীরে আমি চুপসে যাচ্ছি, প্রাণ থেকে বায়ু বের হয়ে আমি খোলস হয়ে যাচ্ছি!
দুপুর পর্যন্ত অফিসে তেমন মন বসলোনা। আমার মনমরা ভাব কাটলো লাঞ্চের পর। হঠাৎ করেই কেনো যেনো মনটা ফুরফুরে হলো। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! কোনো হতাশা, অপ্রাপ্তি বা ভয় কখনো মানুষকে জেঁকে ধরলে মানুষ চাইলেই সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা।
পৃথিবীতে স্বতস্ফুর্ত (Spontaneous) বলে একটা কথা আছে যার শুরুটা হয়েছে সৃষ্টিকর্তা থেকেই, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তিনি এগুলো এভাবে বন্টন করে দিয়েছেন যে, প্রত্যেক মানুষই তার জীবনের কোনো না কোনো সময় হতাশা, অপ্রাপ্তি বা ভয় নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করবেই। এই হতাশা, অপ্রাপ্তি বা ভয়ের অনুভূতিও সম্পূর্ণ স্বতস্ফুর্ত ব্যাপার, অজানা নির্দেশে যেগুলো ইচ্ছে করলেই মানুষের মনের গলা চেপে ধরে আবার ইচ্ছে হলেই ছেড়ে দেয়। সকালের স্বপ্নের ব্যাপারটা এখন হালকা হয়ে গেছে তাই জাফর ভাইয়ের অফিসে যাবো বলে বের হলাম।
আমার বের হতে হতে চারটা বেজে গেলো। ব্যক্তিগত কিছু ডকুমেন্ট বাসায় ফেলে এসেছিলাম। কর কমিশনারের অফিসে সেগুলো আজকের মধ্যেই পৌঁছাতে হবে, তাছাড়া ব্যাখ্যা তলব খেতে হতে পারে বিধায় বাসায় ফিরলাম।
মূল কলাপসিবল গেট দিয়ে ঢোকার সময় একটা মেয়ে আমার পেছনে পেছনে ঢুকলো। ঢুকে আমার পেছনে আসা শুরু করলো। আমি তালা খোলার সময় পেছনে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা আমার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভেতরে ঢুকে দরজা আটকাতে যাচ্ছি এমন সময় মেয়েটি বললো, ‘স্যার, ভেতরে যাবো’।
হচকচিয়ে গেলাম। এই মেয়েটা কি বুয়ার মেয়ে? না না এ হতে পারেনা, এমন পুতুলের মতো মেয়ে বুয়ার মেয়ে হবে কেন, বুয়ার মেয়েরা হবে সাদা চামড়া বিবর্জিত, যাদের মুখের দিকে সামজিক মানুষগুলো তাকায় না, তাকায় প্যাঁচ দিয়ে রাখা কোমরের বন্ধনীর শুরু থেকে ঝাঁকি জালের মতো একপরত ওড়না মেলে দেয়া বক্ষসৌষ্টবের প্রান্তদেশীয় অঞ্চলের পুরো পরিধিতে। আমার দৃষ্টিচ্যুতি হলোনা, শুধু মেয়েটার নিখুঁত মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ‘আপনি...আপনি...ভেতরে আসবেন কেন?’
‘স্যার, আমার মা এ বাসায় রান্না করে’ বলে ভেতরের ঘরে চলে গেলো। আমি বিছানায় বসে পড়লাম। ভাবছি, জাফর ভাই একটুও মিথ্যে বা বাড়িয়ে বলেননি। আমি কিছুতেই কোনো কিছু মেলাতে পারছি না, এ হিসাব মেলানোর মতো নয়। এবার ভেতর থেকে মেয়েটা এসে একদম শুদ্ধভাবে বললো, ‘স্যার, বাসায় একটুও তেল নাই, একটু তেল এনে দেন।’
আমি বললাম, ‘একটু দাঁড়াও, এনে দিচ্ছি। ও হ্যাঁ, তোমার নাম কি?’
‘বিথী, বিথী সুলতানা’
‘আচ্ছা বিথী, আমি তেল এনে দিচ্ছি’।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেলাম। কেমন যেন একটা ঘোর কাজ করছে। আমি কেন এ মেয়েকে নিয়ে এমন ভাবছি, ধ্যাত! একটা বুয়ার মেয়ে কেন আমার মাথায় ঘুরছে? আমি সমাজের প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর একজন, আমার মাথার মধ্যে সামান্য দু’পয়সায় কাজ করা বুয়ার মেয়ে ঘুরবে কেন? পৃথিবীতে কতই তো সুন্দরী মেয়ে আছে! আমার দীপাও তো অনেক স্মার্ট, অনেক আধুনিক সৌন্দর্য্যবাহক সোস্যাল একটা মেয়ে। আমার এসব ভাবা একদমই মানায় না। তেল এনে বিথীকে দিয়ে বললাম, ‘তুমি কতক্ষণ বাসায় থাকবে?’
‘স্যার, রান্না আর ঘর মোছা শেষ করতে প্রায় আটটা বাজবে’।
একটু সাহস করে আবার বললো, ‘স্যার কি বাইরে যাবেন এখন?’
আমি জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, আর কিছু লাগবে কি?’
মেয়েটি বললো, ‘ফিরবেন কখন?’
একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘পৌনে সাতটার দিকে’
এটুকু বুঝলাম মেয়েটা ‘পৌনে সাতটা’ কখন হয় সেটা বুঝতে পারেনি। প্রাকৃতিকভাবে প্রায় সব মেয়েই ‘পৌনে’ ও ‘সোয়া’ শব্দদুটি গুলিয়ে ফেলে। সময়ের ক্ষেত্রে এই দুটি শব্দ ব্যবহার করলে ওরা মনে মনে দেয়াল ঘড়িকে সামনে নিয়ে এসে মিনিটের বড় কাঁটাটি ডানে না বামে যাবে তা নিয়ে দোদ্যুল্যমান থাকে। বুঝতে পারলাম, বিথীর ঠিক এমনটাই হয়েছে। একটু হেসে বললাম, ‘তুমি রান্না করো, আমি সাতটার মধ্যেই ফিরবো’।
আজ পা দু’টাতে কেমন যেন অসংলগ্নতা অনুভব করছি। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় যেখানে প্রায় প্রতিদিনই দেয়ালের বাড়ি ভাড়া, অমুক নেতা তমুক নেতার পোস্টার বা দেয়ালি দৈনিক পত্রিকায় একবার হলেও চোখ বোলাতে ইচ্ছে করতো সেখানে আজ একদমই ইচ্ছে করছেনা। অন্যদিন হলে মনে মনে এসব নিয়ে চিন্তা করতাম, বাড়ি ভাড়া দেখলেই একটা বউ এর কথা চোখে ভাসতো, ‘বউ’ মেয়েটাকে নিয়ে বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে বলতাম, এই দেখুন আমার বউ, আমি ব্যাচেলর নই, আমি বাড়ি ভাড়া পাবার যোগ্য, আমাকে দেখে নাক সিঁটকাবেন না প্লিজ। চাররঙা পোস্টারের নেতার ছবি দেখলেই মনে পড়ে যেতো আমাদের গ্রামের বাসায় ছোট বেলায় ধানের বস্তা চুরি করা চোরের কথা। কি মারটাই না মেরেছিলো সেদিন! মনের পর্দায় আজ সেই চোরটার কথা ভেসে ওঠে। জানি এগুলো একান্ত আমার নিজের ভাবনা। শুধু আমি কেন, এমন ভাবনা অনেকেই ভাবে, যাদের বেশীরভাগরাই প্রকাশ করে না। মাঝে মাঝে ভাবি, যদি কখনো আমি আমার মনের কথাগুলো প্রকাশ্যে প্রকাশ করতাম তবে এদেশের রাজনীতিবিদরা আমার ফাঁসির আদেশ বাস্তবায়নের জন্য উঠে পড়ে লাগতেন।
না, আজ আমার ফাঁসি হবার ভয় নেই, আমি এসব দু’পয়সার পোস্টার নিয়ে ভাবছিনা, আমার ভাবনার অনেকটাই ঘিরে আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার সুশ্রী সমাজের নিচুস্তরের একটা মেয়ে। যে মেয়েটার মুখোমুখি হতে জাফর ভাই কাল রাতে নিষেধ করেছিলেন।
একটা রিক্সায় জাফর ভাইয়ের অফিসের নিচে পৌঁছলাম। দারোয়ান সালাম দিয়ে বললো, ‘জাফর স্যার ভেতরে নাই।'
আমি একটু অবাক হ'লাম, জাফর ভাইতো সাধারণত অফিস টাইমে বাইরে যান না। বললাম, ‘কোথায় গেছেন বলতে পারো?’
‘স্যার একটু অসুস্থবোধ করতেছিলেন, ডাক্তারের কাছে গেছেন’
আমি কয়েকবার ফোন দিয়েও তাঁকে না পেয়ে ডকুমেন্টগুলো ড্রপ করে বাসায় ফিরলাম। হাতঘড়িতে দেখি প্রায় পৌনে সাতটা বাজে। যে হাতঘড়িটা দেখলাম সেটা কিছুদিন আগে দীপা আমার বার্থডেতে গিফট করেছে। মেয়েটার নাকি গিফট করতে খুব ভালো লাগে, পরবর্তীতে কি গিফট পাবো জানতে চাইলে বলেছিলো, আগে থেকে বলে দিলে নাকি গিফটের মজা নষ্ট হয়ে যায়। আগে থেকে না জানালে যেকোনো গিফট পেলে মানুষ ‘অবাক’ হয়। দীপা ‘অবাক’ হওয়া দেখতে খুব পছন্দ করে। এখন এই হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা লজ্জাবোধ হলো। আমি রুমে ঢুকে ওয়াশরুমের দিকে এগুলে সতের আঠারো বছরের বিথীকে দেখাবো অথচ আমার হাতে থাকবে দীপার দেয়া রেডিয়াম ডায়ালের সুইস ব্রাণ্ডের ঘড়ি! কেন যেন এটা মানায় না। ঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখলাম। বিথীকে বললাম, ‘বিথী, রান্না কতদূর?’
বিথী শুনেও শুনলোনা যেনো! এবার কাছে গিয়ে বললাম, ‘কি রান্না করছো?’
মাথায় ওড়না টেনে মেয়েটা বললো, ‘আলু ভাজি, পেঁপে দিয়া কই মাছের ঝোল আর পাতলা ডাল।’
‘তোমার মায়ের কি অবস্থা এখন? কোন হাসপাতালে আছে?’
‘আজ অপারেশন হইছে, ভালোই আছে। মামায় ঢাকা মেডিকেলেই রাখছে’।
আমি আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিনা। ওয়াশরুমে ঢুকেও দেরী করতে ইচ্ছে হলোনা। তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসে বললাম, ‘বিথী তোমার রান্না চমৎকার!’
বিথী হেসে বললো, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’।
মেয়েটার মুখে ইংরেজী শুনতে বেশ অদ্ভুত লাগলো। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ একটা সহজ ইংরেজি, আজকাল এসব সহজ ইংরেজি যে কেউ ব্যবহার করতে পারে তবে বুয়ার মেয়ে ইংরেজিতে প্রতিউত্তর দেবে এমনটা আশা করিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি পড়াশুনা করো?’
‘হ্যাঁ, করি’
‘কিসে পড়ো’
বিথী হেসে বললো, ‘টেবিল চেয়ারে পড়ি, মাঝে মাঝে বিছনায় বসেও পড়ি...হিহিহি’।
মেয়েটা কি আমার দূর্বলতা ধরে ফেলেছে? আজকেই পরিচয় অথচ আমার সাথে হাসি ঠাট্টা করা শুরু করে দিলো! আমিও ঠাট্টা করে বললাম, ‘তা কয়বার কোমর ভেঙ্গেছে?’
বিথী আবার হেসে বললো, ‘হিহিহি...এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম এইবার। স্যার, আরেক স্যার আছে না? তিনি আসবেন কখন?’
আমি বললাম, ‘কে? জাফর ভাই? তাঁর তো আটটার দিকে আসার কথা। কেন কিছু লাগবে নাকি?’
‘না, মানে মা বলছিলো দুই হাজার টাকার কথা’
‘ও আচ্ছা’ বলে দুইটা একহাজার টাকার নোট এনে দিয়ে বললাম, ‘নাও’।
আমি তখনো রান্নাঘরে। আমি এতক্ষণ রান্নাঘরে আছি কেনো? এখানে আমার কি দরকার? যদিও দীপা আসবেনা, তবুও এখন যদি দীপা এসে দেখে একটা মেয়ে রান্না করছে আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি, তবে ব্যাপারটা ভালো হবেনা। জাফর ভাইও আমাকে নিষেধ করেছিলেন যেন আটটার আগে বাসায় না ঢুকি। আমি বিথীকে বললাম, ‘তোমার মা কি অন্য আর কোনো বাসায় কাজ করে?’
বিথী বললো, ‘হ্যাঁ স্যার, আরেক ফ্যামিলি বাসায় ঘর মুছে আর কাপড় ধয়।’
‘ও আচ্ছা’ বলে আমি রুমে চলে গেলাম।
ঠিক আটটায় জাফর ভাই এসেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘রূপক সাহেব, আপনি কখন বাসায় ঢুকেছেন?’
আমি বললাম, ‘ভাই, আপনি নাকি অসুস্থ? কি হয়েছে আগে বলেন তো!’
‘আমার পেছন দিয়ে লিকুইড নির্গত হচ্ছে, আমার লিকুইডের খবর জেনে আপনি কি করবেন? উত্তর দেন, কখন ফিরেছেন?’
আমি মিথ্যে করে বললাম, ‘এইতো ভাই এখনই’।
জাফর ভাই আমার ঘরে পায়চারী করে আলনাতে রাখা বেল্ট হাতে ধরে বললনে, ‘বাহ, বেল্টটাতো বেশ!’
জাফর ভাই চলে গেলেন। রান্না শেষে বিথী আমার দরজায় উঁকি দিয়ে খানিক হেসে বললো, ‘যাই তাইলে স্যার’।
রাত এগারোটা পর্যন্ত প্রায় সাত আটবার জাফর ভাই ওয়াশরুমে যাতায়াত করে ফেলেছেন। লোকটা কি জানি কি খেয়ে পেটে অসুখ বাঁধিয়েছে কে জানে! খবর নিতে তাঁর কাছে গেলাম, ‘এখন কি অবস্থা ভাই? স্যালাইন আনতে হবে?’
‘রূপক সাহেব, আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। আপনি চেয়ার টেনে বসুন, কথা আছে’
আমি চেয়ারটা এগিয়ে জাফর ভাইয়ের মুখোমুখি বসলাম। তিনি বললেন, ‘রূপক সাহেব, আপনি আজ বেশ আগেই বাসায় ফিরেছেন তাই না?’
‘আরে না, তেমন আগে না তো। কেনো বলেন তো ভাই?’
‘মেয়েটার সাথে কি কি আলাপ হলো?’
‘ছাড়ুন তো ভাই, তেমন কিছুনা। আপনার ঔষধ কয়টা আছে?’
আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, 'রূপক সাহেব, আপনি সাতটার আশেপাশে বাসায় ঢুকেছেন। কেননা, এ বাসার কোথাও আপনার জুতার কোনো দাগ নাই। নীচতলায় কাজ চলছে, সেখানে অনেক পানি-কাদা জমে আছে। আপনার জুতার তলায়ও কাদা লেগে আছে। অথচ আপনার রুমের দরজার কোনোদিকে জুতার দাগ নাই। আপনি আসার পর মেয়েটা ঘর মুছেছে। মেয়েটা অবশ্যই সাতটার আগে ঘর মুছেছে এতে সন্দেহ নেই। তবে কি দাঁড়ায়? তাছাড়াও তখন বেল্ট ধরতে গিয়ে আপনার আন্ডারওয়ারেও হাত লাগিয়ে দেখেছি সেটা ঠান্ডা হয়ে আছে। আধাঘণ্টার মধ্যে আসলে সেটা গরম থাকতো। সব মিলিয়ে আপনি সাতটার আগে ঘরে ঢুকেছেন।'
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 'রূপক সাহেব, আপনি যা করছেন তা অনৈতিক। এমনটা আর করবেন না প্লিজ’।
আমি আকুলভাবে বললাম, ‘জাফর ভাই, আপনি যা ভাবছেন তা না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি অনৈতিক কিছু করিনি বা এমন ইচ্ছাও নেই’
‘ভালো, বেশ ভালো। দুহাজার টাকা নিশ্চয়ই দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, ভাই ওর মায়ের তো অপারেশন’
জাফর ভাই আমার দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মুখটা বাঁকিয়ে বললেন, ‘আহা আহা হা... ‘ওর’! বেশ তো এখন ‘ওর’ বলছেন। দুদিন পর ‘ওগো’ ‘ওগো’ না শুরু করে দেন আল্লাহই জানেন’।
আমার আর ইচ্ছা হলোনা লোকটার সাথে কথা বলতে। রুমে ফিরে গেলাম। তিনি আমাকে কি ভাবেন? আমার মেয়েটার সাথে কথা বলতে ভালো লেগেছে তার মানে এটা তো নয় যে এখানে কোনো বাজে কিছু হয়েছে। হোক না সে বুয়ার মেয়ে। বিথী কি মানুষ না! বিথী কি সবার মতো দু'পায়া মানুষ না? একি! আমি এসব আবার কি ভাবছি, বিথী বুয়ার মেয়ে, সে আমাদের সোসাইটির মধ্যে পড়েনা। আমার আর তার সাথে কথা বলার উচিত না। আমি ভুল করেছি, কাল থেকে আটটার পর বাসায় ফিরবো। দীপাকে ফোন দিলাম, ‘রাতে খেয়েছিলে দীপা?’
‘আজ হঠাৎ খাওয়ার খবর নিচ্ছো যে? কি হয়েছে তোমার? গলাটা এমন লাগছে কেন?’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছি আমি, এমনিতেই একটু কাজের প্রেশারে ছিলাম। আচ্ছা ঘুমাও তাহলে’
‘রূপক, কি হয়েছে বলবে তো?'
আমি লাইন কেটে দিলাম। শুয়ে শুয়ে সন্ধ্যার কথা মনে হলো। বিথীর গোলাপী রঙা জরজেটের ওড়নার কোণায় ফেঁসে যাওয়া একটা সুতা ঝুলছিলো। ফ্লোরে রাখা হাঁড়িতে বড় হাতাওয়ালা স্টেইনলেস স্টীলের চামচের গায়ে লেগে থাকা শুকিয়ে যাওয়া শক্ত ভাতে সুতাটা আটকে গিয়ে ওড়নায় টান খাচ্ছিলো। বিথী দু’তিনবার ওড়নাটা ঠিক করে নিয়েছিলো। ওর হাতে ছিলো তেলের বোতল, আলুভাজিতে তেল ঢালতে ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে শব্দ হচ্ছিলো। আমাকে বলেছিলো, ‘স্যার একটু দূরে সরেন, তেল ছিটতে পারে’। আমি তেলের ভয়ে দূরে সরিনি। আমার তখন তেল ছিটার ভয় ছিলোনা।
এভাবে প্রতিদিন সাতটার আগে বাসায় ফিরা শুরু করলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে বিথীর সাথে কথা হয়। ধীরে ধীরে বিথী তার স্বপ্নের কথা শোনায়। পড়াশুনা করে অনেক বড় হবে। বিথীর বাবা তার মা’কে ছেড়ে যাওয়ায় মায়ের অনেক কষ্ট হয়। মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে জীবন ধারণ করতে হয়। প্রায়শই মাঝরাতে মায়ের কান্না শুনে বিথীর পড়তে ভালো লাগেনা। খাতার উপর যেখানে কলম থেকে কালি ঝরার কথা সেখানে চোখের পানিতে খাতা ভিজে যায়। আজ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কাল একটা ছেলের কথা বলেছিলে না? যার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চায়। আমার মনে হয় সে বিয়ে না করাই ভালো হবে’।
কিছুটা উদাস হয়ে বিথী বললো, ‘আমার অনেক পড়াশুনা করার ইচ্ছা স্যার। মা তড়িঘড়ি করে লাগছে আমার বিয়ার জন্য’
‘তুমি দেখতে সুন্দর, পড়াশুনায়ও ভালো, বেশ ভালো ছেলে পাবে বলে মনে হয়’
আমাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার আপনি বিয়ে করবেন না? কাল যার সাথে ফোনে কথা বলছিলেন সে কি আমাদের হবু ভাবী?’
আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, সেরকমই ইচ্ছা আছে।'
সিংকে রাখা থালাগুলোর উপর ট্যাপ ছেড়ে মেয়েটা মাজুনিতে সাবান মাখলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার মা’য়ের অবস্থা এখন কেমন?’
বিথী কোনো কথা বললোনা। আমি বললাম, ‘আর কি টাকা লাগবে?’
কেমন যেন অদ্ভুত চাপা উচ্চারণে বললো, ‘না’।
আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘বিথী, তোমার কি মন খারাপ? কি হয়েছে? বলো?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘না স্যার, কিছু হয়নাই, আপনি ঘরে যান। বড় ভাইজান এসে পড়লে খারাপ ভাববে’।
আমি রুমে ফিরে আসলাম। জাফর ভাই দরজা দিয়ে ঢুকেই হো হো করে হাসতে শুরু করলেন। আমি হাসির কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, "জানেন রূপক সাহেব, ক’দিন ধরে পেটটা ভালো যাচ্ছে না। ‘স্টুল স্যাম্পল’ দিয়ে আসলাম। যে এটেন্ডেন্ট মেয়েটার হাতে স্যাম্পলটা দিলাম সে নাক চেপে ধরে স্যাম্পল নিলো। আমি বললাম, 'এত ঘৃণা থাকলে চাকরীটা ছেড়ে দিলেই পারেন, নাক থেকে হাত সরান।'
মেয়েটি বললো, 'আচ্ছা আপনার পেট খারাপ না হলে হতোনা? তাহলে আর আপনার এমন স্যাম্পল আমার ধরতে হতো না।'
আমি বললাম, 'আমি কিন্তু আপনার বড় স্যারের কাছে কমপ্লেইন করবো।' একথা বলতেই মেয়েটা নাক থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। হা হা হা"।
আমার মনটা বেশ খারাপ। বিথীর জন্য আমার করার কিছুই নেই। মেয়েটার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত হতে পারতো। বুয়ার মেয়ে বড় কেউ হতে পারবেনা এমন কোথাও লেখা আছে কি? দীপার মতো ওর ও তো দুটি হাত দুটি পা, দুটি চোখ, একটি নাক! পার্থক্য শুধু জন্মগত বৈষম্যে। আমি ভাবতে ভয় পাচ্ছি, তবুও নৈতিকতা ও অসামঞ্জস্যতাকে দূরে সরিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছি ‘বিথী তো আমার ঘরও উজ্জ্বল করতে পারতো!’
জাফর ভাই বললেন, ‘রূপক সাহেব, কয়েকদিন ধরে তেলজাতীয় জিনিস বেশি খাওয়া হয়ে গেছে, আবার সাথে সাথে পানি খেয়েছি তখনই মনে হয় সমস্যা হয়েছে। জানেনই তো, তেল আর জল কখনো মেশেনা’।
লাইট নিভিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছি আগামীকাল মেয়েটা এলে বলবো, ‘বিথী, তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। যদি অন্যের সাথে আমার কমিটমেন্ট না থাকতো তবে তোমাকে বিয়ে করতাম। তুমি মন খারাপ করোনা, তোমার প্রতি আমার একটা আলাদা ভালোলাগা আছে সেটাতে আমি তোমাকে নিজের করে নিতে পারবোনা হয়ত তবে তোমার কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলবা’।
না না এসব কি ভাবছি? আমি এসব বলবোই বা কেন? এগুলা আমাকে মানায় না। একদমই মানায় না। এমন দোটনা ভাবনায় কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। আজও স্বপ্নে দেখলাম বিথী রান্নাঘরের পাশ দিয়ে রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। বলছে স্যার, ‘রান্নাঘরে তো তেল ছিলোই, আপনি কেন ওখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন? আমার তো তেল দরকার ছিলোনা’ বলে দরজার দিয়ে দৌড়ে বাগানের মধ্যে ঢুকলো। আমি পেছন পেছন গিয়ে দেখি মেয়েটা বড় আমগাছে ঝুলছে। গলায় নাইলনের রূপালী মোটা দড়ি, বিথী গলায় দড়ি পরে হি হি হি করে হাসতে হাসতে বলছে, ‘স্যার, স্বপ্ন খুব খারাপ জিনিস, স্বপ্ন দেখাও খারাপ, স্বপ্ন দেখানোও খারাপ!"
সমস্ত গা ঘেমে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি বাইরে কিছুটা আলো ফুটেছে।
আজ বাসায় ফিরলাম ছয়টার দিকে। অপেক্ষা করছি কখন বিথী আসবে। আজ বিথীকে নিয়ে ওর মা’কে দেখতে যাবো, ঠিক করে রেখেছি। সাতটা বাজলো অথচ বিথী এখনো এলোনা। সে তো এতো দেরী করেনা। কি হলো মেয়েটার? আটটার দিকে দরজায় নক পেয়ে দৌড়ে খুলে দিলাম।
‘বিথী এত দেরী হলো কেনো?’ কথাটা বলেই ফেলছিলাম প্রায়। এমুহূর্তে জাফর ভাই হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ঢুকতে গিয়ে বললেন, ‘রূপক সাহেব, খুব ক্ষুধা লেগেছে, কি রান্না হয়েছে আজ?’
আমার কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। মেয়েটা এলোনা কেন? ওর কি ফোন আছে? থাকলেও আমার কাছে নেই। বিথী কোথায় থাকে তাও জানিনা।
অদ্ভুতরকম মন খারাপ হয়ে গেলো। বললাম, 'মেয়েটা আজ আসেনি, আপনি বাইরে থেকে খেয়ে আসুন'।
এভাবে পুরো সপ্তাহ গেলো। আমি আর বিথীর খোঁজ পেলাম না। তবে সে কি মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলো বলে আর আসেনি? সে কি এই ভেবেছে তেলে আর জলে মেলেনা! নাই যদি আসবে তবে একবার বলে যেতে পারতো! বলে গেলে কি খুব অন্যায় হতো? অপেক্ষা খুব খারাপ জিনিস। গত বৃহস্পতিবারে শেষ এসেছিলো আজ আরেক বৃহস্পতিবার পেরিয়ে রবিবার এসেছে। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি সে কি জানেনা?
ধীরে ধীরে বিথীর অনুপস্থিতি গা-সওয়া হয়ে গেছে। সময়ের পরিসরে এটা হওয়া স্বাভাবিক। শুরুর কয়দিন প্রাণ খুলে হাসতে পারিনি, কথা বলতে পারিনি, জাফর ভাই, দীপা বা কলিগদের সাথে ভালো করেও আলাপও হয়নি। অবশ্য বিথীবিহীন এই এক সপ্তাহ পার হওয়াতে এখন সবকিছু স্বাভাবিক লাগছে। দীপার সাথে গত দুইদিনে শুক্র-শনি ছুটিতে এখানে সেখানে ঘুরেছি।
আজ সপ্তাহের শুরুর দিনে অফিস শেষে বাসায় ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছি। ফোনে হালকা সাউন্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্লে করে পায়ের উপর পা দিয়ে হালকা করে দোলাচ্ছি। গান বাজছে, ‘আমারো পরানো যাহা চায়/তুমি তাই...তুমি তাই গো.../ আমি তোমারো বিরহে রহিবো...’
দরজায় নক করার শব্দ পেলাম। নিশ্চিত জাফর ভাই এসেছেন! দরজা খুলে দেখলাম, না, জাফর ভাই নন, বিথী এসেছে। আমার যেখানে উচ্ছ্বাস হবার কথা তেমনটা হলোনা। তবুও একটা হঠাৎ প্রাপ্তির পূর্ণতার মনটা ভরে গেলো।
মেয়েটা মাথা নীচু করে দরজার বাইরে একপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ম্যাজেন্টা কালারের সালোয়ার কামিজ, চুল ছাড়া। মাথার ডান দিকের চুলগুলো মুখের অর্ধেকটা ঢেকে রাখায় বিথীকে অনেক আকর্ষণীয়া লাগছে। আমি বললাম, ‘বিথী, এতদিন কোথায় ছিলে?’
মাথা নিচু করেই বিথী উত্তর দিলো, ‘স্যার, মায়ের অপারেশনটা ভালো হয়নাই, ডাক্তার বলছে কিজানি সমস্যা হইছে। মা বোধহয় কিছু টাকা পাইতো আপনাদের কাছে...যদি দিতেন...’
‘আমার কথার উত্তর দাও বিথী, বলো, এতদিন কোথায় ছিলে?’
‘স্যার, আমার টাকাটা খুব দরকার’
আমি ওর সামনে এসে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘বলো বিথী কি হয়েছিলো, কেনো এলেনা এ কয়দিন?’
বিথী গা ঝাড়া দিয়ে বললো, ‘স্যার ছাড়ুন, প্লিজ ছাড়ুন স্যার’
ওর ডান গাল বেয়ে নেমে আসা চুল গুলো ঝাঁকুনিতে সরে যেতে দেখলাম কী বীভৎস্য দৃশ্য! ডান চোখ উপড়ে ফেলা, ক্ষতটা এখনো শুকায়নি। ডান গালে বেশ কয়টা কামড়ের দাগ। ক্ষতগুলো এমন অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য বহন করে যা বাস্তবে কোনো সুস্থ্য মস্তিস্কের মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আমি ওর চুলগুলো সরিয়ে ভালোভাবে দেখতে চাইলে বিথী চিৎকার দিয়ে বলবো, ‘খবরদার ধরবেন না। সহানুভূতি দেখান? এই আপনাদের মতই আরেক বাসায় আমার মা কাজ করে দিতো। ঐখানেও আপনাদের মতোই মানুষ থাকতো। লোকটার বউ বাচ্চারে গ্রামের বাড়িত পাঠায়া দিয়া ঐ কুত্তারবাচ্চা আরো কয়েক কুত্তারে ডাইকা নিয়া আসে বাসায়। আমার শরিলে কত দাগ করছে জানেন স্যার? অদের শক্তির সাথে আমি পারিনাই স্যার। এক কুত্তার পায়ের ফাঁকে লাথি দিছিলাম দেইখা আমার চোখে আঙুল ঢুকাইয়া দিছে, গালে কামড়াইয়া মাংশ তুইলা নিছে। আমার চোখ দিয়া গলগল কইরা রক্ত পড়ছে দেখেও অদের মায়া হয়নাই। মুখে কাপড় বাইধা সব্বাই একের পর এক ইচ্ছামতো কামড়াইছে স্যার... কুত্তার বাচ্চাদের সাথে আমি শক্তিতে পারিনাই স্যার...আমারে কি মানুষ মনে হয়না স্যার? আমরা কাজের বুয়ার মেয়ে বইলা আমরা মানুষ না স্যার?’।
কিছুক্ষণ নিরব থেকে আমি বিথীর দিকে হাত বাড়ালাম। বিথী হুহু করে কেঁদে আমার বুকে আছড়ে পড়লো। আমি ভালো করেই জানি কিছুক্ষণ পরেই বিথীকে বুক থেকে সরিয়ে দিতে হবে। বুয়ার মেয়েকে বুকে মানায় না, আমাদের মতো সভ্য মানুষরা সাময়িক মানসিক ও শারিরীক শান্তি উপভোগ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় বিথীদের। আমাকেও ওকে কিছুক্ষণের মধ্যেই সরিয়ে দিতে হবে। তেল আর জলের অসমসত্ত্ব মিশ্রণ হাজার বছর পাশাপাশি রাখলেও ওরা মেশেনা। শত বছর পর তেল অক্সিডাইজড হয়ে দূর্গন্ধ ছড়াবে, যেখানে হাজার বছর পরেও জল থেকে যাবে চিরন্তন, বাঁচার সঞ্জীবনী এক অবিনাশী প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ হিসেবে!
এমুহূর্তে অনুভব করলাম আমার বুকের বামপাশটা বিথীর চোখের জলে ভিজে গেছে। পৃথিবীর অভিশাপগ্রস্ত যাপিত জীবনের নির্মমতায় বিথী এখনো কেঁদে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি বুক ভেজানো এ জল বিথীর বাম চোখের লোনা জল। ওর অন্য চোখ আর কখনোই কাঁদবেনা!