ছোটবেলা থেকেই দেখতাম মা দিনের বেলায় প্রচুর সাজগোজ করতেন৷ এই পাড়া থেকে অন্য পাড়া যেতেও তার মুখে লিপস্টিক ক্রিম হাতে সোনার চুড়ি এসব মাস্ট থাকা চাই। আর দূরে কোথাও গেলে ত কথাই নেই, পুরো রাজরাণী হয়ে সাজতেন। কিন্ত অদ্ভুত ব্যাপার হলো রাত হলেই মা সহজ সরল স্বাভাবিক মানুষ হয়ে যেতেন। এমন কি আমাদের পড়তেও বসাতেন, কিন্ত তার পরনের সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যেত। কথাবার্তা আর গম্ভীর হয়ে যেত!!
কিন্ত সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হতো যখন মা আমাদের পড়াতে পড়াতেই হুট করে কেদে দিতেন, একেবারে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতেন। বিশেষ করে আমায় জড়িয়ে কাদতে যেন মা একটু বেশি ই শান্তি পেতেন। তখন আমার বয়স আর কত,, ৭ হয় হয়,,আর দিদির তখন মিনিমাম ১২ বছর হবে৷।
বাবাকে প্রায়স ই এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর পেতাম না,,শুধু বলতেন যে তোদের মায়ের সাইকোলজিকাল সমস্য আছে।ব্যাস এইটুকু, এর বেশি আর কিছুই জিজ্ঞেস করা যেত না। এই ব্যাপার টা নিয়েই দিদি আর আমি খুব বেশি টেনশন করতাম, কারন আমরা সত্যকার অর্থে সেই গম্ভীর মা কেই চাই,সেই দিনের বেলার সাজুগুজু মা কে কেন জানি পছন্দ হতো না আমাদের। এ নিয়ে আমরা কত পরিকল্পনা ই না এটেছিলাম। কিন্ত সব পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেবার আগেই মা হুট করে হারিয়ে গেলেন।
দিন টা শুক্রবার ছিল,আমি আর দিদি বেশ তাড়াহুড়ো করেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। কিন্ত সেদিন কোন কারনে আমার ঘুম টা গাড় হয় নি, কিছুক্ষন পর পর চোখ হুট করে খুলে যাচ্ছিল। এমন ই একবার খোলার সময় দরজায় ক্রন্দনরত মা কে দাঁড়ানো থেকে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। চোখ ডলতে ডলতে মার কাছে যেতেই মা আমায় জাপ্টে ধরে কোলে তুলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে গাল ভরিয়ে দিলেন। আমি তখন ও ঘুমের ঘোরে মার কান্ড দেখছি আর চোখ ডলছি। কিছুক্ষন পর মা কাদতে কাদতে আমার কানে এসে বললেন,"আমি আর পারছি না রে জয়। আমায় ক্ষমা করে দিস পারলে ভাল থাকিস সোনা বাবা আমার। বড় হলে যখন জানতে পারবি সব তখন বুঝবি তোর মা কত টা কষ্ট সহ্য করেছিল!! "
৭ বছরের আমি তখন ও কিছু ই বুঝিনি। সেদিন রাতে মা আমায় বিছানায় শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে কোথায় জানি চলে গেলেন৷ পাক্কা ২ দিন পর মার মরা দেহ টা পাশের গ্রামের ডোবাতে ভেসে ফুলে উঠতে দেখা গিয়েছিল। সেদিন দিদি কে কাদতে দেখে আমি শুধু মা মা বলে চেচিয়েছিলাম,কিন্ত কাদিনি। কান্নাটা কেন যেন সেদিন আমার আসেনি।শুধু অবাক হয়ে মার পচে গলে যাওয়া মৃতদেহ টার দিকে একদৃ ষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। এই বুঝি মা উঠে সাজুগুজু শুরু করে দিবেন,এই বুঝি চোখে কাজল মুখে লিপস্টিক দিবেন,,,,,,,,,
কিছুদিন পর দিদিকে একদিন ঘরে একটা কালো মোটা বাক্স নিয়ে ঢুকতে দেখে কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম সেটা কি,দিদি প্রত্তুত্তরে মুচকি হাসি হেসে বললো সেসব নাকি মার গয়ানা,মার শেষ স্মৃতি। তাই সে সেগুলো নিজের কাছে রেখে দিবে সযত্নে।। আমি ও আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাপার টা কে পাত্তা দিলাম না।
কিন্ত কদিন যেতে না যেতেই দিদিও মার মত দিনের বেলা আস্তে আস্তে গয়না পড়া শুরু করে দিল,প্রথম প্রথম নিছক স্মৃতিরক্ষার্থে মনে হলেও আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম এটা নিছক কোন কাকতালীয় ব্যাপার না । আমার সাথে সাথে যে বাবা ও যে ব্যাপার ভালভাবে নেয় নি সেটাও বুঝতে পারছিলাম। কিন্ত ২জন এর কেও এ নিয়্ব দিদিকে কিছু বলিনি।
একদিন রাত্রে কৌতুহলবশত দিদির অগোচরে আমি অই কালো বাক্স টা চুরি করে বাথরুমে এর কোনায় এনে লুকিয়ে রেখেছিলাম। পরে দিদি ঘুমানো মাত্র ই বাথরুমে যেয়ে কালো বাক্স টা খুলে দেখি,কিন্ত অবাক করা ব্যাপার ভেতরে গয়নার ছিটেফোটা ও ছিল না।অথচ আমি সন্ধ্যতেই দেখেছিলাম দিদি গয়নাগুলো এই বাক্স টা তেই ঢুকিয়ে রেখেছিলো!!!
বেশ নিরাশ হয়ে বাক্স টা আবার দিদির টেবিলের কোনায় এনে রেখে দিলাম। মাথায় ফন্দি ছিল যে গয়নাগুলো টয়লেটে ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাশ করে সাগরে পাঠিয়ে দিব। আমাদেত বাড়িতে যেন আর এসব না থাকে,,কিন্ত কিছুই হয় নি। উলটো বোকা বনে গেলাম,নিশ্চই দিদি আগেই গয়না সরিয়ে রেখেছে!।
তখন প্রায় মধ্যরাত , কারো গুনগুন করা আওয়াজে আমার ঘুম ভেংগে যায়। একটু ভয় ভয় নিয়ে তাকাতেই দেখি সেই কালো বাক্স টা টেবিলের উপর খোলা অবস্থাতে রয়েছে, ক্রমাগত ঝর্ণার মত রক্ত পড়ছে সেই বাক্স থেকে!! শক খাওয়া চোখে কিছুক্ষন সেদিকে তাকিয়্ব থাকার পর হুট করে পাশের খাটে ঘুমন্ত দিদির দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম একটা লম্বা চুলওয়ালা মহিলা দিদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর গুন গুন করে গান গাচ্ছে!!
সেই ছোট্ট আমির কাছে অই মহিলাটা প্রথমে মার মত লাগলেও পরে বুঝে যাই ইনি আমার মা নন৷ মহিলা হঠাৎ করে গুন গুন করে গান বন্ধ করে আমার দিকে ভয়ানক লাল চোখে তাকান,,বাচ্চা মানুষ আমি ভয়ে কান্না শুরু করে দেই। এক্টু পর দেখি সেই মহিলা আমারদ কাছে এসে তার লাল বেগুনি নেলপালিশ মাখা আংগুল দিয়ে নিজের লাল লিপস্টিক দেয়া ঠোটে ছুইয়ে আমাকে চুপ করতে ইশারা করলেন!!!!!! এরপর আমার আর কিছু মনে নেই বা মনে করতে পারি না,,সবকিছু কেমন জানি ঝাপ্সা ঝাপ্সা আসে স্মৃতিতে।তবে সেদিনকার আমার ছোট্ট মনের ভয় টা আজ উব্দি আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
মাঝাখানে প্রায় ২৭বছর কেটে গেছে, দিদির সেই রোগ টা আরো প্রকট হয়ে গেছে। এখন সারাদিন ই গয়না পড়ে থাকে,,আমরা কেও কিছু বলিনা। ভাগ্যকে আমি সেদিন ই মেনে নিয়েছি যেদিন জানতে পারি আমার আর দিদির মা এক নন। দিদির হওয়ার ২বছরের মাথায় বাবা নাকি আমার মা কে নিয়ে পালিয়ে যান।যতদূর জানি বাবার অমতে নাকি বিয়ে হয়েছিল,কিন্ত তাই বলে বাচ্চা নিয়ে একজন মেয়ের জীবন নষ্ট করার অধিকার বাবাকে কে দিয়েছিল সে প্রশ্ন টা আজ উব্দি বাবাকে করিনি। শুধু জানতে চেয়েছিলাম দিদির মার মৃত্য কিভাবে হয়েছিল,,,উত্তর টা একটু অস্বাভাবিক হলেও বুঝতে পেরেছিলাম উনি সাজতে সাজতে ই হাত ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলেন।মৃত্যর সময় হাত টা হয়তো সেই কালো বাক্স এর উপরেই পড়ে যার ফলে হাতের শিরার সব রক্ত এসে অই বাক্সতেই এসে জমা হয়।
এরপর বাবাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি, আমার মায়ের উপর দিনের বেলা কে ভর করতো বা দিদির উপর এখন দিনে কে ভর করে বা সেদিন রাতে আমি কাকে দেখেছিলাম সব প্রশ্নের উত্তর ই বেশ সহজ। এক্টু ভাবলেই বোঝা যায়।।
কিন্ত যে প্রশ্ন টা এখনো মাথার ভিতরে ঘুরপাক খায় তা হলো দিদির সহ্য শক্তি কি এত টাই বেশি ছিল মার থেকে যে কারনে মা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন???