ছেলেটির সাথে আমার পরিচয় বেশ অদ্ভুত ভাবে।
রাত ২.৩০ মিনিটে। ছেলেটি এসেছিলো তার ৯০ বছরের বুড়ো দাদী কে নিয়ে।
অজ্ঞান দাদীকে ট্রলিতে করে যখন ছেলেটা নিয়ে আসলো আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা টগবগে যুবক বাচ্চাদের মত কেঁদেকেটে একাকার হয়ে তার দাদীর হাত ধরে আছে।
আমি তখন ডিউটি ডাক্তার। তাড়াতাড়ি তার দাদীকে দেখে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলাম।
তার দাদীর ডায়াবেটিস ছিলো।
হাইপোগ্লাইসেমিক কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি।
তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট পাওয়াতে টুকটুকে সুন্দরী ধবধবে সাদা চুলের ৯০ বছরের সেই বৃদ্ধা জ্ঞান ফিরে পান।
আর তখনি আরো অবাক হলাম আমি। ছেলেটি দাদীর হাত ধরে চিৎকার করে হাউমাউ করে কাঁদছে। তার দাদী পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ছেলেটির প্রতি কেমন যেনো এক
মায়া কেমন যেনো এক কৌতুহল ভর করলো আমার মনে।
নাইট করার পর ডে অফ ছিলো আমার যার কারণে ছেলেটি বা তার দাদীর সাথে আর দেখা হয় নি আমার।
পরদিন যখন আমি হাসপাতালে গেলাম আমার রুমে আমার টেবিলের উপর এক তোড়া গোলাপ ফুল। কে রাখলো জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারলাম সেই ছেলেটি দিয়ে গিয়েছে তার দাদীর প্রাণ বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা স্বরুপ।।
কেনো জানি না পরম যত্নে আমি রেখে দিয়েছি এই ফুল।
আমার বাসার ফুলদানি তে ফুল টা শুকাচ্ছে আর আমি প্রতিদিন একবার করে ছেলেটাকে মনে করছি।
জীবন টা খুব অদ্ভুত। খুব অদ্ভুত ভাবে ছেলেটার সাথে আমার আবার দেখা হয়ে গেলো।
আমি ছেলে টাকে দেখলাম কিন্তু দূর থেকে।
সকাল বিকেল সময় করে একটু হাঁটার অভ্যাস আছে আমার। এক বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছি।
পার্ক এর মধ্যে দিয়ে আনমনে হাঁটছি। হঠাৎ উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শুনলাম। চোখ পড়লো পার্কের এক বেঞ্চে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম সেই ছেলেটি। সে হা হা করে হাসছে।
পাশে একজন বসা। সে আর কেউ নয় তার ই বৃদ্ধ দাদি।
বৃদ্ধার পাশে তার হুইল চেয়ার টা। তার হুইল চেয়ার তার বয়স কোনো টা দেখে ই মনে হচ্ছে না সে জীবনের সায়াহ্নে এসে উপস্থিত।
সেটা অবশ্যই সম্ভব হয়েছে তার নাতির কারণে।
আমি তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। কিন্তু কেনো জানি মনে হলো ছেলেটা আমাকে দেখেছে। শুধু তাই নয় আমার মনে হতে লাগলো তার দৃষ্টিসীমার সবটুকু পথ সে তাকিয়ে ছিলো আমার ফেলে আসা পথে।
বলা নেই কওয়া নেই অদ্ভুত এক জ্বালাতনে ফেলেছে ছেলেটা আমাকে। প্রায়ই সে আমার ভাবনায় এসে উকিঝুঁকি মারে। আর আমি শুকনো গোলাপের পাপড়ি প্রতিদিন একবার করে ছুঁয়ে যাই।
মাস খানেক পরের কথা। আমি হাসপাতালে এসে দেখি ছেলেটি। জানতে পারলাম তার দাদিকে ICU তে রাখা হয়েছে। তিনি জীবন মৃত্যুর শেষ সীমানায় পৌছে গেছেন।
আমার মন টা খুব খারাপ হলো। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো ছেলেটি সে একদম পাথর হয়ে আছে। আগের বারের মতন কোনো কান্নাকাটি নেই। কোনো ছেলেমানুষি নেই। যেনো সে খুবই পরিণত এক মানুষ এ পরিণত হয়েছে।
দুপুর একটা বেজে চুয়ান্ন মিনিটে তার দাদী মারা গেলো। ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছিলো শক্ত এক পাথর যেনো। আমার ইচ্ছে করছিলো তাকে একটু ছুঁয়ে দিই। একটু ছুঁয়ে দিলে যদি সে একটু কাঁদে। তার মন টা যদি একটু হালকা হয়!
হঠাৎ আমি এক কান্ড করলাম। গাড়িতে ছেলেটির পাশে গিয়ে বসলাম। ছেলেটি একটু ও অবাক হলো না। যেনো খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। গাড়ি তে আমি, ছেলেটি আর তার সদ্যমৃত দাদী।
গাড়ি গিয়ে থামলো মেডিকেল কলেজের গেটে। আমি অবাক হলাম।
গাড়ি তো যাওয়ার কথা গোরস্থানে!
আস্তে আস্তে আমি আবিষ্কার করলাম এই টুকটুকে সুন্দরী সাদা চুলের বৃদ্ধ মহিলা তার বডি মেডিকেল কলেজ কে দান করে গেছেন হাজার হাজার মেডিকেল শিক্ষার্থী কে ডাক্তার বানাতে সহায়তা করার জন্য।
যেমন বিস্ময়কর এই ছেলে তেমনি ৯০ বছরের তার দাদি।
সব ফর্মালিটি শেষ করে আমি আর ছেলেটি রাস্তা ধরে হাঁটছি। আমার কেনো জানি একটু ও লজ্জা করছে না। নিজের কাছে প্রশ্ন ও জাগছে না কেনো আমি এই ছেলেটির সাথে হাঁটছি?
ছেলেটি হঠাৎ রাস্তার পাশে বসে পরলো। আমি ও দ্বিধাহীন ভাবে তার পাশে বসে পড়লাম।
আমার হাত স্পর্শ করলো ছেলেটির হাত।
সাথে সাথে পাথর থেকে সে মানুষ হলো। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সে।
" আমার আর কেউ রইলো না।"
মর্মান্তিক ভাবে কাঁদতে লাগলো ছেলেটা।
আমি ও কাঁদছি অঝোরে।
কিন্তু তার হাত আমি ছাড়িনি।
কোনো দিনই আর ছাড়ি নি।
0 Comments