রিমির সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল মার্কেটে !! একটা টি-শার্ট কেনার জন্য অনেক সময় ধরে ঘুরছিলাম কিন্তু পছন্দ হচ্ছিলো না । হঠাৎ এক দোকানে একটা নেভি ব্লু রঙের টি-শার্ট পছন্দ হলো । টি-শার্টের কাপড় দেখতে গিয়ে দাম দেখে আৎকে ওঠলাম, ৭৯৯ টাকা !! কিন্তু মানিব্যাগ বের করে দেখি মাত্র ৪২০ টাকা আছে । হতাশ হয়ে পছন্দের টি-শার্ট রেখে অন্যকিছু দেখতে থাকলাম । টাকা কম থাকায় পছন্দের জিনিস রেখে আসতে হলো । আর দেখতে ইচ্ছা করছিলো না ।

হঠাৎ একটা মেয়েকন্ঠ পেছন থেকে বললো, "এই যে শুনছেন ?"
আমি পেছনে ঘুরে মেয়েটাকে বললাম, "আমাকে বলছেন ?"
- হ‍্যা আপনাকেই বলছি ।
- কি হয়েছে বলুন । আমাকে কেন ডাকছেন ?
- আজকে আমার কাজিনের জন্মদিন । আমি ওর জন্য একটা শার্ট কিনতে চাচ্ছি, কিন্তু ঠিক করতে পারছি না । আপনি তো মেন ফ্যাশন ভালো বুঝবেন !! আমাকে একটা শার্ট চয়েজ করতে একটু সাহায্য করবেন প্লিজ ?

এমনিতেই পছন্দের জিনিস রেখে আসতে হয়েছে টাকার অভাবে !! তার ওপরে মেয়েটার সাহায্য চাওয়া আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর ঠেকলো । কেবল মুখ ঝামটা দিয়ে না করে দিবো আর তখনই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো । সাহায্যের পরিবর্তে সাহায্য বলা যেতে পারে অথবা ছোট কাজের জন্য বড় অংকের পারিশ্রমিকও বলা যেতে পারে ।
আমি মাথা একটু নেড়ে বললাম, "আচ্ছা, ঠিক আছে । তবে একটা শর্ত আছে ।"

মেয়েটা হয়তো এমন কোন কথা আশা করছিলো না !! খানিক অবাক হয়ে বললো, "কি শর্ত আপনার ?"
আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ফেললাম, "আমাকে চারশো টাকা দিতে হবে ।"
মেয়েটা আগের চেয়ে আরো বেশি অবাক হয়ে গেলো আমার টাকা চাওয়ার কথা শুনেই । চোখ মুখ বড় বড় করে অনেকটা চিৎকার করেই বললো, "কিহহহ ?"
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, "জ্বি হ্যা । রাজি থাকলে বলুন ।"

মেয়েটা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখলো । হয়তো অন‍্য কেউ আছে কিনা তা দেখার জন্য । কিন্তু তার ভাগ্য খারাপ, আর আমার ভাগ‍্য ভালো সেখানে আর কেউ ছিল না সেলসম‍্যান বাদে । আর মেয়েটা সেলসম‍্যানকে জিজ্ঞেস করার বোকামি নিশ্চয়ই করবে না !! হয়তো আর কোন উপায় না পেয়েই মেয়েটা কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলো ।
বললো, "আচ্ছা । আমি রাজি । কিন্তু আমারো একটা শর্ত আছে ।"
- কি শর্ত ?
- আমাকে রিকশা পর্যন্ত হেল্প করতে হবে ।
- আচ্ছা । এখন বলুন আপনার কাজিনের গায়ের রং, উচ্চতা কেমন ?
- দেখতে মোটামুটি ফর্সা, উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি, চুল কোকড়া কোকড়া ।
- এই মেরুন কালার শার্টটা দেখতে পারেন । এটা পড়লে ওনাকে দারুণ লাগবে ।

মেয়েটা কিছুক্ষণ দেখে তারপর হঠাৎ বললো, "আপনি একটু ধরুন তো আপনার গায়ের ওপর ‌। আমি দেখে নিই ।"
মেয়েটার কথায় আমি আবারো বিরক্ত হলাম বেশ । কিন্তু, যেহেতু ৪০০ টাকা নিবো তার থেকে তাই একটু তো মেনে নিতেই হবে । আমি নিতান্তই কালা । মেরুন রঙের শার্ট পরে আমাকে বাজে দেখানোর কথা । তবু কিভাবে যেন শার্টটা আমাকে মানিয়ে গেল !! জোর করে মুখে হাসি এনে বললাম, "এখন ঠিক আছে ?"

- হুম । ঠিক আছে ।
- এখন আমার পাওনা টাকা টা আমাকে দিয়ে দেন প্লিজ ।
- কিসের টাকা যেন ?
- ওও আচ্ছা ! এখন আমি কে ? সমস্যা নেই । শার্টটা আমি নিয়ে যাচ্ছি ।
- হা হা, এই নিন । কিন্তু আমি কি জানতে পারি টাকাটা আপনি কেন নিচ্ছেন ?
- ধার হিসেবেই চেয়েছি । পরে কখনো দেখা হলে ব্যাক করে দিবো ।
- আর যদি দেখা না হয় তাহলে ?
- তাহলে এই সাহায্যের পারিশ্রমিক হিসেবে চালিয়ে নিবেন ।
মেয়েটা কাউন্টারে বিল দিয়ে চলে গেলো, আমিও আমার পছন্দের টি-শার্টটা কিনে বাসায় ফিরে এলাম ।

পরের দিন সকালেই ঘুম থেকে ওঠে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশ রুমের দিকে যাচ্ছি । দেখি সোফায় কারা কারা যেন বসে আছে । আমি আর ওদিকে তাকালাম না । ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম । শুয়ে শুয়ে গেম খেলছিলাম তখনই সবুজ কল দিয়ে বাসা থেকে বেরোতে বললো । ফোন আর মানিব্যাগ পকেটে ভরে ড্রয়িং রুমে যেতেই আমাকে দেখে বাবা ডাক দিলো ।
সামনের সোফার মোটা ভদ্রলোকের দিকে ইশারা করে বললো, "ওটা তোর আঙ্কেল হয় । আমার কলেজ লাইফের বন্ধু, এরশাদ । আর ও রিমি । তোদের ভার্সিটিতেই পড়ে ।"

হঠাৎ এরশাদ আঙ্কেল বললেন, "রুদ্র, তুমি কি রিমিকে নিয়ে একটু ঘুরে আসতে পারবে বাইরে থেকে ?"
আমি না করতে যাবো কিন্তু ওদিকে কন‍্যা ওঠে এসেছে । এখন কিছু বলতে গেলেই বাবা এক লাথি মেরে আমার মাজার হাড় ভেঙে দিবে । তাই আর কোন কথা না বলে ওই রুম থেকে বাইরের বারান্দায় বের হয়ে এলাম । বাইরে আসতেই রিমি বললো, "কি মিষ্টার ! আঙ্কেল কে বলবো আপনি ওইদিন আমার থেকে টাকা নিয়েছিলেন ?"
আমি ভয়ঙ্কর চমকে ওঠলাম তার কথা শুনে । বাবাকে আমি প্রচন্ড ভয় পাই । এই কথাটা জানতে পারলে বাবা আমার চামড়া ছিলে ফেলবেন সেটাও ভালো করেই জানি । আকুতি ভরা কন্ঠে বললাম, "না না । ও কাজ ভুলেও করবেন না প্লিজ । বাবা আমাকে খুন করে ফেলবে । আমি আপনার টাকা দিয়ে দিচ্ছি ।"

- শুধু টাকা দিলে তো হবে না ।
- তাহলে কি করতে হবে বলুন । যা বলবেন আমি তাতেই রাজি ।
- আমাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যাবেন এখন ।"
আমি বাইরে তাকিয়ে ঢোক গিলে বললাম, "এই কড়া রোদের মধ্যে বের হবো ?"
- আপনি যাবেন নাকি আঙ্কেল কে বলবো ?"
আমি আবার তাড়াহুড়ো করে বললাম, "আমি কি না করছি নাকি ? চলুন ।"

এক প্রকার বাধ‍্য হয়েই মেয়েটাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম । বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলাম । রিকশায় পাশাপাশি বসেছি দু'জন । আমি একটু গা লাগিয়েই বসেছি । আমাকে জোর করে নিয়ে আসা ! বুঝুক এবার ! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মেয়েটা কিছু বলছে । কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই লজ্জা পেয়ে সরে বসলাম ।
ফুচকাওয়ালা মামাকে দুইপ্লেট ফুচকা দিতে বলে আমি সিগারেট কিনতে গেলাম । মেয়েটা ওখানেই বসে রইলো । আমি সিগারেট টানতে টানতে টুলে বসে পড়লাম !! লক্ষ্য করলাম মেয়েটা আমার দিকে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে ।

আমি ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করলাম, "কি হয়েছে ? কোন সমস্যা ?"
- দেখছেন একটা মেয়ে বসে আছে । তার সামনে সিগারেট টানছেন ? আপনার কি বুদ্ধি বলতে কিছু নাই ?
আমি আবারো লজ্জা পেয়ে সিগারেট ফেলে দিলাম ।
একটু পর দোকানদার মামা ফুচকা দিয়ে গেলো । আমি একটা মুখে নিতেই যেন মুখ পুড়ে গেলো । চেঁচিয়ে ওঠলাম, "আপনাকে ঝাল কম দিতে বলেছিলাম না ?" ।
ফুচকা ওয়ালা বেচারা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, "আমি কি করমু ? আফায়ই তো কইলো ঝাল বাড়াইয়া দিতে । তাই দিছি ।"

রিমির দিকে তাকিয়ে দেখি ও হাসছে । আমি অন‍্য কোন ভুবনে চলে গেলাম । নাহ !! এই মেয়েটার কারণে আমি ঠিকমতো রাগ করতে পারছি না । হয়তো আমি রিমির প্রেমে পড়ে গেছি ।
আমি খুব কষ্টেসৃষ্টে আর দুইটা খেলাম, কিন্তু রিমি সেই ঝাল দেওয়া ফুচকা সব গপাগপ খেয়ে নিলো । মেয়েটা এতো ঝাল কিভাবে খায় কে জানে ! ফুচকা খাওয়া হয়ে গেলে রিমি বললো, "এখন আইসক্রিম খাবো ।"
-আচ্ছা ঠিক আছে । আমি নিয়ে আসছি ।

ফুচকার দোকানের পাশেই ভ্রাম্যমাণ আইসক্রিমের দোকান । দু'টা ভ‍্যানিলা ফ্লেভার কোন আইসক্রিম কিনলাম । রিমির আইসক্রিম খাওয়া দেখে, আমি আবারো প্রেমে পড়ে গেলাম ।তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছিলো কিন্তু, রিমির ডাকে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো ।
- ওইই হ‍্যালো । কি দেখছেন ?
- না মানে ! আইসক্রিম দেখছিলাম ।
- আপনার হাতেও তো আছে । ওটা দেখেন ।
- আমি তো আপনার মতো সুন্দর করে আইসক্রিম খাইতে পারি না তাই দেখছি ।
- ঢং করেন ?
রিমির কথা শুনে আমি আবারো লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম ।

আইসক্রিম খাওয়া শেষ হলে রিকশা নিয়ে বাসায় চলে গেলাম । ঠিক আগের মতোই কথা চলছে সবার মাঝে । রিমি গিয়ে ওর মার পাশে বসলো । আর আমি বাবার সোফার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । বাবা আর এরশাদ আঙ্কেল কলেজ লাইফের মজার ঘটনা আলোচনা করছেন । মা আর রিমির আম্মু কথা শুনে হাসছেন ।
যাওয়ার সময় এরশাদ আঙ্কেল লাল রঙের একটা খাম বাবার হাতে দিয়ে বললেন, "দোস্ত রিমির বিয়ে আগামী মাসের ২ তারিখ । তোরা সবাই আসবি কিন্তু ।"

কথাটা শুনে আমার বুকটা ফেটে গেলো । সবাই চলে গেলে আমিও দৌড়ে আমার রুমে চলে গেলাম । দরজা আটকে দিয়ে বাপ্পারাজের সিনেমার গান প্লে করে দিলাম,
"চলে যায় , প্রাণের পাখি চলে যায়
পিঞ্জর ভেঙে চলে যায়" ।।
গান শুনে রিমি, রিমি বলে কান্না করছি । কি কপাল আমার ! প্রেম হওয়ার আগেই ছ্যাকা খেয়ে ফেললাম ।