সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে পত্রিকা পড়ছিলাম। আমার অবশ্য এসব পত্রিকা পড়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। মা কয়েকদিন ধরে প্রেশার দেওয়া শুরু করেছেন আমাকে।
উনার ভাষ্যমতে, "জীবনে বড় হতে হলে প্রতিদিন পত্রিকা পড়তে হবে।"
আমি প্রতিদিন পত্রিকা নিয়ে বিনোদনের পাতাটা সবার আগে খুলি। কোন নায়িকা কি করছে, কোন নায়ক বর্তমানে ছ্যাঁকা খেয়েছে, কোন নায়িকা বর্তমানে সিঙ্গেল আছে এসব মুখস্থ করি। যদি এসব তথ্যের উপর কোনো বিসিএস পরীক্ষা হতো তাহলে নির্ঘাত আমি প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হতাম।
বিনোদনের পাতা শেষ করে বাকী পাতাগুলোর ছবি দেখছিলাম বসে বসে। হঠাৎ দেখি বিজ্ঞাপনের পাতায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে "গৃহ শিক্ষক আবশ্যক।" ভাবলাম একবার কল দিয়ে দেখি। কপালে জুটে গেলে মন্দ হয় না।
দুই বার রিং হতে ওপাশ হতে একজন মহিলা রিসিভ করে বললেন," হ্যালো, কে বলছেন?"
আমি কি সম্বোধন করব বুঝতে পারছিলাম না। কয়েক সেকেন্ড ভেবেচিন্তে উত্তর দিলাম," আন্টি পেপারে আপনার নাম্বারটা পেয়েছি............"
আমার কথা শেষ করার আগেই তিনি বলে উঠলেন, "মেয়ে মানুষের নাম্বার দেখলেই বুঝি কল দিতে ইচ্ছে করে তাই না?"
আমি উনাকে কীভাবে বুঝাবো যে বিজ্ঞাপনে প্রদত্ত নাম্বারের আশেপাশে কোথাও মেয়ের নাম উল্লেখ ছিল না। তারপরও ভদ্রতার খাতিরে চুপ রইলাম।
আমি আবার বললাম, " আসলে আমি বিজ্ঞাপন দেখে কল দিয়েছিলাম আন্টি। "
ওপাশ থেকে আবার রাগত স্বরে তিনি আমাকে বললেন," আমার স্বর শুনে কি আমাকে আপনার আন্টি মনে হয়?"
এবারও চুপ থাকলাম। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, "তাহলে কি ডাকবো আপনাকে? "
তিনি জানালেন," আপু ডাকবেন আমাকে। আর আপনি কি সত্যিই আগ্রহী? নাকি অন্যকোনো মতলব আছে?"
এ কেমন অভিভাবক!
এবারও আমি ভদ্রভাবে জানালাম, "আগ্রহী না হলে আপনাকে কল দিতাম না আপু। আর আপনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। সুতরাং অন্য মতলব আসার কারণটা কি আমি বুঝলাম না। "
এবারও তিনি আগের মতোই নির্লজ্জভাবে বললেন, "এখনকার মানুষজনের তো বিশ্বাস নেই। কে কোন মতলবে আসে বলা যায় না। আচ্ছা ঠিক আছে আপনি ঠিকানা নিন। সময়মতো চলে আসবেন।"
আমার নাম- ঠিকানা, কোথায় পড়ি, কি পড়ি, কেন পড়ি সব টুকে নিলেন তিনি। আমিও ধৈর্য্য সহকারে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে উনার ঠিকানাটা টুকে নিলাম।
বিকালবেলা আমি সময়মতো সঠিক স্থানে চলে গেলাম। গিয়ে আবার সেই নাম্বারে কল দিলাম। পাঁচবার কল দেওয়ার পর সেই আপুটা কল রিসিভ করলেন। রিসিভ করেই বললেন, "কে বলছেন?"
কথাটা শুনেই মেজাজ গরম হয়ে গেল। তারপরও ঠাণ্ডা থাকলাম। ধৈর্য্যের চুড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছি আমি। উনাকে জানালাম," ঐ যে আপু সকালে কল দিয়েছিলাম আমি।"
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, "কি জন্য?"
রাগ আর আটকে রাখতে পারলাম না। মাথা গরম করে বলে ফেললাম, " মানে কি এসবের? সকালবেলা এতো কথা বললেন, আমার নাম-ঠিকানা নিলেন। আর এখন এসব কি বলছেন আপনি।"
আমাকে জানালেন তিনি," আচ্ছা! আচ্ছা! এখন মনে পড়েছে আমার। আপনি কোন জায়গাতে আছেন এখন। "
আমি আমার পজিশন বললাম। আমাকে জানালেন তিনি, " আপনার ডানে একটা দশ তলা বিল্ডিং দেখছেন?"
আমি হ্যাঁ জানালাম। এরপর আমাকে উনি যা বললেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
আমাকে তিনি বললেন," তাহলে কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে ঐ বিল্ডিং এর নয় তলাতে H-4 ফ্ল্যাটে চলে আসুন। বিকালবেলা লিফট বন্ধ থাকে।"
ভাবলাম আজ এর শেষ দেখেই ছাড়ব আমি। কষ্ট করে উঠলাম। উঠে কলিং বেল চাপলাম। বেল চাপা মাত্রই এক লাল শাড়ি পরিহিতা মাঝ বয়সী সুন্দরী মহিলা দরজা খুলে দিলেন। মুহূর্তেই আমার সমস্ত রাগ উবে গেল। সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলাম। ড্রয়িংরুম দেখেই বোঝা যাচ্ছে সচ্ছল পরিবার। তাহলে টাকাপয়সা নিয়েও হয়ত তেমন ঝামেলা হবে না।
কিছুক্ষণ পর ঐ মাঝবয়সী মহিলার সাথে আরেক জন সুন্দরী মাঝবয়সী মহিলা এসে আমার সামনে বসলেন। আগের সেই মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আসলে আমি দুঃখিত। আপনাকে কষ্ট দিলাম।"
আমি বললাম, "ও কিছু না আপু। কয়দিন আসতে হবে আমাকে?"
হালকা হেসে তিনি বললেন," কয়দিন মানে? সবসময় আসতে হবে।" "আচ্ছা আপনারা কথা বলুন। আমি একটু আসছি।" বলে তিনি হঠাৎ করে ভিতরে চলে গেলেন। আমার সামনে বসা মাঝবয়সী মহিলাটি বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন কিন্তু কোনো কথা বলছিলেন না। অস্বস্তি লাগছিল আমার। তাই আমিও কোনো কথা না বলে মাথা নিচুঁ করে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর লাল শাড়ি পরিহিতা মহিলাটি এসে আমার সামনে একপ্লেট মিষ্টি রেখে আমাকে বললেন, "নিন, মিষ্টি খান।"
একটা মিষ্টি নিয়ে মুখে দিলাম আমি।
তিনি বসে থাকা মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, " কিরে কেমন লাগলো তোর? পছন্দ হয়েছে?"
মুখের ভিতর থাকা মিষ্টিটুকু আটকে গেল হঠাৎ। কি বুঝাতে চাইছেন তিনি? আমি 'হা' করে তাকিয়ে রইলাম। আমার সামনে চুপচাপ বসে থাকা মহিলাটি ছোট্ট করে 'হ্যাঁ' বলে দৌড় দিলেন।
লাল শাড়ি পরিহিতা মহিলাটি আমাকে বললেন, "যাক আমার বোনের আপনাকে পছন্দ হয়েছে।"
আমি তাড়াতাড়ি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম," টিউশনের সাথে এই আপুটার পছন্দ হওয়ার কি সম্পর্ক? "
উনি কেমন জানি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর আমাকেই উল্টো জিজ্ঞেস করলেন,"কিসের টিউশনের কথা বলছেন আপনি? আমি বুঝতে পারছি না।"
আমি বললাম," আমি তো পত্রিকায় 'গৃহশিক্ষক আবশ্যক' বিজ্ঞাপন দেখেই আপনার নাম্বারে কল দিয়েছিলাম। "
আমার কথা শুনে তিনি রেগে গেলেন। টেবিলে রাখা একটি পত্রিকা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বললেন, "আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম অন্যকোনো মতলব আছে কিনা! ঠিকই ধরেছিলাম আমি। বিয়ে না করলে আপনাকে পুলিশে দিব আমি। পত্রিকাতে দেখুন তো ঠিক কোথায় কল দিয়েছিলেন আপনি।"
আমি তাড়াতাড়ি পত্রিকাটি হাতে নিয়ে বিজ্ঞাপনের পাতাটা খুলে "গৃহশিক্ষক আবশ্যক" বিজ্ঞাপনের সাথে নাম্বারটা মিলালাম। নাম্বার মিলল না। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম আমি "গৃহশিক্ষক আবশ্যক" বিজ্ঞাপনের ঠিক নিচে "ডিভোর্সি কন্যার জন্য ঘরজামাই আবশ্যক" বিজ্ঞাপনের নাম্বারে কল দিয়েছিলাম।
আমি কিছু না বলে উনার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। এরপর কথাবার্তা ছাড়াই দরজার দিকে দৌড় দিলাম। এক দৌড়ে বিল্ডিং এর নিচে চলে এলাম। এরপর উল্টোরাস্তা ধরে দৌড় দিলাম। কারণ কোনো একবার আমি বলেছিলাম, " জীবনে বাঁচতে হলে প্রচুর দৌঁড়াতে হবে।"