আমার সামনে যেই লোকটি বসে আছে তার নাম রতন সরকার। দীর্ঘদিন থেকে সরকারি হাসপাতালের ডোম হিসেবে কর্মরত আছে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মাথার চুলগুলো বেশিরভাগই সাদা। তামাটে গায়ের রঙ, ঠোঁট দুটো সিগারেটের তাপে পুড়তে পুড়তে ঝলসে গেছে। রতন সরকারের উপরের পাটির একটা দাঁত নেই। সে যখন হাসছে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দোকানীর সাথে গল্প করা এই লোকটিই ডোম! কি আশ্চর্য! আমার ধারণা ছিলো ডোম মানেই একজন ভয়ংকর লোক। যার চাপা থাকবে ভাঙ্গা, দাঁড়ি-মোছ থাকবে ছোট ছোট, চোখ দুটোতে রহস্য থাকবে। রতন সরকারকে দেখে আট দশজনের বাইরের কেউ বলে মনে হচ্ছে না। সে চায়ের দোকানদারের সাথে হাসছে, মাথা নেড়ে কথা বলছে।
...
চানখারপুলে আমরা নতুন এসেছি, মাসখানেক হলো। ফিরোজের দোকানে প্রায়ই চা-সিগারেট খেতে আসা হয়। কিছুদিন আগে একটা খুন নিয়ে ফিরোজের সাথে কথা হচ্ছিলো। উত্তরা চার নম্বর সেক্টরে সম্প্রতি বিশাল এক ব্যবসায়ীর ছোট ছেলে ফাহিমকে কে বা কারা খুন করেছে। প্রথমত ফাহিমের মরদেহ কবর দেওয়া হয়। কবর দেওয়ার তিনদিনের মাথায় লাশটি ফের কবর থেকে তোলা হয় ময়নাদতন্তের জন্য।
.
ফিরোজ জানাল, ময়না তদন্তের কাজটা করেছে রতন সরকার। বুকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মারা হয়েছে ফাহিমকে। তার কলিজাটা দুই টুকরা হয়ে গেছে। এসব কথা পত্রিকায় প্রকাশের আগেই রতন তাকে জানিয়েছে। ফিরোজের সাথে রতনের সম্পর্ক খুব ভাল। দীর্ঘদিন থেকে তার দোকানের নিয়মিত কাস্টমার তিনি। লোক হিসেবে খারাপ না তবে নেশা-পানি একটু বেশি করে।
.
ফিরোজের মুখ থেকে রতন সরকারের কথা শোনার পর থেকে আমার ভীষণ ইচ্ছা হতে শুরু করেছে একটা রাত রতনের সাথে মর্গে কাটানোর। লাশ কাটা ঘর আমার কাছে সবসময়ই রহস্যজনক বলে মনে হয়। বাবা যখন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি ছিলেন তখন আমাকেও তিনদিন থাকতে হয়েছিলো। বাবার সাথে মা সবসময়ই ছিলেন। বাবাকে ভর্তির দিনই ডাক্তার বলেছিল ভয়ের কিছু নেই, তেমন কিছু হয়নি। অতিরিক্ত পরিশ্রম-অপুষ্টির কারণে এমন হয়েছে। তিনদিন ইঞ্জেকশন-স্যালাইন চলবে এরপর বাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আমি শুধু খাবার-দাবার, ঔষধ-পাতি আনা এসবের জন্য ছিলাম। আমার এসব বাদে কোন কাজ ছিলো না।
.
সারাদিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াতাম। কাউকে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারও হাতে ব্যান্ডেজ, কারো মাথায় ব্যান্ডেজ। কেউ কেউ মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে আসছে ইমার্জেন্সিতে। কারও মাথা থেতলে গেছে। কেউ মরে পরে আছে ওয়ার্ডের স্ট্রেচারে।
প্রথমদিন এসব দেখে বেশ ভয় লেগেছে। রাত নয়টার পর হাসপাতাল বেশ নিরব হয়ে যায়। ওয়ার্ডের বাইরে হাটতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো চারিদিকে মৃত আত্নারা ঘোরাঘুরি করছে। পিছন থেকে কেউ সাথে সাথে হাটছে, ডান দিক থেকে কেউ ছুটে এলো, আবার বাম দিকে চলে গেল। লাশ ফ্রিজিং ঘরের সামনে গিয়ে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। দরজার বাইরে স্ট্রেচারে মৃত একজন ব্যক্তিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সাদা কাপড়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা, শুধু পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত কাপড়ের বাইরে বের হয়ে আছে। আশে-পাশে আর কেউ ছিলো না। মনে হচ্ছিলো সে এই মুহূর্তেই উঠে দাঁড়াবে এবং আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পরবে। দ্রুত হেটে হাসপাতালের বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলাম।
.
দ্বিতীয় দিন থেকে ভয় খানিক কমেছে। রাত তখন প্রায় দেড়টা, ওয়ার্ডে হাটতে হাটতে এক বয়স্ক সিকিউরিটি গার্ডকে বসে থাকতে দেখলাম। শার্টের পকেটের উপর হলুদ প্ল্যাস্টিকের ফ্রেমে লেখা- ফরিদ মিয়া। ফরিদ মিয়ার সাথে ভাব জমাবার একটা চেষ্টা চালালাম। মিনিট দুয়েক পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন ঘাটলাম, এরমধ্যে রঙ চা এলো। চা ওয়ালাকে ডেকে চা দিতে বললাম। গার্ডের সাথে কথা বলা শুরু হলো চা খাবেন কি না, দিয়ে। সে বলল- ‘খাওয়া যায়।’ আমি একটা সিগারেট জ্বেলে জিজ্ঞাস করলাম- ‘সিগারেট খান?’ সে জানাল খায়। তার দিকে সিগারেটের প্যাক বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- ‘নিন।’ সে বলল- গোল্ডলিফ সে খায় না। চা ওয়ালার কাছে একটা হলিউড সিগারেট নিয়ে জ্বালল।
.
তখন ডিসেম্বরের মাঝামঝি সময় ছিলো। প্রচন্ড শীত। শীত নিয়ে কথা হচ্ছিলো, আমি জিজ্ঞাস করলাম- ‘কাকা শীত লাগে না?’
-- “লাগে। কয়দিন ধরে ভাল শীত পরতেছে।”
-- “কতদিন থেকে আছেন এখানে?”
-- “বছর দশেক তো হবেই।”
-- “আচ্ছা কাকা, হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরটা কোন দিকে।”
-- “এই তো এই গেট দিয়া বের হয়া সোজা উত্তরে গিয়া ডানে।”
-- “বেশি দূরে?”
-- “আরে না, একমিনিটও লাগব না।”
-- “আপনার এই যায়গাটা খুব নিরব, ভয় লাগে না?”
-- “প্রথম প্রথম একটু-আধটু লাগত। এখন লাগে না।”
-- “কখনো কিছু দেখেন নি?”
-- “কতকিছুই তো দেখলাম, ঐসব কিছু না। ওরা ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। ভয় পাইলেই ভয় না পাইলে কিছুই না।”
.
চা-সিগারেটের বিল পরিশোধ করে ফরিদ মিয়াকে বললাম- ‘আমি একটু দেখে আসি?’ ফরিদ মিয়া কিছু একটা ভেবে বলল- ‘এতো রাইতে ঐদিক একা একা যাওয়া ঠিক না।’
-- “কেন?”
-- “রাতে ঐদিকটা নিরব থাকে। তেমন কেউ যায় না। একা একা গেলে ভয় পাইতে পারেন। তাছাড়া রাতে মর্গের সামনে পুলিশও থাকে।”
-- “আমি দেখেই চলে আসব।”
-- “বেশি ইচ্ছা করলে যান। বেশিক্ষণ থাইক্কেন না।”
.
গেট দিয়ে বের হয়ে সোজা উত্তর দিকে আধামিনিট হেটে ডান দিকে মোড় নিতেই মর্গের দেখা পেয়ে গেলাম। ফরিদ মিয়া যেমনটা বলেছিল, আশ-পাশ তেমনই। একদম নিরব। গা ছমছম পরিবেশ। আশে-পাশে কেউ নাই। আমি মর্গের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজার নিচে দিয়ে আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। এই দরজার ভেতরে লুকিয়ে আছে কত কত রহস্য। একবার ইচ্ছা করছে গিয়ে দরজায় টোকা দেই, আরেকবার মনে হচ্ছে না ঠিক হবে না। এমনন সময়- কোত্থেকে যেন একজন পুলিশ ছুটে এসে পেছন থেকে জিজ্ঞাস করল- ‘এইখানে কি?’ হুট করে জিজ্ঞাস করায় থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- ‘নাহ মানে এমনিতেই। ভাল লাগছিলো না তো, হাটতে হাটতে চলে এসেছি।’ পুলিশ সাহেব বললেন- ‘যেমন ভাবে হাটতে হাটতে এসেছেন তেমনভাবে হাটতে হাটতে ফিরে যান।’ আমি কথা না বাড়িয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ফিরে আসলাম।
.
পরের দিন বেশ কয়বার মর্গের সামনে গিয়েছি। দিনের বেলা মর্গের সামনের দিকটায় বেশ হৈচৈ, মানুষের বেশ আনাগোনা থাকে। বিশেষ করে যারা সিগারেট খায় তারা এইদিকটায় বেশি আসে। মর্গের সামনে লম্বা সময় বসে থেকেও ভেতরের কিছুই দেখতে পেলাম না। দরজাটা একবারের জন্যেও খোলা হয়নি।
...
মর্গের ভেতরের পরিবেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার তুমুল, শেষ পর্যন্ত ফিরোজকে বলেই ফেললাম- ‘ফিরোজ ভাই একটা ব্যবস্থা করে দেন না।’ ফিরোজকে মর্গে থাকার ইচ্ছার কথা বলতেই সে চোখ বড় বড় করে আমাকে জিজ্ঞাস করল-
‘মর্গে গিয়া কি করবেন? আমি বললাম- ‘মর্গের ভেতরের পরিবেশটা দেখার খুব ইচ্ছা আমার। ফিরোজ অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘এতো কিছু থাকতে মর্গ দেখার সগ হইল কেন?’ এই কথার কি জবাব দেব? মৃদু গলায় বললাম- ‘থাকে না ভাই একেক জনের একেক ইচ্ছা? এই ধরেন কারো ইচ্ছা হয় সেন্টমার্টিন দেখার৷ কারও হিমালয় পর্বত৷ আবার কারও তাজমহল, আমারও তেমন মর্গের ভেতরটা দেখার খুব সখ।’
-- “যেগুলা বলছেন সেগুলা তো দেখনের জিনিসই, সেগুলা বাদ দিয়া মর্গ দেহনের ইচ্ছা হইল আফনের? এমন সগের কথা জীবনে শুনিনাই।”
-- “ভাই একটা ব্যবস্থা করে দেন না। আপনার সাথে তো তার খুব ভাল সম্পর্ক। আপনি বললে না করবে না।”
.
ফিরোজ মিয়ার মধ্যে আত্ন-অহংকারের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল। ব্যাপার খানা এমন যে, তিনি এক বিশাল বড়লোক আমি তার কাছে অর্থ সাহায্য চেয়েছি। কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফিরোজ মিয়া বলল- আইচ্ছা বইলা দেখমুনে। গত দুই সপ্তাহ ধরে তার মন রক্ষ করে অবশেষে তিনি রতন সরকারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল, তবে আগেই সে বলে নিয়েছে, সে শুধু পরিচয় করিয়ে দিবে, তাকে রাজী আমাকেই করতে হবে।
...
দোকান বন্ধ করতে করতে ফিরোজ বলল, রতন ভাই আমি দুপুরের খানাটা সাইরা আসি আফনেরা কথা কন। রতন মিয়া পুলিশের মতন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- ‘আপনার মর্গ দেখার সখ?’
-- “জ্বী ভাই।”
-- “কেন এইরকম সখ হল?”
-- “মানুষের কত রকম সখ হয় না?”
-- “তা হয়।”
-- “ভাই একটা ব্যবস্থা করা যাবে?”
-- “দেখেন ভাই, আমি সামান্য চাকরী করি। চাইলেই তো আপনাকে নিয়ে যেতে পারব না।”
-- “কোন ব্যবস্থা করা যাবে না?”
-- “আপনার কাছে কি মনে হয় ব্যাপারটা সহজ?”
-- “অবশ্যই না।”
-- “আমি ক্ষুদ্র একজন চাকরিজীবি মানুষ ভাই।”
-- “কিছুই করতে পারবেন না? টাকা-পয়সা লাগলে বলুন আমি দেব।”
-- “আরে ভাই টাকা-পয়সার ব্যাপার না। ব্যাপার টা হচ্ছে আপনাকে কিভাবে নিয়ে যাবো।”
-- “প্লীজ ভাই একটু দেখুন, যদি কোনভাবে সম্ভব হয়। আমি আপনাদের কাজে কোন সমস্যা করব না। চুপচাপ বসে থাকব।”
-- “এতো করে যখন বলছেন, দেখি কি করা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পুলিশের সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। তার সাথে কথা বলে দেখি। আপনার ফোন নম্বরটা দেন।”
.
ফোন নম্বর নিয়ে সে চলে গেল। রতন সরকারের সাথে কথা হবার পর থেকে অপেক্ষা করতে একদমই ভাল লাগছে না। কারো ফোন এলেই মনে হচ্ছে তিনি ফোন করেছে। সপ্তাহ-খানেক এভাবেই কেটে গেল। ফিরোজের দোকানেও রতন সরকারের দেখা নাই। দুই সপ্তাহ চলে গেল। আমি আশা ছেড়ে দিলাম।
...
বেশকিছুদিন থেকে সেমিস্টার ব্রেকের কারণে ভার্সিটি বন্ধ ছিলো। কয়েকদিনের মধ্যেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর হাইস্কুলে পড়া একই কথা, দুই যায়গাতেই পড়াশোনা-নোট ছাড়া আর কোনকিছু নেই। প্রত্যেকটা দিন কোন কোন এসাইনমেন্ট থাকে। এসাইনমেন্ট করতে করতে রতন সরকারের কথা ভুলেই গেলাম।
.
একদিন দুপুর বেলা ক্লাস করছি। এমন সময় মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করতে শুরু করল। ক্লাসে স্যার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেকচার দিচ্ছেন। কোনক্রমে ফোন ধরে বললাম- ‘আমি পরে ফোন করছি।’
.
ক্লাস শেষে দেখলাম নম্বরটা অপরিচিত। আমার ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে তেমন একটা ফোন আসে না। নম্বরটাতে ফোন করলাম। রতন সরকার ফোন ধরে বলল- ‘আমি রতন বলছি, চিনতে পারছেন?’
-- “রতন ভাই আপনি? এতোদিন পর?”
-- “শোনেন খুব কষ্ট করে রমিজ ভাইকে রাজী করাইছি। রাত আটটার দিকে ফিরোজের দোকানের সামনে থাকবেন। সাথে কোন মোবাইল ফোন, ক্যামেরা এইসব আনবেন না।”
.
রতন সরকারের সাথে কথা বলে পুরোনো ইচ্ছাটা আবারও মাথা চারা দিয়ে উঠল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। দ্রুত হাত-মুখি ধুয়ে, খেয়ে- দেয়ে বেরিয়ে পরলাম।
.
রতন সরকার আসল ঠিক সোয়া আটটায়। তার চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। দোকানে বসে ফিরোজকে বলল- ‘কড়া মিষ্টি করে চা দাও।’
চা শেষ করে রতন সরকার একটা সিগারেট জ্বেলে বলল- ‘চলুন।’
.
পুরো পথ আমাদের মধ্যে কোন কথা বার্তা হলো না। হাসপাতালের সামনে এসে রতন সরকার আরও এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালল।
.
হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে সোজা আমরা দুজন চলে এলাম লাশকাটা ঘরের সামনে। আমার কেমন যেন ভয় হতে লাগল। সিগারেট ফেলে রতন সরকার দরজার তালা খুলে আমাকে বলল-
‘ভেতরে ঢুকুন।’
...
মর্গে ঢুকে প্রথমেই একটা বিশ্রী গন্ধে বমি চলে আসার উপক্রম হলো। কোনরকম বমি আটকে, নাক চেপে ধরলাম। রতন সরকার ভেতরে এসে বলল-
‘গন্ধ বেশি লাগছে? পাঁচমিনিট থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। আপনি নাক থেকে হাত সরিয়ে নেন, যত তাড়াতাড়ি হাত সরাবেন তত তাড়াতাড়ি সয়ে যাবে।’ নাক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আবারও বমির উপক্রম হলো, কিন্তু খানিক বাদে সয়ে গেল। রতন সরকার জিজ্ঞাস করল- ‘গন্ধ কি লাগছে এখন?’ আমি বললাম- ‘সামান্য।’
-- “কিছুক্ষণ পর দেখবেন কোন গন্ধই নাই।”
.
রতন সরকার দরজার সামনেই একটা চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। আবছা অন্ধকারে ভেতরের তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যা বোঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে সারিবদ্ধ ভাবে কিছু সাদা কাপড়। এসব কাপড়ের নিচে নিশ্চয়ই লাশ আছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নিরব থমথমে পরিবেশ। মিনিট দশেক পর রতন সরকার জিজ্ঞাস করল- ‘এখনো গন্ধ লাগছে?’ আমার তখন আর গন্ধ লাগছিলো না অথবা গন্ধটা সয়ে গেছে। ইন্দ্রিয় সমূহের মধ্যে নাসিকার কার্যবিধি প্রায়শই ভীষণ অবাক করে আমায়। বাড়ির সামনে থেকে মেইনরোড যেতে সিটি কর্পোরেশনের বিশাল একটা ডাস্টবিন পরে। প্রতিদিন সেখান দিয়ে যাবার সময় বিশ্রী গন্ধে পেট গুলিয়ে ওঠে, বমি আসি আসি করেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাওয়া যায়। ডাস্টবিন থেকে কিছুদূরেই ফিরোজের দোকান। ডাস্টবিন থেকে ফিরোজের দোকান পর্যন্ত হেটে যেতে ১মিনিটেরও কম সময় লাগে। ডাস্টবিন বরাবর সামনে দোকান। মাঝখানে কিছু নেই। এতোটুকু হেটে যেতেই গন্ধ সয়ে যায়। মাঝে মধ্যে অন্যদিক থেকে কেউ চা খেতে এলে নাক ভাঁজ করে বলে ওঠে “কি বিশ্রী গন্ধ বাপ্রে!” অথচ আমার কোন গন্ধই লাগে না। এখানেও হয়েছে তাই। মস্তিস্ক বার বার জানান দিচ্ছে গন্ধ টা সে তার স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে রেখেছে। আপাতত সে তাকে স্মৃতিকোষের প্রান্তে রেখেছে। এই মুহুর্তে গন্ধটা লাগছে না। রতন সরকারকে বললাম- ‘গন্ধটা আগের মতন লাগছে না।’
-- “আপনাকে বলেছিলাম না! কিছুক্ষণ পর আর গন্ধ লাগবে না?”
-- “হ্যাঁ।”
-- “কেমন লাগছে?”
.
ভয় লুকিয়ে বললাম- “বেশ ভাল।”
-- “ভয় লাগছে না?”
-- “এখনো লাগেনি।”
.
রতন সরকার হো হো করে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে আমার বুকের ভেতর টা ধড়ফড় করে উঠল। এমন ভয়ংকর হাসি এর আগে কখনো শুনিনি অথবা সে স্বাভাবিক ভাবেই হাসছে, পরিস্থিতি-অবস্থানের কারনে সেটা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। হাসতে হাসতে রতন সরকার বলল- ‘ভয় না লাগলেই ভাল। তবে মাঝে-মধ্যে পুলিশরাও ভয় পায়। বিশেষ করে যারা নতুন।’
-- “পুলিশকি ভেতরে আসে?”
-- “কখনো আসে কখনো আসে না, তবে একজন ডাক্তার আসেন। ডাক্তার যেভাবে যেখানে কাটতে বলে সেখানে সেভাবে কাটাটাই আমার কাজ।”
-- “ভয় করেনা আপনার?”
-- “ভয়ের কি আছে? সাধারণ ব্যাপার।”
-- “তারপরও কাটা-ছেঁড়ার ব্যাপার!”
-- “হা হা হা হা! কসাইদেরকে গরু-ছাগল জবাই দিতে দেখেন নাই? পশুগুলো কিভাবে ছটফট করে এরপরও জবাই দেওয়া হয়। মানুষই তো ওদের মারে। চামড়া ছাড়িয়ে মাংস, কলিজা, কিডনি, লিভার সব পিস পিস করে কাটে আমাদের কাজটাও ওই একই রকম, বরং সহজ। কসাইরা জীবিত প্রাণীদের হত্যা করে এরপর কাটাকাটি করে আমরা মৃত মানুষ কাটাকাটি করি।”
-- “তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি বেশ শিক্ষিত। কোন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন আপনি?”
-- “এসএসসি শেষ করে পড়াশোনা বাদ দিছি।”
-- “আপনি বেশ শুদ্ধ-ভাষায় কথা বলেন।”
-- “কথা দিয়ে তো আর পেট চলবে না ভাই। বাপ-দাদা কাজের একটা গতি করে দিয়ে গিয়েছিলো বলেই, বৌ-বাচ্চা নিয়ে বেঁচে আছি।”
...
রতন সরকার ঘরের বাতি জ্বেলে দিলো। এতোক্ষণ ঘরের অন্ধকার ছিলো। বাতি জ্বেলে দেবার পর ঘরের ভেতরটা একদম পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা ডেড বডিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সাদা কাপড়ে তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা শুধু পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত কাপড়ের বাইরে বেরিয়ে আছে। সারা শরীরে একটা কাঁপুনি অনুভব করলাম। পশমগুলো সব দাঁড়িয়ে গেল। বিশ্রী গন্ধটা আবারও নাকে এসে লাগল, বমি চলে আসার উপক্রম হলো। রতন সরকার বলে উঠল- ‘আরে করছেন কি? সর্বনাশ করবেন দেখি!’ নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- ‘গন্ধটা আবার নাকে এসে লাগল, দুঃখিত।’ নিজের উপর বড্ড রাগ হলো আমার। নিজ ইচ্ছায় এখানে এসেছি। আসার জন্য ছটফট করেছি। কত অনুরোধের পর এতোদিন পর আসতে পারলাম, এখন তাহলে ভয় হচ্ছে কেন?
.
রতন সরকার চিন্তিত মুখে বলল- ‘বমি-টমি করে বসবেন নাতো?’ তাৎক্ষণিক কি বলব বুঝতে পারছিলাম না, বমির ব্যপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। মৃদু গলায় বললাম- ‘দুঃখিত ভাই।’
-- “জানেন তো এইসব কারণে কাউকে নিয়ে আসতে ভয় হয়। প্রতিদিন কত ডেড বডি আসে, এক্সিডেন্ট হয়ে মরা লাশ, খুন মাথা থেতলে যাওয়া লাশ, নদীর পানিতে ভেসে আসা গলে যাওয়া লাশ, ফাঁসি নেওয়া লাশ। লাশের গন্ধ সয়ে গেছে অনেক আগেই কিন্তু বমি করলে মুশকিলে পড়ব।”
.
আমি চুপ করে রইলাম। রতন সরকার খানিক থেমে বলতে শুরু করল- ‘একবার এক পুলিশের ভাগ্নে এলো। স্যারকে বলেছিলাম স্যার সহ্য করতে পারবে তো! স্যার বলল- পারবে, বেশ সাহসী ছেলে। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই গড়গড় করে বমি করে দিয়ে ফিট হয়ে পরে গেল। সে কি বিশ্রী অবস্থা! পরে সেদিনের মতন কাজ বন্ধ করে সারারাত সেই ছেলের পেছনেই চলে গেল। সাবধান এরকম করবেন না। লাশের গন্ধ সয়ে গেছে বহু বছর আগে, বমির গন্ধ কিন্তু সইতে পারব না। তাছাড়া পরিস্কার করবে কে ওসব! পচা-গলা লাশের গন্ধের চাইতে বমির গন্ধ শতগুণ বেশি খারাপ।’
...
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। রতন সরকার আমাকে বলল- ‘আমি একটু বাইরে যাব। আপনি যাবেন নাকি থাকবেন এখানেই?’ এই ঘরে আমি একা থাকব! একেবারেই অসম্ভব। রতন সরকার জিজ্ঞাস করার সাথে সাথেই বললাম- ‘আমিও যাবো।’ দরজা বন্ধ করতে করতে রতন সরকার বলল- ‘চলুন।’
.
কিছুদূর হাটার পর রতন সরকারের ফোনে একটা ফোন এলো। খুব সম্ভবত পুলিশের ফোন। সে বলল- ‘কোন টা স্যার? ঐযে নারায়ণ গঞ্জের মেয়েটা। হু ফাঁসি নিয়ে মরেছে যে? হ্যাঁ ডেডবডি রেডি আছে। ডাক্তার সাহেব এখনো আসেনি। আসলে ধরব।’ ফোন রেখে সে আমাকে বলল-
‘গতকাল একটা ডেডবডি এসেছে। ২২বছরের এক যুবতী মেয়ে। কে জানে কি কারণে পেটে বাচ্চা সহ ফাঁসি নিয়ে মরল।’
.
কিছুদূর যাবার পর লক্ষ্য করলাম, রতন সরকার কোমড় থেকে ২৫০এম এল সাইজের একটা বোতল বের করে এক ঢোকে পুরো বোতল শেষ করে ফেলে দিলো। এরপর আমরা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। রতন সরকার চায়ের দোকানদারকে কড়া মিষ্টি করে দুইকাপ চা দিতে বলে একটা সিগারেট জ্বালল। দিনে আমি সাত-আট কাপ চা খাই, অথচ এই মুহূর্তে মুখ দিয়ে চা ঢুকছে না। খুব ঘেন্না হচ্ছে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মনে হলো বমি চলে আসবে। মর্গের ভেতরের গন্ধগুলো মনে হলো ভড়ভড় করে চায়ের সাথে পেটে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থেকে একটা সিগারেট জ্বাললাম কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সিগারেটেও রুচি হচ্ছে না।
.
চায়ের দোকান থেকে উঠে হাসপাতালের গেটের ভেতর ঢুকতেই রতন সরকার বলল, আপনার যা অবস্থা দেখছি মনে হচ্ছে বমি করেই ছারবেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট জ্বেলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে রতন সরকার বলল- ‘নিন দু-তিনটা টান দিন।’ আমি সিগারেটে টান দিলাম এবং এর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। হাটতে গিয়ে পা ফেলার সময় কিছু একটা অসংগতি লক্ষ্য করলাম, কিন্তু সেটা ঠিক কি বুঝতে পারলাম না। মিনিট খানেকের মধ্যে আমার ভীষণ চা খেতে ইচ্ছা করল, সাথে একটা সিগারেট। রতন সরকারকে বললাম- ‘ভাই আমি এককাপ চা খাবো।’ রতন সরকার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু করে হাসল। তার হাসির ধরন কেন যেন আমার রহস্যজনক মনে হলো। হাসিমুখেই সে বলল- ‘মাত্রই না চায়ের দোকান থেকে এলাম, আপনিতো পুরো কাপ চা ই শেষ করলেন না।’ কথা ঠিক। অর্ধেকটাও শেষ করতে পারি নি। তাহলে এখন আবার চা খেতে ইচ্ছা করছে কেন? কেন ইচ্ছা করছে? ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। রতন সরকার বলে উঠল- ‘ডাক্তার সাহেবি এখনো আসেনি। তিনি আসার আগ পর্যন্ত সময় আছে। চলুন।’
আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আবারও চায়ের দোকানে এসে বসলাম। রতন সরকার দুই কাপ চা দিতে বলে আমাকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দিলো। আমি লক্ষ্য করলাম, ইশারাতে দোকানদারের সাথে সে কি যেন বলছে এবং দুজনই শব্দ করে হাসছে। আমার মনে হলো- তারা আমাকে নিয়েই হাসছে, কিন্তু কেন হাসছে? বুঝতে পারলাম না।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রতন সরকার আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘আপনি না বললেন চা খাবেন? চাতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খাচ্ছেন না কেন?’ চায়ের কথা মনে পরল। সেই তো আমরা তো মর্গের দিকে যাচ্ছিলাম, আমার চা খেতে ইচ্ছা হলো জন্যেই তো আবারও ফিরে এলাম, কিন্তু চায়ের কথা কি করে ভুলে গেলাম? চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলাম। হাতের সিগারেট ততক্ষণে নিভে গেছে। লক্ষ্য না করে টান দিলাম কোন ধোয়া বের হলো না। দোকানদার গলা কানে এলো- “এ গেছে রতন দা একদম গেছে।” কে গেছে কেন গেছে কিভাবে গেল আমি বুঝতে পারলাম না। রতন সরকারকে জিজ্ঞাস করলাম- ‘কে গেল?’ রতন সরকার বলল- ‘ও কিছু না। চা শেষ করেন যেতে হবে।’
...
মর্গের ভেতরে বসে আছি। ঘরের ভেতরের লাশগুলোকে এখন মনে হচ্ছে জীবিত। এইতো তারা সারাদিন নানা কাজ-কর্ম করল। ছুটোছুটি করল। এখন গায়ে সাদা কাথা গায় দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কাথাগুলো একটু বেশিই সাদা। এতো সাদা কাপড় আগে আমি দেখি নি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। চেয়ার থেকে উঠে একজনের পাশে গিয়ে বসলাম। ঘরের ভেতরটায় খুব ঠান্ডা। আশে-পাশে একটা সাদা কাথা খুজলাম, কিন্তু পেলাম না। একটা বালিশও বিশেষ প্রয়োজন। বালিশ ছাড়াকি এই শক্ত মেঝেতে মাথা রেখে ঘুমানো যায়! কাথা-বালিশ সব কোথায়? আমি যখন কাথা-বালিশ খুঁজতে শুরু করলাম, কে একজন যেন বলে উঠল- ‘সর্বনাশ! করছেন টা কি আপনি? পাগল করে ছাড়বেন দেখছি। আসুন, চলে আসুন এইদিকে।’ বলার পর আমার হাত ধরে হাটতে শুরু করল। আমি অন্ধের মত তাকে অনুসরণ করলাম। কয়েক সেকেন্ড পর সে আমাকে কিছু একটাতে বসিয়ে দিলো। আমি চোখ বন্ধ করে থাকলাম। যে আমাকে নিয়ে আসল সে আবার বলল- ‘কিছুক্ষণ এখানে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
...
চানখারপুলে আমরা নতুন এসেছি, মাসখানেক হলো। ফিরোজের দোকানে প্রায়ই চা-সিগারেট খেতে আসা হয়। কিছুদিন আগে একটা খুন নিয়ে ফিরোজের সাথে কথা হচ্ছিলো। উত্তরা চার নম্বর সেক্টরে সম্প্রতি বিশাল এক ব্যবসায়ীর ছোট ছেলে ফাহিমকে কে বা কারা খুন করেছে। প্রথমত ফাহিমের মরদেহ কবর দেওয়া হয়। কবর দেওয়ার তিনদিনের মাথায় লাশটি ফের কবর থেকে তোলা হয় ময়নাদতন্তের জন্য।
.
ফিরোজ জানাল, ময়না তদন্তের কাজটা করেছে রতন সরকার। বুকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মারা হয়েছে ফাহিমকে। তার কলিজাটা দুই টুকরা হয়ে গেছে। এসব কথা পত্রিকায় প্রকাশের আগেই রতন তাকে জানিয়েছে। ফিরোজের সাথে রতনের সম্পর্ক খুব ভাল। দীর্ঘদিন থেকে তার দোকানের নিয়মিত কাস্টমার তিনি। লোক হিসেবে খারাপ না তবে নেশা-পানি একটু বেশি করে।
.
ফিরোজের মুখ থেকে রতন সরকারের কথা শোনার পর থেকে আমার ভীষণ ইচ্ছা হতে শুরু করেছে একটা রাত রতনের সাথে মর্গে কাটানোর। লাশ কাটা ঘর আমার কাছে সবসময়ই রহস্যজনক বলে মনে হয়। বাবা যখন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি ছিলেন তখন আমাকেও তিনদিন থাকতে হয়েছিলো। বাবার সাথে মা সবসময়ই ছিলেন। বাবাকে ভর্তির দিনই ডাক্তার বলেছিল ভয়ের কিছু নেই, তেমন কিছু হয়নি। অতিরিক্ত পরিশ্রম-অপুষ্টির কারণে এমন হয়েছে। তিনদিন ইঞ্জেকশন-স্যালাইন চলবে এরপর বাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আমি শুধু খাবার-দাবার, ঔষধ-পাতি আনা এসবের জন্য ছিলাম। আমার এসব বাদে কোন কাজ ছিলো না।
.
সারাদিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াতাম। কাউকে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারও হাতে ব্যান্ডেজ, কারো মাথায় ব্যান্ডেজ। কেউ কেউ মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে আসছে ইমার্জেন্সিতে। কারও মাথা থেতলে গেছে। কেউ মরে পরে আছে ওয়ার্ডের স্ট্রেচারে।
প্রথমদিন এসব দেখে বেশ ভয় লেগেছে। রাত নয়টার পর হাসপাতাল বেশ নিরব হয়ে যায়। ওয়ার্ডের বাইরে হাটতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো চারিদিকে মৃত আত্নারা ঘোরাঘুরি করছে। পিছন থেকে কেউ সাথে সাথে হাটছে, ডান দিক থেকে কেউ ছুটে এলো, আবার বাম দিকে চলে গেল। লাশ ফ্রিজিং ঘরের সামনে গিয়ে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। দরজার বাইরে স্ট্রেচারে মৃত একজন ব্যক্তিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সাদা কাপড়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা, শুধু পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত কাপড়ের বাইরে বের হয়ে আছে। আশে-পাশে আর কেউ ছিলো না। মনে হচ্ছিলো সে এই মুহূর্তেই উঠে দাঁড়াবে এবং আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পরবে। দ্রুত হেটে হাসপাতালের বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলাম।
.
দ্বিতীয় দিন থেকে ভয় খানিক কমেছে। রাত তখন প্রায় দেড়টা, ওয়ার্ডে হাটতে হাটতে এক বয়স্ক সিকিউরিটি গার্ডকে বসে থাকতে দেখলাম। শার্টের পকেটের উপর হলুদ প্ল্যাস্টিকের ফ্রেমে লেখা- ফরিদ মিয়া। ফরিদ মিয়ার সাথে ভাব জমাবার একটা চেষ্টা চালালাম। মিনিট দুয়েক পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন ঘাটলাম, এরমধ্যে রঙ চা এলো। চা ওয়ালাকে ডেকে চা দিতে বললাম। গার্ডের সাথে কথা বলা শুরু হলো চা খাবেন কি না, দিয়ে। সে বলল- ‘খাওয়া যায়।’ আমি একটা সিগারেট জ্বেলে জিজ্ঞাস করলাম- ‘সিগারেট খান?’ সে জানাল খায়। তার দিকে সিগারেটের প্যাক বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- ‘নিন।’ সে বলল- গোল্ডলিফ সে খায় না। চা ওয়ালার কাছে একটা হলিউড সিগারেট নিয়ে জ্বালল।
.
তখন ডিসেম্বরের মাঝামঝি সময় ছিলো। প্রচন্ড শীত। শীত নিয়ে কথা হচ্ছিলো, আমি জিজ্ঞাস করলাম- ‘কাকা শীত লাগে না?’
-- “লাগে। কয়দিন ধরে ভাল শীত পরতেছে।”
-- “কতদিন থেকে আছেন এখানে?”
-- “বছর দশেক তো হবেই।”
-- “আচ্ছা কাকা, হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরটা কোন দিকে।”
-- “এই তো এই গেট দিয়া বের হয়া সোজা উত্তরে গিয়া ডানে।”
-- “বেশি দূরে?”
-- “আরে না, একমিনিটও লাগব না।”
-- “আপনার এই যায়গাটা খুব নিরব, ভয় লাগে না?”
-- “প্রথম প্রথম একটু-আধটু লাগত। এখন লাগে না।”
-- “কখনো কিছু দেখেন নি?”
-- “কতকিছুই তো দেখলাম, ঐসব কিছু না। ওরা ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। ভয় পাইলেই ভয় না পাইলে কিছুই না।”
.
চা-সিগারেটের বিল পরিশোধ করে ফরিদ মিয়াকে বললাম- ‘আমি একটু দেখে আসি?’ ফরিদ মিয়া কিছু একটা ভেবে বলল- ‘এতো রাইতে ঐদিক একা একা যাওয়া ঠিক না।’
-- “কেন?”
-- “রাতে ঐদিকটা নিরব থাকে। তেমন কেউ যায় না। একা একা গেলে ভয় পাইতে পারেন। তাছাড়া রাতে মর্গের সামনে পুলিশও থাকে।”
-- “আমি দেখেই চলে আসব।”
-- “বেশি ইচ্ছা করলে যান। বেশিক্ষণ থাইক্কেন না।”
.
গেট দিয়ে বের হয়ে সোজা উত্তর দিকে আধামিনিট হেটে ডান দিকে মোড় নিতেই মর্গের দেখা পেয়ে গেলাম। ফরিদ মিয়া যেমনটা বলেছিল, আশ-পাশ তেমনই। একদম নিরব। গা ছমছম পরিবেশ। আশে-পাশে কেউ নাই। আমি মর্গের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজার নিচে দিয়ে আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। এই দরজার ভেতরে লুকিয়ে আছে কত কত রহস্য। একবার ইচ্ছা করছে গিয়ে দরজায় টোকা দেই, আরেকবার মনে হচ্ছে না ঠিক হবে না। এমনন সময়- কোত্থেকে যেন একজন পুলিশ ছুটে এসে পেছন থেকে জিজ্ঞাস করল- ‘এইখানে কি?’ হুট করে জিজ্ঞাস করায় থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- ‘নাহ মানে এমনিতেই। ভাল লাগছিলো না তো, হাটতে হাটতে চলে এসেছি।’ পুলিশ সাহেব বললেন- ‘যেমন ভাবে হাটতে হাটতে এসেছেন তেমনভাবে হাটতে হাটতে ফিরে যান।’ আমি কথা না বাড়িয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ফিরে আসলাম।
.
পরের দিন বেশ কয়বার মর্গের সামনে গিয়েছি। দিনের বেলা মর্গের সামনের দিকটায় বেশ হৈচৈ, মানুষের বেশ আনাগোনা থাকে। বিশেষ করে যারা সিগারেট খায় তারা এইদিকটায় বেশি আসে। মর্গের সামনে লম্বা সময় বসে থেকেও ভেতরের কিছুই দেখতে পেলাম না। দরজাটা একবারের জন্যেও খোলা হয়নি।
...
মর্গের ভেতরের পরিবেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার তুমুল, শেষ পর্যন্ত ফিরোজকে বলেই ফেললাম- ‘ফিরোজ ভাই একটা ব্যবস্থা করে দেন না।’ ফিরোজকে মর্গে থাকার ইচ্ছার কথা বলতেই সে চোখ বড় বড় করে আমাকে জিজ্ঞাস করল-
‘মর্গে গিয়া কি করবেন? আমি বললাম- ‘মর্গের ভেতরের পরিবেশটা দেখার খুব ইচ্ছা আমার। ফিরোজ অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘এতো কিছু থাকতে মর্গ দেখার সগ হইল কেন?’ এই কথার কি জবাব দেব? মৃদু গলায় বললাম- ‘থাকে না ভাই একেক জনের একেক ইচ্ছা? এই ধরেন কারো ইচ্ছা হয় সেন্টমার্টিন দেখার৷ কারও হিমালয় পর্বত৷ আবার কারও তাজমহল, আমারও তেমন মর্গের ভেতরটা দেখার খুব সখ।’
-- “যেগুলা বলছেন সেগুলা তো দেখনের জিনিসই, সেগুলা বাদ দিয়া মর্গ দেহনের ইচ্ছা হইল আফনের? এমন সগের কথা জীবনে শুনিনাই।”
-- “ভাই একটা ব্যবস্থা করে দেন না। আপনার সাথে তো তার খুব ভাল সম্পর্ক। আপনি বললে না করবে না।”
.
ফিরোজ মিয়ার মধ্যে আত্ন-অহংকারের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল। ব্যাপার খানা এমন যে, তিনি এক বিশাল বড়লোক আমি তার কাছে অর্থ সাহায্য চেয়েছি। কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফিরোজ মিয়া বলল- আইচ্ছা বইলা দেখমুনে। গত দুই সপ্তাহ ধরে তার মন রক্ষ করে অবশেষে তিনি রতন সরকারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল, তবে আগেই সে বলে নিয়েছে, সে শুধু পরিচয় করিয়ে দিবে, তাকে রাজী আমাকেই করতে হবে।
...
দোকান বন্ধ করতে করতে ফিরোজ বলল, রতন ভাই আমি দুপুরের খানাটা সাইরা আসি আফনেরা কথা কন। রতন মিয়া পুলিশের মতন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- ‘আপনার মর্গ দেখার সখ?’
-- “জ্বী ভাই।”
-- “কেন এইরকম সখ হল?”
-- “মানুষের কত রকম সখ হয় না?”
-- “তা হয়।”
-- “ভাই একটা ব্যবস্থা করা যাবে?”
-- “দেখেন ভাই, আমি সামান্য চাকরী করি। চাইলেই তো আপনাকে নিয়ে যেতে পারব না।”
-- “কোন ব্যবস্থা করা যাবে না?”
-- “আপনার কাছে কি মনে হয় ব্যাপারটা সহজ?”
-- “অবশ্যই না।”
-- “আমি ক্ষুদ্র একজন চাকরিজীবি মানুষ ভাই।”
-- “কিছুই করতে পারবেন না? টাকা-পয়সা লাগলে বলুন আমি দেব।”
-- “আরে ভাই টাকা-পয়সার ব্যাপার না। ব্যাপার টা হচ্ছে আপনাকে কিভাবে নিয়ে যাবো।”
-- “প্লীজ ভাই একটু দেখুন, যদি কোনভাবে সম্ভব হয়। আমি আপনাদের কাজে কোন সমস্যা করব না। চুপচাপ বসে থাকব।”
-- “এতো করে যখন বলছেন, দেখি কি করা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পুলিশের সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। তার সাথে কথা বলে দেখি। আপনার ফোন নম্বরটা দেন।”
.
ফোন নম্বর নিয়ে সে চলে গেল। রতন সরকারের সাথে কথা হবার পর থেকে অপেক্ষা করতে একদমই ভাল লাগছে না। কারো ফোন এলেই মনে হচ্ছে তিনি ফোন করেছে। সপ্তাহ-খানেক এভাবেই কেটে গেল। ফিরোজের দোকানেও রতন সরকারের দেখা নাই। দুই সপ্তাহ চলে গেল। আমি আশা ছেড়ে দিলাম।
...
বেশকিছুদিন থেকে সেমিস্টার ব্রেকের কারণে ভার্সিটি বন্ধ ছিলো। কয়েকদিনের মধ্যেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর হাইস্কুলে পড়া একই কথা, দুই যায়গাতেই পড়াশোনা-নোট ছাড়া আর কোনকিছু নেই। প্রত্যেকটা দিন কোন কোন এসাইনমেন্ট থাকে। এসাইনমেন্ট করতে করতে রতন সরকারের কথা ভুলেই গেলাম।
.
একদিন দুপুর বেলা ক্লাস করছি। এমন সময় মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করতে শুরু করল। ক্লাসে স্যার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেকচার দিচ্ছেন। কোনক্রমে ফোন ধরে বললাম- ‘আমি পরে ফোন করছি।’
.
ক্লাস শেষে দেখলাম নম্বরটা অপরিচিত। আমার ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে তেমন একটা ফোন আসে না। নম্বরটাতে ফোন করলাম। রতন সরকার ফোন ধরে বলল- ‘আমি রতন বলছি, চিনতে পারছেন?’
-- “রতন ভাই আপনি? এতোদিন পর?”
-- “শোনেন খুব কষ্ট করে রমিজ ভাইকে রাজী করাইছি। রাত আটটার দিকে ফিরোজের দোকানের সামনে থাকবেন। সাথে কোন মোবাইল ফোন, ক্যামেরা এইসব আনবেন না।”
.
রতন সরকারের সাথে কথা বলে পুরোনো ইচ্ছাটা আবারও মাথা চারা দিয়ে উঠল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। দ্রুত হাত-মুখি ধুয়ে, খেয়ে- দেয়ে বেরিয়ে পরলাম।
.
রতন সরকার আসল ঠিক সোয়া আটটায়। তার চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। দোকানে বসে ফিরোজকে বলল- ‘কড়া মিষ্টি করে চা দাও।’
চা শেষ করে রতন সরকার একটা সিগারেট জ্বেলে বলল- ‘চলুন।’
.
পুরো পথ আমাদের মধ্যে কোন কথা বার্তা হলো না। হাসপাতালের সামনে এসে রতন সরকার আরও এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালল।
.
হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে সোজা আমরা দুজন চলে এলাম লাশকাটা ঘরের সামনে। আমার কেমন যেন ভয় হতে লাগল। সিগারেট ফেলে রতন সরকার দরজার তালা খুলে আমাকে বলল-
‘ভেতরে ঢুকুন।’
...
মর্গে ঢুকে প্রথমেই একটা বিশ্রী গন্ধে বমি চলে আসার উপক্রম হলো। কোনরকম বমি আটকে, নাক চেপে ধরলাম। রতন সরকার ভেতরে এসে বলল-
‘গন্ধ বেশি লাগছে? পাঁচমিনিট থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। আপনি নাক থেকে হাত সরিয়ে নেন, যত তাড়াতাড়ি হাত সরাবেন তত তাড়াতাড়ি সয়ে যাবে।’ নাক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আবারও বমির উপক্রম হলো, কিন্তু খানিক বাদে সয়ে গেল। রতন সরকার জিজ্ঞাস করল- ‘গন্ধ কি লাগছে এখন?’ আমি বললাম- ‘সামান্য।’
-- “কিছুক্ষণ পর দেখবেন কোন গন্ধই নাই।”
.
রতন সরকার দরজার সামনেই একটা চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। আবছা অন্ধকারে ভেতরের তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যা বোঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে সারিবদ্ধ ভাবে কিছু সাদা কাপড়। এসব কাপড়ের নিচে নিশ্চয়ই লাশ আছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নিরব থমথমে পরিবেশ। মিনিট দশেক পর রতন সরকার জিজ্ঞাস করল- ‘এখনো গন্ধ লাগছে?’ আমার তখন আর গন্ধ লাগছিলো না অথবা গন্ধটা সয়ে গেছে। ইন্দ্রিয় সমূহের মধ্যে নাসিকার কার্যবিধি প্রায়শই ভীষণ অবাক করে আমায়। বাড়ির সামনে থেকে মেইনরোড যেতে সিটি কর্পোরেশনের বিশাল একটা ডাস্টবিন পরে। প্রতিদিন সেখান দিয়ে যাবার সময় বিশ্রী গন্ধে পেট গুলিয়ে ওঠে, বমি আসি আসি করেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাওয়া যায়। ডাস্টবিন থেকে কিছুদূরেই ফিরোজের দোকান। ডাস্টবিন থেকে ফিরোজের দোকান পর্যন্ত হেটে যেতে ১মিনিটেরও কম সময় লাগে। ডাস্টবিন বরাবর সামনে দোকান। মাঝখানে কিছু নেই। এতোটুকু হেটে যেতেই গন্ধ সয়ে যায়। মাঝে মধ্যে অন্যদিক থেকে কেউ চা খেতে এলে নাক ভাঁজ করে বলে ওঠে “কি বিশ্রী গন্ধ বাপ্রে!” অথচ আমার কোন গন্ধই লাগে না। এখানেও হয়েছে তাই। মস্তিস্ক বার বার জানান দিচ্ছে গন্ধ টা সে তার স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে রেখেছে। আপাতত সে তাকে স্মৃতিকোষের প্রান্তে রেখেছে। এই মুহুর্তে গন্ধটা লাগছে না। রতন সরকারকে বললাম- ‘গন্ধটা আগের মতন লাগছে না।’
-- “আপনাকে বলেছিলাম না! কিছুক্ষণ পর আর গন্ধ লাগবে না?”
-- “হ্যাঁ।”
-- “কেমন লাগছে?”
.
ভয় লুকিয়ে বললাম- “বেশ ভাল।”
-- “ভয় লাগছে না?”
-- “এখনো লাগেনি।”
.
রতন সরকার হো হো করে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে আমার বুকের ভেতর টা ধড়ফড় করে উঠল। এমন ভয়ংকর হাসি এর আগে কখনো শুনিনি অথবা সে স্বাভাবিক ভাবেই হাসছে, পরিস্থিতি-অবস্থানের কারনে সেটা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। হাসতে হাসতে রতন সরকার বলল- ‘ভয় না লাগলেই ভাল। তবে মাঝে-মধ্যে পুলিশরাও ভয় পায়। বিশেষ করে যারা নতুন।’
-- “পুলিশকি ভেতরে আসে?”
-- “কখনো আসে কখনো আসে না, তবে একজন ডাক্তার আসেন। ডাক্তার যেভাবে যেখানে কাটতে বলে সেখানে সেভাবে কাটাটাই আমার কাজ।”
-- “ভয় করেনা আপনার?”
-- “ভয়ের কি আছে? সাধারণ ব্যাপার।”
-- “তারপরও কাটা-ছেঁড়ার ব্যাপার!”
-- “হা হা হা হা! কসাইদেরকে গরু-ছাগল জবাই দিতে দেখেন নাই? পশুগুলো কিভাবে ছটফট করে এরপরও জবাই দেওয়া হয়। মানুষই তো ওদের মারে। চামড়া ছাড়িয়ে মাংস, কলিজা, কিডনি, লিভার সব পিস পিস করে কাটে আমাদের কাজটাও ওই একই রকম, বরং সহজ। কসাইরা জীবিত প্রাণীদের হত্যা করে এরপর কাটাকাটি করে আমরা মৃত মানুষ কাটাকাটি করি।”
-- “তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি বেশ শিক্ষিত। কোন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন আপনি?”
-- “এসএসসি শেষ করে পড়াশোনা বাদ দিছি।”
-- “আপনি বেশ শুদ্ধ-ভাষায় কথা বলেন।”
-- “কথা দিয়ে তো আর পেট চলবে না ভাই। বাপ-দাদা কাজের একটা গতি করে দিয়ে গিয়েছিলো বলেই, বৌ-বাচ্চা নিয়ে বেঁচে আছি।”
...
রতন সরকার ঘরের বাতি জ্বেলে দিলো। এতোক্ষণ ঘরের অন্ধকার ছিলো। বাতি জ্বেলে দেবার পর ঘরের ভেতরটা একদম পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা ডেড বডিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সাদা কাপড়ে তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা শুধু পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত কাপড়ের বাইরে বেরিয়ে আছে। সারা শরীরে একটা কাঁপুনি অনুভব করলাম। পশমগুলো সব দাঁড়িয়ে গেল। বিশ্রী গন্ধটা আবারও নাকে এসে লাগল, বমি চলে আসার উপক্রম হলো। রতন সরকার বলে উঠল- ‘আরে করছেন কি? সর্বনাশ করবেন দেখি!’ নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- ‘গন্ধটা আবার নাকে এসে লাগল, দুঃখিত।’ নিজের উপর বড্ড রাগ হলো আমার। নিজ ইচ্ছায় এখানে এসেছি। আসার জন্য ছটফট করেছি। কত অনুরোধের পর এতোদিন পর আসতে পারলাম, এখন তাহলে ভয় হচ্ছে কেন?
.
রতন সরকার চিন্তিত মুখে বলল- ‘বমি-টমি করে বসবেন নাতো?’ তাৎক্ষণিক কি বলব বুঝতে পারছিলাম না, বমির ব্যপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। মৃদু গলায় বললাম- ‘দুঃখিত ভাই।’
-- “জানেন তো এইসব কারণে কাউকে নিয়ে আসতে ভয় হয়। প্রতিদিন কত ডেড বডি আসে, এক্সিডেন্ট হয়ে মরা লাশ, খুন মাথা থেতলে যাওয়া লাশ, নদীর পানিতে ভেসে আসা গলে যাওয়া লাশ, ফাঁসি নেওয়া লাশ। লাশের গন্ধ সয়ে গেছে অনেক আগেই কিন্তু বমি করলে মুশকিলে পড়ব।”
.
আমি চুপ করে রইলাম। রতন সরকার খানিক থেমে বলতে শুরু করল- ‘একবার এক পুলিশের ভাগ্নে এলো। স্যারকে বলেছিলাম স্যার সহ্য করতে পারবে তো! স্যার বলল- পারবে, বেশ সাহসী ছেলে। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই গড়গড় করে বমি করে দিয়ে ফিট হয়ে পরে গেল। সে কি বিশ্রী অবস্থা! পরে সেদিনের মতন কাজ বন্ধ করে সারারাত সেই ছেলের পেছনেই চলে গেল। সাবধান এরকম করবেন না। লাশের গন্ধ সয়ে গেছে বহু বছর আগে, বমির গন্ধ কিন্তু সইতে পারব না। তাছাড়া পরিস্কার করবে কে ওসব! পচা-গলা লাশের গন্ধের চাইতে বমির গন্ধ শতগুণ বেশি খারাপ।’
...
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। রতন সরকার আমাকে বলল- ‘আমি একটু বাইরে যাব। আপনি যাবেন নাকি থাকবেন এখানেই?’ এই ঘরে আমি একা থাকব! একেবারেই অসম্ভব। রতন সরকার জিজ্ঞাস করার সাথে সাথেই বললাম- ‘আমিও যাবো।’ দরজা বন্ধ করতে করতে রতন সরকার বলল- ‘চলুন।’
.
কিছুদূর হাটার পর রতন সরকারের ফোনে একটা ফোন এলো। খুব সম্ভবত পুলিশের ফোন। সে বলল- ‘কোন টা স্যার? ঐযে নারায়ণ গঞ্জের মেয়েটা। হু ফাঁসি নিয়ে মরেছে যে? হ্যাঁ ডেডবডি রেডি আছে। ডাক্তার সাহেব এখনো আসেনি। আসলে ধরব।’ ফোন রেখে সে আমাকে বলল-
‘গতকাল একটা ডেডবডি এসেছে। ২২বছরের এক যুবতী মেয়ে। কে জানে কি কারণে পেটে বাচ্চা সহ ফাঁসি নিয়ে মরল।’
.
কিছুদূর যাবার পর লক্ষ্য করলাম, রতন সরকার কোমড় থেকে ২৫০এম এল সাইজের একটা বোতল বের করে এক ঢোকে পুরো বোতল শেষ করে ফেলে দিলো। এরপর আমরা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। রতন সরকার চায়ের দোকানদারকে কড়া মিষ্টি করে দুইকাপ চা দিতে বলে একটা সিগারেট জ্বালল। দিনে আমি সাত-আট কাপ চা খাই, অথচ এই মুহূর্তে মুখ দিয়ে চা ঢুকছে না। খুব ঘেন্না হচ্ছে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মনে হলো বমি চলে আসবে। মর্গের ভেতরের গন্ধগুলো মনে হলো ভড়ভড় করে চায়ের সাথে পেটে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থেকে একটা সিগারেট জ্বাললাম কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সিগারেটেও রুচি হচ্ছে না।
.
চায়ের দোকান থেকে উঠে হাসপাতালের গেটের ভেতর ঢুকতেই রতন সরকার বলল, আপনার যা অবস্থা দেখছি মনে হচ্ছে বমি করেই ছারবেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট জ্বেলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে রতন সরকার বলল- ‘নিন দু-তিনটা টান দিন।’ আমি সিগারেটে টান দিলাম এবং এর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। হাটতে গিয়ে পা ফেলার সময় কিছু একটা অসংগতি লক্ষ্য করলাম, কিন্তু সেটা ঠিক কি বুঝতে পারলাম না। মিনিট খানেকের মধ্যে আমার ভীষণ চা খেতে ইচ্ছা করল, সাথে একটা সিগারেট। রতন সরকারকে বললাম- ‘ভাই আমি এককাপ চা খাবো।’ রতন সরকার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু করে হাসল। তার হাসির ধরন কেন যেন আমার রহস্যজনক মনে হলো। হাসিমুখেই সে বলল- ‘মাত্রই না চায়ের দোকান থেকে এলাম, আপনিতো পুরো কাপ চা ই শেষ করলেন না।’ কথা ঠিক। অর্ধেকটাও শেষ করতে পারি নি। তাহলে এখন আবার চা খেতে ইচ্ছা করছে কেন? কেন ইচ্ছা করছে? ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। রতন সরকার বলে উঠল- ‘ডাক্তার সাহেবি এখনো আসেনি। তিনি আসার আগ পর্যন্ত সময় আছে। চলুন।’
আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আবারও চায়ের দোকানে এসে বসলাম। রতন সরকার দুই কাপ চা দিতে বলে আমাকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দিলো। আমি লক্ষ্য করলাম, ইশারাতে দোকানদারের সাথে সে কি যেন বলছে এবং দুজনই শব্দ করে হাসছে। আমার মনে হলো- তারা আমাকে নিয়েই হাসছে, কিন্তু কেন হাসছে? বুঝতে পারলাম না।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রতন সরকার আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘আপনি না বললেন চা খাবেন? চাতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খাচ্ছেন না কেন?’ চায়ের কথা মনে পরল। সেই তো আমরা তো মর্গের দিকে যাচ্ছিলাম, আমার চা খেতে ইচ্ছা হলো জন্যেই তো আবারও ফিরে এলাম, কিন্তু চায়ের কথা কি করে ভুলে গেলাম? চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলাম। হাতের সিগারেট ততক্ষণে নিভে গেছে। লক্ষ্য না করে টান দিলাম কোন ধোয়া বের হলো না। দোকানদার গলা কানে এলো- “এ গেছে রতন দা একদম গেছে।” কে গেছে কেন গেছে কিভাবে গেল আমি বুঝতে পারলাম না। রতন সরকারকে জিজ্ঞাস করলাম- ‘কে গেল?’ রতন সরকার বলল- ‘ও কিছু না। চা শেষ করেন যেতে হবে।’
...
মর্গের ভেতরে বসে আছি। ঘরের ভেতরের লাশগুলোকে এখন মনে হচ্ছে জীবিত। এইতো তারা সারাদিন নানা কাজ-কর্ম করল। ছুটোছুটি করল। এখন গায়ে সাদা কাথা গায় দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কাথাগুলো একটু বেশিই সাদা। এতো সাদা কাপড় আগে আমি দেখি নি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। চেয়ার থেকে উঠে একজনের পাশে গিয়ে বসলাম। ঘরের ভেতরটায় খুব ঠান্ডা। আশে-পাশে একটা সাদা কাথা খুজলাম, কিন্তু পেলাম না। একটা বালিশও বিশেষ প্রয়োজন। বালিশ ছাড়াকি এই শক্ত মেঝেতে মাথা রেখে ঘুমানো যায়! কাথা-বালিশ সব কোথায়? আমি যখন কাথা-বালিশ খুঁজতে শুরু করলাম, কে একজন যেন বলে উঠল- ‘সর্বনাশ! করছেন টা কি আপনি? পাগল করে ছাড়বেন দেখছি। আসুন, চলে আসুন এইদিকে।’ বলার পর আমার হাত ধরে হাটতে শুরু করল। আমি অন্ধের মত তাকে অনুসরণ করলাম। কয়েক সেকেন্ড পর সে আমাকে কিছু একটাতে বসিয়ে দিলো। আমি চোখ বন্ধ করে থাকলাম। যে আমাকে নিয়ে আসল সে আবার বলল- ‘কিছুক্ষণ এখানে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
আমার ঘুম ভাঙ্গল হৈচৈ এর শব্দে। হাত ঘড়িতে সময় তখন রাত সোয়া বারোটা। ঘন্টাখানেকের মতন ঘুমিয়েছি। সামনের দিকে তাকাতেই একজন ভদ্রলোককে দেখলাম রতনকে বকছে। তিনি বললেন- “তোমাকে বলেছিলাম না কাউকে কখনো নিয়ে আসবা না?” রতন সরকার বলল- “স্যার খুব করে ধরল।”
-- “ধরল তাই নিয়ে এলে?”
-- “স্যার রাগ করছেন কেন? বেচারার ইচ্ছা হলো দেখবে। মানুষের ইচ্ছা হতে পারে না?”
ডাক্তার সাহেব কোন কথা বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে রতন সরকার বলল- “ঘুম ভাঙ্গল আপনার?” আমি কিছু বলতে পারলাম না। ডাক্তার সাহেবের কারণেই হয়তো কিছু বলা গেল না। ডাক্তার সাহেব চোখ বড় বড় করে আমার দিকে কয়েকবার তাকালেন, কিন্তু কোন কথা বললেন না।
...
ফ্রিজ থেকে একটা লাশ বের করে স্ট্রেচারে রাখা হলো। সবকিছু মনে হচ্ছে রতনকে আগে থেকেই বলে রাখা হয়েছিলো, ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞাস করলেন, “নিচে কয়টা আছে?” রতন একমুহুর্ত হিসাব করে বলল- “ছয়টা স্যার।”
-- “আঞ্জুমান মফিদুলে ফোন দেওয়া প্রয়োজন, বেওয়ারিশি লাশগুলো না নিয়ে গেলে তো সমস্যা। কোন ফ্রিজ খালি নেই, এর মধ্যে দুটা ফ্রিজ নষ্ট হয়ে পরে আছে।”
-- “জ্বী স্যার। জঙ্গীগুলাই তো দুই ফ্রিজ দখল করে রাখছে। এদেরকে ফ্রিজে রাখার দরকার কি স্যার? স্বজনরা নিয়ে না গেলে এদেরকে দাফন করে দিলেই হয়।”
-- “হু। বিদেশির লাশও তো অনেকদিন ধরে পরে আছে। তাকে দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন? আচ্ছা যাই হোক। শুরু কর।”
-- “জ্বী স্যার।”
.
রতন সরকারের হাতে ছুরি এবং কাচি। পাশে একটা বাটিতে হাতুড়ি, প্লাসের মতন কিছু একটা, সুঁই, আরও কিছু জিনিসপত্র সাজানো। মৃত দেহ টা একটা মাঝ বয়সী পুরুষ ব্যক্তির। রতন সরকার এক মুহুর্তে তার মাথা থেকে কিছু একটা বের করে রাখল। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো, এতো খুবই সহজ কাজ। একদম গরু কাটার মতন। প্রতিবছর কুরবানী ঈদে যেভাবে গরু কাটি এটাও ঠিক তেমনই, ভয় পাওয়ার কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। স্ট্রেচারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ডাক্তার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল- ‘ফার্স্ট টাইম?’আমি বললাম- ‘আমাকে বলছেন?’
-- “জ্বী আপনাকেই জিজ্ঞাস করেছি।”
-- “হ্যাঁ, ফার্স্ট টাইম।”
-- “আপনার তো বেশ সাহস দেখছি। অন্তত সেসব ছাত্র-ছাত্রীর চেয়ে বেশি যারা প্রথম প্রথম লাশ কাটা দেখে জ্ঞান হারায়।”
.
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে নিজের প্রতি গর্ববোধ হলো। ডাক্তার সাহেব আমাকে সাহসী বলেছেন, আগে কেবল আমিই ভাবতাম, এখন ডাক্তার সাহেবও ভাবলেন! আমার তো ডাক্তারী পড়া উচিৎ ছিলো, কেন যে... একি আমি কোন বিষয়ে পড়ি মনে পড়ছে না কেন? কোন বিষয়ে পড়ি আমি? ডাক্তার সাহেব বললেন- ‘এখানে কাটো, সোজা।’ রতন সরকার বলল- ‘জ্বী স্যার।’ ডাক্তার সাহেব আবার বললেন- ‘কি মনে হয় রতন?’
-- “স্যার ভেতরে তো কিছুই নাই সব পচে গেছে।”
-- “তাই তো দেখছি। কিডনী, লিভার, লাঞ্চ কিছুই বাদ নাই। নেশা-পানি কোনটা করতে বাদ রাখেনি মনে হচ্ছে।”
-- “জ্বী স্যার।”
-- “বুঝলে পুলিশি কাস্টরিতে মরেছে। তার বাবার ধারণা পুলিশ পিটিয়ে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। বেচারা পুলিশ পরেছে মহা যন্ত্রণায়, এম.পি-মন্ত্রীর ছেলে ধরলেও ঝামেলা না ধরলেও সমস্যা।”
-- “জ্বী স্যার। আর কিছু দেখবেন নাকি সেলাই দিয়ে দেবো।”
-- “দাও, সেলাই দাও এর আর কিছু দেখা বাকি নাই।”
.
রতন ডেড বডির কাটা অংশ সেলাতে শুরু করল। ডাক্তার সাহেব আমার দিকে ঝুকে জিজ্ঞাস করলেন- ‘নামকি আপনার?’ আমি বললাম- ‘আমার ডাক নাম সেতু।’ ডাক্তার সাহেব আমার চোখে চোখ রেখে বললেন- ‘তো সেতু, আপনি কি করছেন? পড়াশোনা নাকি অন্য কিছু?’ আমি চোখ সড়িয়ে বললাম- ‘জ্বী পড়াশোনা করছি।’
-- ‘কোন সাবজেক্টে?’
.
আমার ততক্ষণে মনে পরেছে, ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম- কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন- ‘কম্পিউটারের নাড়ি-ভুড়ি দেখতে আর ভাল লাগছে না নাকি?’ আসলেই ভাল লাগে না। যন্ত্রের উপর এতো পড়তে কি ভাল লাগার কথা? কিছু মনেও থাকে না। কি যেন পড়েছি এতোদিন? সেড়েছে, কিছুই তো মনে পরছে না, কেবল মনে পরছে কলেজ জীবনে পড়া একটামাত্র প্রশ্নের কথা মনে পরছে- ‘সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের মধ্যকার পার্থক্য।’ এখন যদি ডাক্তার সাহেব প্রশ্ন করে বসেন- এলসিডির পূর্ণরুপ কি? পিসি মানে কি? সিপিইউ কি? এক কেবি সমান কত বাইট? কম্পিউটার বায়োস কি? কিছুই তো মনে পরছে না। কি অদ্ভুত ব্যাপার প্রশ্ন মনে আছে উত্তর মনে নাই। কি উত্তর দিবো?
ডাক্তার সাহেব কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাস করলেন না। এরমধ্যে কেউ একজন এসে দরজায় কড়া নাড়ল। রতন সরকার বলল- ‘কে হারুন ভাই?’ ওপাশ থেকে উত্তর এলো- ‘হ্যাঁ হারুন, দরজা খোল।’ রতন দরজার দিকে যেতে যেতে বলল- ‘একমিনিট ভাই খুলছি।’ দরজা খুললে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত একজন ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নাকে মাস্ক লাগালেন। তার পকেটের ওপর লেখা এস.কে. হারুন।
ডাক্তার সাহেব খুব সম্ভবত হারুন সাহেবের পূর্ব-পরিচিত। হারুন সাহেবকে দেখে তিনি বললেন- ‘আরে হারুন সাহেব যে। কেমন আছেন?’ হারুন সাহেব ঘরের চারদিকটায় একবার তাকিয়ে বললেন- ‘ভাল নাই ভাই। কি করে ভাল থাকি বলেন, পত্রিকা ওয়ালারা ঐ মহিলাকে নিয়ে পুলিশের গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ছে। সকালে হেডলাইন করেছে, দেখেছেন নিশ্চয়ই।’ ডাক্তার সাহেব কপাল ভাজ করে বললেন- ‘হ্যাঁ দেখলাম। কি করবেন বলেন, এইসব খবর পাবলিক খায় বেশি। দুদিন পর নতুন কোন ঘটনা বের হবে তখন এসব ভুলে নতুন ঘটনার উপর হুমড়ি খেয়ে পরবে।এতো রাতে এলেন যে?’ হারুন সাহেব এক মুহুর্ত চুপ থেকে বললেন- ‘উপর মহল থেকে চাপ আছে। নইলে কি আর এতো রাত করে পচা লাশের গন্ধ শুকতে আসি?’
-- ডাক্তার সাহেবঃ “তা ঠিক।”
-- এস.কে হারুনঃ “রতন, লাশের কি খবর।”
-- রতন সরকারঃ “স্যার এখনো ধরা হয় নাই। মাত্রই একটা শেষ করলাম, এখনই ধরব।”
-- এস.কে হারুনঃ “হ্যাঁ তাড়াতাড়ি ধর। ঘটনা কম-বেশি সবাই জানে ফাঁসি নিয়ে মরেছে, পেটে একটা বাচ্চা ছিলো৷ ঝগড়া-ঝাটি হয়েছে ফাঁসি নিয়ে মরেছে, সাধারণ একটা ব্যাপার। সাংবাদিক আর আম-জনতার তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাবার আগ পর্যন্ত তারা থামবে না।”
.
ডাক্তার সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। আগের লাশটা পলিথিন পেচিয়ে সাদা-কাপড়ে ঢেকে ফ্রিজে ঢুকানো হলো৷ নতুন যেই লাশটা বের করা হলো সেটা একজন মহিলার। হারুন সাহেব আমার দিকে ফিরে বললেন- ‘রতন যার কথা বলেছিল আপনিই সে?’ আমি কিছু বলার আগেই রতন বলল- ‘জ্বী স্যার ইনিই তিনি।’ হারুন সাহেব আমার দিকে ঝুকে বললেন- ‘ভাল লাগছে কি?’ আমি মৃদু হেসে বললাম- ‘মন্দ না।’ হারুন সাহেব বিজয়ের হাসি হেসে লাশের দিকে মনোযোগী হলেন।
...
স্ট্রেচারে যেই মেয়েটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে তার নাম জানতে পেরেছি মিতু। বয়স সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২১ বছর হবে। মুখের সৌন্দর্য তার এখনো পুরোপুরি মুছে যায় নি। দুদিন আগেও হয়তো এই মেয়েটির প্রাণ ছিলো, সে কথা বলেছে মায়ের সাথে, বাবার সাথে অথবা স্বামীর সাথে নতুবা পেটের ছোট্ট বাচ্চাটার সাথে অথচ আজ তার কথা বলার শক্তি নেই, হাতটা নাড়তে পারছে না, চোখের পাতা দুটো পর্যন্ত খোলার সামর্থ্য তার নেই। কি অদ্ভুত ‘মৃত্যু’! কত নিষ্ঠুর ‘মৃত্যু’!
.
রতনের হাতে ধারালো ছুরি। ছুরিটা গলা থেকে যৌনাঙ্গ পর্যন্ত চলে গেল। মিতু আঁতকে উঠল না, ব্যথায় চিৎকার করল না। তার শরীর কেটে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলা হচ্ছে সে একবার তাকিয়ে দেখল না। ডাক্তার সাহেব হঠাৎ বলে উঠলেন- ‘ইটজ নট সুইসাইড, ইটজ মার্ডার।’ হারুন সাহেব অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললেন- ‘হোয়াট?’ ডাক্তার সাহেব বলতে শুরু করলেন- ‘প্রথমত তার সাথে যৌন-সঙ্গম করা হয়েছে, এরপর তাকে শ্বাসরোধে খুন করা হয়েছে।’ হারুন সাহেবের মাথায় যেন গোটা আকাশ ভেঙে পরল। তিনি ডাক্তারর সাহেবকে বললেন- ‘ভালভাবে দেখেন ভাই, বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে।’ ডাক্তার সাহেব বললেন- ‘আমি ভাল-ভাবেই দেখেছি।’
...
মসজিদ থেকে ফজরের আযান কানে এলো। মিতুর কাটা-ছেড়া শরীরটা সেলাই করে প্লাস্টিকে পেচিয়ে সাদা কাপড়ে ঢেকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখা হলো। রতন সরকার আমাকে বলল- ‘চলুন।’
.
আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলাম। হাটতে হাটতে রতন সরকার বলল- ‘আপনার ইচ্ছা পূরণ হলো?’ আমি তখনও ঘোরের মধ্যে আছি। কে খুন করবে মিতু কে? তার স্বামী নাকি অন্য কেউ? স্বামী কেন খুন করবে? সে অবশ্যই জানত সে বাবা হতে যাচ্ছে। একজন বাবা কি এতো নিষ্ঠুর হতে পারে? হওয়া উচিত নয়। রতন সরকার আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘কি ব্যাপার? কথা বলছেন না কেন? কিছু ভাবছেন?’ আমি মৃদুস্বরে বললাম- ‘ভাই মেয়েটাকে কে খুন করল?’
-- “ওসব ভেবে কি লাভ বলুন? পুলিশ আছে, তারা বের করবে কে খুন করল।”
-- “মেয়েটার পেটের বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখতে পেল না। হয়তো বুঝতেই পারল না সে মরে গেল।”
-- “এসব নিয়ে আর ভাববেন না। প্রথম দেখলেন তো তাই বোধহয় এতো চিন্তা হচ্ছে। আমাদেরকে প্রতিদিন দেখতে হয় এসব নিয়ে কখনো চিন্তা হয় না। বাসায় যান, গিয়ে গোসল করে খেয়ে-দেয়ে একটা ঘুম দেন।
...
বাসায় এসে গোসল করলাম ঠিকই কিন্তু কিছু খেতে পারলাম না। বেশ কষ্টে আধা গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম। মিতুর খুন নিয়ে চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা ছিলো অনেকটা এরকম-
.
মিতু আমার খুব কাছের কেউ একজন ছিলো। একদিন তার স্বামী অফিসে যাবার ঘন্টাখানেক পর আমি মিতুদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা নক করলাম। মিতু দরজা খুলে বলল- ‘তুমি?’ মিতুকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একহাতে মুখ চেপে আরেক হাতে দরজা বন্ধ করে দিলাম। জোর করে নিয়ে গেলাম ভেতরের ঘরে। মিতু চিৎকার দিতে যাচ্ছিল, ওমনি বালিশ নাকে চেপে ধরলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মিতু বাঁচার চেষ্টা করল। পা দুটো বিছানায় ছুড়ল, হাত দুটো দিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মিনিট দুয়েক পর মিতুর মৃত্যু হলো। বালিশ সরাতেই দেখলাম নাক-মুখ থেকে ফেনা বেরুতে শুরু করেছে। একটা কাপড় দিয়ে সেসব মুছে ফ্যানে দড়ি বেঁধে মিতুকে ঝুলিয়ে রেখে বাসা থেকে বের হয়ে চলে আসলাম।
.
মনটা এখনো ভার হয়ে আছে। খুনটা শেষ পর্যন্ত কে করল জানার জন্য মনটা ছটফট করছে। বাসা থেকে বের হয়ে ফিরোজের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বেলে ফিরোজকে চা দিতে বললাম। ফিরোজ চা বানাতে বানাতে বলল- ‘দেখছেন নি ভাই কি একটা অবস্থা?’
-- “কি হয়েছে?”
-- “সংবাদ দেহেন নাই? একটা মাইয়্যা খুন হইছে, মাইয়্যার পেটে বাচ্চা আছিলো।”
.
চায়ের কাপ দিয়ে ফিরোজ টেলিভিশন জুড়ে দিলো। খানিক বাদে সংবাদ শুরু হলো। প্রথম সংবাদটি প্রধানমন্ত্রীর জার্মানি গিয়ে পৌছানোর খবর। দ্বিতীয় সংবাদটা মিতুর। ডাক্তার সাহেবকে দেখা গেল সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য রাখতে। এস.কে হারুন সাহেবের বক্তব্য নেওয়া হলো। যদিও মিতুর স্বামীর দাবি সে সারাদিন অফিসে ছিলো, এবং দুপুরের দিকেও সিকিউরিটি গার্ড মিতুকে দোকানে যেতে দেখেছে। অফিস থেকে ফেরার সময় মিতুর ছোটভাই সহ বাসায় এসে এই অবস্থা তারা দেখতে পেরেছে, তারপরও তাকে এবং মিতুর ছোট ভাইকে পুলিশ আটক ।
...
মাস খানেক পরের কথা...
নারায়নগঞ্জে আমার এক বন্ধু সিজানের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। চারদিন আগে ওরা এই বাড়িতে উঠেছে। সিজানদের ফ্ল্যাট চার তলায়। দুপুরে গোসল করে বাথরুমে গিয়ে হাই কমোডের পাশে পা দিয়ে পানি সরাচ্ছিলাম। একটা টাইলসের উপরে পা পরতে মনে হলো- টাইলসের নিচটা ফাঁকা, কোন ঢালাই নেই। গোসল সেড়ে সিজানকে ডেকে দেখালাম। সিজান টাইলসের উপর টোকা দিয়ে বলল- ‘মনে হচ্ছে টাইলসের নিচে কোন ঢালাই নাই।’ উঠে দাঁড়িয়ে সিজান টাইলসের উপর হালকা একটা লাত্থি দিতেই টাইলসটা ভেঙ্গে গেল। নিচের দিকটা অন্ধকার। সিজানের মতে এই বাথরুমের উপরে যেমন একটা স্টোর রুম আছে এখানেও তেমনটাই হবার কথা। বিকেলের দিকে সিজানদের বাড়ি থেকে ফিরে এলাম।
...
কিছুদিন পর সিজানের কাছে শুনেছি- বাড়িওয়ালাকে জানাবার পর মিস্ত্রী ডেকে বাড়িওয়ালা বাথরুমের ওই ফাঁকা অংশটুকু নতুন করে ঢালাই করে দিয়েছে। সিজানদের নিচের তিনতলার ওই ফ্ল্যাট টাতে নাকি একজন গর্ভবতী মহিলা ফাঁসির দড়িতে ঝুলে আত্নহত্যা করেছিল। এরপর থেকে ঐ ফ্ল্যাট টা ফাঁকা। এখনো ভাড়া হয়নি। আমার খুব জানার ইচ্ছে হয়েছিলো তার নাম কি? সিজানকে জিজ্ঞাসও করেছিলাম, সিজান বলতে পারেনি। পরে আর জানার আগ্রহ হয়নি। প্রতিদিন কত মানুষ কত ভাবে মরছে, নিজের জীবনের বাইরে এতো কিছু জেনে কি হবে? নাহয় ঐ ফ্ল্যাট টাতে মিতুরাই থাকত। মিতুদের অনুপস্থিতিতে আগে যারা সিজানদের ফ্ল্যাটে থাকত তাদের কেউ একজন সোজা বাথরুমের টাইলস তুলে ঢালাই ভেঙ্গে রেখেছিলো, এরপর কোন একদিন সুযোগ বুঝে সেই ফাঁকা যায়গা দিয়ে নেমে...
...
-- “ধরল তাই নিয়ে এলে?”
-- “স্যার রাগ করছেন কেন? বেচারার ইচ্ছা হলো দেখবে। মানুষের ইচ্ছা হতে পারে না?”
ডাক্তার সাহেব কোন কথা বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে রতন সরকার বলল- “ঘুম ভাঙ্গল আপনার?” আমি কিছু বলতে পারলাম না। ডাক্তার সাহেবের কারণেই হয়তো কিছু বলা গেল না। ডাক্তার সাহেব চোখ বড় বড় করে আমার দিকে কয়েকবার তাকালেন, কিন্তু কোন কথা বললেন না।
...
ফ্রিজ থেকে একটা লাশ বের করে স্ট্রেচারে রাখা হলো। সবকিছু মনে হচ্ছে রতনকে আগে থেকেই বলে রাখা হয়েছিলো, ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞাস করলেন, “নিচে কয়টা আছে?” রতন একমুহুর্ত হিসাব করে বলল- “ছয়টা স্যার।”
-- “আঞ্জুমান মফিদুলে ফোন দেওয়া প্রয়োজন, বেওয়ারিশি লাশগুলো না নিয়ে গেলে তো সমস্যা। কোন ফ্রিজ খালি নেই, এর মধ্যে দুটা ফ্রিজ নষ্ট হয়ে পরে আছে।”
-- “জ্বী স্যার। জঙ্গীগুলাই তো দুই ফ্রিজ দখল করে রাখছে। এদেরকে ফ্রিজে রাখার দরকার কি স্যার? স্বজনরা নিয়ে না গেলে এদেরকে দাফন করে দিলেই হয়।”
-- “হু। বিদেশির লাশও তো অনেকদিন ধরে পরে আছে। তাকে দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন? আচ্ছা যাই হোক। শুরু কর।”
-- “জ্বী স্যার।”
.
রতন সরকারের হাতে ছুরি এবং কাচি। পাশে একটা বাটিতে হাতুড়ি, প্লাসের মতন কিছু একটা, সুঁই, আরও কিছু জিনিসপত্র সাজানো। মৃত দেহ টা একটা মাঝ বয়সী পুরুষ ব্যক্তির। রতন সরকার এক মুহুর্তে তার মাথা থেকে কিছু একটা বের করে রাখল। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো, এতো খুবই সহজ কাজ। একদম গরু কাটার মতন। প্রতিবছর কুরবানী ঈদে যেভাবে গরু কাটি এটাও ঠিক তেমনই, ভয় পাওয়ার কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। স্ট্রেচারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ডাক্তার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল- ‘ফার্স্ট টাইম?’আমি বললাম- ‘আমাকে বলছেন?’
-- “জ্বী আপনাকেই জিজ্ঞাস করেছি।”
-- “হ্যাঁ, ফার্স্ট টাইম।”
-- “আপনার তো বেশ সাহস দেখছি। অন্তত সেসব ছাত্র-ছাত্রীর চেয়ে বেশি যারা প্রথম প্রথম লাশ কাটা দেখে জ্ঞান হারায়।”
.
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে নিজের প্রতি গর্ববোধ হলো। ডাক্তার সাহেব আমাকে সাহসী বলেছেন, আগে কেবল আমিই ভাবতাম, এখন ডাক্তার সাহেবও ভাবলেন! আমার তো ডাক্তারী পড়া উচিৎ ছিলো, কেন যে... একি আমি কোন বিষয়ে পড়ি মনে পড়ছে না কেন? কোন বিষয়ে পড়ি আমি? ডাক্তার সাহেব বললেন- ‘এখানে কাটো, সোজা।’ রতন সরকার বলল- ‘জ্বী স্যার।’ ডাক্তার সাহেব আবার বললেন- ‘কি মনে হয় রতন?’
-- “স্যার ভেতরে তো কিছুই নাই সব পচে গেছে।”
-- “তাই তো দেখছি। কিডনী, লিভার, লাঞ্চ কিছুই বাদ নাই। নেশা-পানি কোনটা করতে বাদ রাখেনি মনে হচ্ছে।”
-- “জ্বী স্যার।”
-- “বুঝলে পুলিশি কাস্টরিতে মরেছে। তার বাবার ধারণা পুলিশ পিটিয়ে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। বেচারা পুলিশ পরেছে মহা যন্ত্রণায়, এম.পি-মন্ত্রীর ছেলে ধরলেও ঝামেলা না ধরলেও সমস্যা।”
-- “জ্বী স্যার। আর কিছু দেখবেন নাকি সেলাই দিয়ে দেবো।”
-- “দাও, সেলাই দাও এর আর কিছু দেখা বাকি নাই।”
.
রতন ডেড বডির কাটা অংশ সেলাতে শুরু করল। ডাক্তার সাহেব আমার দিকে ঝুকে জিজ্ঞাস করলেন- ‘নামকি আপনার?’ আমি বললাম- ‘আমার ডাক নাম সেতু।’ ডাক্তার সাহেব আমার চোখে চোখ রেখে বললেন- ‘তো সেতু, আপনি কি করছেন? পড়াশোনা নাকি অন্য কিছু?’ আমি চোখ সড়িয়ে বললাম- ‘জ্বী পড়াশোনা করছি।’
-- ‘কোন সাবজেক্টে?’
.
আমার ততক্ষণে মনে পরেছে, ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম- কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন- ‘কম্পিউটারের নাড়ি-ভুড়ি দেখতে আর ভাল লাগছে না নাকি?’ আসলেই ভাল লাগে না। যন্ত্রের উপর এতো পড়তে কি ভাল লাগার কথা? কিছু মনেও থাকে না। কি যেন পড়েছি এতোদিন? সেড়েছে, কিছুই তো মনে পরছে না, কেবল মনে পরছে কলেজ জীবনে পড়া একটামাত্র প্রশ্নের কথা মনে পরছে- ‘সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের মধ্যকার পার্থক্য।’ এখন যদি ডাক্তার সাহেব প্রশ্ন করে বসেন- এলসিডির পূর্ণরুপ কি? পিসি মানে কি? সিপিইউ কি? এক কেবি সমান কত বাইট? কম্পিউটার বায়োস কি? কিছুই তো মনে পরছে না। কি অদ্ভুত ব্যাপার প্রশ্ন মনে আছে উত্তর মনে নাই। কি উত্তর দিবো?
ডাক্তার সাহেব কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাস করলেন না। এরমধ্যে কেউ একজন এসে দরজায় কড়া নাড়ল। রতন সরকার বলল- ‘কে হারুন ভাই?’ ওপাশ থেকে উত্তর এলো- ‘হ্যাঁ হারুন, দরজা খোল।’ রতন দরজার দিকে যেতে যেতে বলল- ‘একমিনিট ভাই খুলছি।’ দরজা খুললে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত একজন ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নাকে মাস্ক লাগালেন। তার পকেটের ওপর লেখা এস.কে. হারুন।
ডাক্তার সাহেব খুব সম্ভবত হারুন সাহেবের পূর্ব-পরিচিত। হারুন সাহেবকে দেখে তিনি বললেন- ‘আরে হারুন সাহেব যে। কেমন আছেন?’ হারুন সাহেব ঘরের চারদিকটায় একবার তাকিয়ে বললেন- ‘ভাল নাই ভাই। কি করে ভাল থাকি বলেন, পত্রিকা ওয়ালারা ঐ মহিলাকে নিয়ে পুলিশের গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ছে। সকালে হেডলাইন করেছে, দেখেছেন নিশ্চয়ই।’ ডাক্তার সাহেব কপাল ভাজ করে বললেন- ‘হ্যাঁ দেখলাম। কি করবেন বলেন, এইসব খবর পাবলিক খায় বেশি। দুদিন পর নতুন কোন ঘটনা বের হবে তখন এসব ভুলে নতুন ঘটনার উপর হুমড়ি খেয়ে পরবে।এতো রাতে এলেন যে?’ হারুন সাহেব এক মুহুর্ত চুপ থেকে বললেন- ‘উপর মহল থেকে চাপ আছে। নইলে কি আর এতো রাত করে পচা লাশের গন্ধ শুকতে আসি?’
-- ডাক্তার সাহেবঃ “তা ঠিক।”
-- এস.কে হারুনঃ “রতন, লাশের কি খবর।”
-- রতন সরকারঃ “স্যার এখনো ধরা হয় নাই। মাত্রই একটা শেষ করলাম, এখনই ধরব।”
-- এস.কে হারুনঃ “হ্যাঁ তাড়াতাড়ি ধর। ঘটনা কম-বেশি সবাই জানে ফাঁসি নিয়ে মরেছে, পেটে একটা বাচ্চা ছিলো৷ ঝগড়া-ঝাটি হয়েছে ফাঁসি নিয়ে মরেছে, সাধারণ একটা ব্যাপার। সাংবাদিক আর আম-জনতার তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাবার আগ পর্যন্ত তারা থামবে না।”
.
ডাক্তার সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। আগের লাশটা পলিথিন পেচিয়ে সাদা-কাপড়ে ঢেকে ফ্রিজে ঢুকানো হলো৷ নতুন যেই লাশটা বের করা হলো সেটা একজন মহিলার। হারুন সাহেব আমার দিকে ফিরে বললেন- ‘রতন যার কথা বলেছিল আপনিই সে?’ আমি কিছু বলার আগেই রতন বলল- ‘জ্বী স্যার ইনিই তিনি।’ হারুন সাহেব আমার দিকে ঝুকে বললেন- ‘ভাল লাগছে কি?’ আমি মৃদু হেসে বললাম- ‘মন্দ না।’ হারুন সাহেব বিজয়ের হাসি হেসে লাশের দিকে মনোযোগী হলেন।
...
স্ট্রেচারে যেই মেয়েটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে তার নাম জানতে পেরেছি মিতু। বয়স সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২১ বছর হবে। মুখের সৌন্দর্য তার এখনো পুরোপুরি মুছে যায় নি। দুদিন আগেও হয়তো এই মেয়েটির প্রাণ ছিলো, সে কথা বলেছে মায়ের সাথে, বাবার সাথে অথবা স্বামীর সাথে নতুবা পেটের ছোট্ট বাচ্চাটার সাথে অথচ আজ তার কথা বলার শক্তি নেই, হাতটা নাড়তে পারছে না, চোখের পাতা দুটো পর্যন্ত খোলার সামর্থ্য তার নেই। কি অদ্ভুত ‘মৃত্যু’! কত নিষ্ঠুর ‘মৃত্যু’!
.
রতনের হাতে ধারালো ছুরি। ছুরিটা গলা থেকে যৌনাঙ্গ পর্যন্ত চলে গেল। মিতু আঁতকে উঠল না, ব্যথায় চিৎকার করল না। তার শরীর কেটে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলা হচ্ছে সে একবার তাকিয়ে দেখল না। ডাক্তার সাহেব হঠাৎ বলে উঠলেন- ‘ইটজ নট সুইসাইড, ইটজ মার্ডার।’ হারুন সাহেব অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললেন- ‘হোয়াট?’ ডাক্তার সাহেব বলতে শুরু করলেন- ‘প্রথমত তার সাথে যৌন-সঙ্গম করা হয়েছে, এরপর তাকে শ্বাসরোধে খুন করা হয়েছে।’ হারুন সাহেবের মাথায় যেন গোটা আকাশ ভেঙে পরল। তিনি ডাক্তারর সাহেবকে বললেন- ‘ভালভাবে দেখেন ভাই, বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে।’ ডাক্তার সাহেব বললেন- ‘আমি ভাল-ভাবেই দেখেছি।’
...
মসজিদ থেকে ফজরের আযান কানে এলো। মিতুর কাটা-ছেড়া শরীরটা সেলাই করে প্লাস্টিকে পেচিয়ে সাদা কাপড়ে ঢেকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখা হলো। রতন সরকার আমাকে বলল- ‘চলুন।’
.
আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলাম। হাটতে হাটতে রতন সরকার বলল- ‘আপনার ইচ্ছা পূরণ হলো?’ আমি তখনও ঘোরের মধ্যে আছি। কে খুন করবে মিতু কে? তার স্বামী নাকি অন্য কেউ? স্বামী কেন খুন করবে? সে অবশ্যই জানত সে বাবা হতে যাচ্ছে। একজন বাবা কি এতো নিষ্ঠুর হতে পারে? হওয়া উচিত নয়। রতন সরকার আমার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘কি ব্যাপার? কথা বলছেন না কেন? কিছু ভাবছেন?’ আমি মৃদুস্বরে বললাম- ‘ভাই মেয়েটাকে কে খুন করল?’
-- “ওসব ভেবে কি লাভ বলুন? পুলিশ আছে, তারা বের করবে কে খুন করল।”
-- “মেয়েটার পেটের বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখতে পেল না। হয়তো বুঝতেই পারল না সে মরে গেল।”
-- “এসব নিয়ে আর ভাববেন না। প্রথম দেখলেন তো তাই বোধহয় এতো চিন্তা হচ্ছে। আমাদেরকে প্রতিদিন দেখতে হয় এসব নিয়ে কখনো চিন্তা হয় না। বাসায় যান, গিয়ে গোসল করে খেয়ে-দেয়ে একটা ঘুম দেন।
...
বাসায় এসে গোসল করলাম ঠিকই কিন্তু কিছু খেতে পারলাম না। বেশ কষ্টে আধা গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম। মিতুর খুন নিয়ে চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা ছিলো অনেকটা এরকম-
.
মিতু আমার খুব কাছের কেউ একজন ছিলো। একদিন তার স্বামী অফিসে যাবার ঘন্টাখানেক পর আমি মিতুদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা নক করলাম। মিতু দরজা খুলে বলল- ‘তুমি?’ মিতুকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একহাতে মুখ চেপে আরেক হাতে দরজা বন্ধ করে দিলাম। জোর করে নিয়ে গেলাম ভেতরের ঘরে। মিতু চিৎকার দিতে যাচ্ছিল, ওমনি বালিশ নাকে চেপে ধরলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মিতু বাঁচার চেষ্টা করল। পা দুটো বিছানায় ছুড়ল, হাত দুটো দিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মিনিট দুয়েক পর মিতুর মৃত্যু হলো। বালিশ সরাতেই দেখলাম নাক-মুখ থেকে ফেনা বেরুতে শুরু করেছে। একটা কাপড় দিয়ে সেসব মুছে ফ্যানে দড়ি বেঁধে মিতুকে ঝুলিয়ে রেখে বাসা থেকে বের হয়ে চলে আসলাম।
.
মনটা এখনো ভার হয়ে আছে। খুনটা শেষ পর্যন্ত কে করল জানার জন্য মনটা ছটফট করছে। বাসা থেকে বের হয়ে ফিরোজের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বেলে ফিরোজকে চা দিতে বললাম। ফিরোজ চা বানাতে বানাতে বলল- ‘দেখছেন নি ভাই কি একটা অবস্থা?’
-- “কি হয়েছে?”
-- “সংবাদ দেহেন নাই? একটা মাইয়্যা খুন হইছে, মাইয়্যার পেটে বাচ্চা আছিলো।”
.
চায়ের কাপ দিয়ে ফিরোজ টেলিভিশন জুড়ে দিলো। খানিক বাদে সংবাদ শুরু হলো। প্রথম সংবাদটি প্রধানমন্ত্রীর জার্মানি গিয়ে পৌছানোর খবর। দ্বিতীয় সংবাদটা মিতুর। ডাক্তার সাহেবকে দেখা গেল সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য রাখতে। এস.কে হারুন সাহেবের বক্তব্য নেওয়া হলো। যদিও মিতুর স্বামীর দাবি সে সারাদিন অফিসে ছিলো, এবং দুপুরের দিকেও সিকিউরিটি গার্ড মিতুকে দোকানে যেতে দেখেছে। অফিস থেকে ফেরার সময় মিতুর ছোটভাই সহ বাসায় এসে এই অবস্থা তারা দেখতে পেরেছে, তারপরও তাকে এবং মিতুর ছোট ভাইকে পুলিশ আটক ।
...
মাস খানেক পরের কথা...
নারায়নগঞ্জে আমার এক বন্ধু সিজানের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। চারদিন আগে ওরা এই বাড়িতে উঠেছে। সিজানদের ফ্ল্যাট চার তলায়। দুপুরে গোসল করে বাথরুমে গিয়ে হাই কমোডের পাশে পা দিয়ে পানি সরাচ্ছিলাম। একটা টাইলসের উপরে পা পরতে মনে হলো- টাইলসের নিচটা ফাঁকা, কোন ঢালাই নেই। গোসল সেড়ে সিজানকে ডেকে দেখালাম। সিজান টাইলসের উপর টোকা দিয়ে বলল- ‘মনে হচ্ছে টাইলসের নিচে কোন ঢালাই নাই।’ উঠে দাঁড়িয়ে সিজান টাইলসের উপর হালকা একটা লাত্থি দিতেই টাইলসটা ভেঙ্গে গেল। নিচের দিকটা অন্ধকার। সিজানের মতে এই বাথরুমের উপরে যেমন একটা স্টোর রুম আছে এখানেও তেমনটাই হবার কথা। বিকেলের দিকে সিজানদের বাড়ি থেকে ফিরে এলাম।
...
কিছুদিন পর সিজানের কাছে শুনেছি- বাড়িওয়ালাকে জানাবার পর মিস্ত্রী ডেকে বাড়িওয়ালা বাথরুমের ওই ফাঁকা অংশটুকু নতুন করে ঢালাই করে দিয়েছে। সিজানদের নিচের তিনতলার ওই ফ্ল্যাট টাতে নাকি একজন গর্ভবতী মহিলা ফাঁসির দড়িতে ঝুলে আত্নহত্যা করেছিল। এরপর থেকে ঐ ফ্ল্যাট টা ফাঁকা। এখনো ভাড়া হয়নি। আমার খুব জানার ইচ্ছে হয়েছিলো তার নাম কি? সিজানকে জিজ্ঞাসও করেছিলাম, সিজান বলতে পারেনি। পরে আর জানার আগ্রহ হয়নি। প্রতিদিন কত মানুষ কত ভাবে মরছে, নিজের জীবনের বাইরে এতো কিছু জেনে কি হবে? নাহয় ঐ ফ্ল্যাট টাতে মিতুরাই থাকত। মিতুদের অনুপস্থিতিতে আগে যারা সিজানদের ফ্ল্যাটে থাকত তাদের কেউ একজন সোজা বাথরুমের টাইলস তুলে ঢালাই ভেঙ্গে রেখেছিলো, এরপর কোন একদিন সুযোগ বুঝে সেই ফাঁকা যায়গা দিয়ে নেমে...
...
গল্পের শেষে একটা প্রশ্নবোধক (‘?’) চিন্হ আছে। অর্থাৎ হয়তো সিজানদের নিচের ফ্ল্যাটেই মিতুরা থাকত এবং সিজানদের ফ্ল্যাটে আগে যারা বা যে থাকত সে কোন একদিন মিতুদের অনুপস্থিতিতে ঢালাই টা ভেঙ্গে রাখে এবং সুযোগ বুঝে বাথরুমের ভেঙ্গে রাখা অংশ দিয়ে স্টোর রুম দিয়ে নিচে নেমে মিতুর সাথে যৌনসঙ্গম এবং পরে খুন করে লাশ সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রেখে আবার সেই স্টোর রুম দিয়ে উপরে উঠে টাইলসটা কোন রকম লাগিয়ে রেখে দেয়।
বিঃদ্রঃ রাতের বেলা ময়নাতদন্ত হবার ঘটনা সাধারণত নেই। পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত দিনে করা হয়। গল্পের কাহিনী প্রেক্ষাপটে রাতের উল্লেখ করা হয়েছে।
0 Comments