গল্পঃ """চুড়ি""'
•
অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।বৃষ্টির প্রতিটা ফোটায় ফোটায় আকাশটা পরিবর্তন হচ্ছে।ফারাহ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আপন মনে প্রকৃতির লীলা-খেলা দেখে যাচ্ছে।মাঝে মাঝে তার হাতটা আলতু করে বৃষ্টির ফোটায় বাঁড়িয়ে দিচ্ছে।বৃষ্টির ফোটা হাতে পরতেই মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠে।ফারাহর খুব ইচ্ছা করছে তার স্বামীকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে, খুব ইচ্ছা করছে তাকে কাছে পেতে।কিন্তু সে কাছে নেই, দুঃখে তার মনটা মেঘে ডেকে যায়।তাই মনমরা হয়ে বৃষ্টির ফোটার সাথে খেলা করে যাচ্ছে।
.
তাওহীদ অফিসের কাজ শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছে।হঠাৎ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই দেখে, অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।তাওহীদেরও খুব ইচ্ছা করছে ওর স্ত্রীকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে, একটু কাছে পেতে।কিন্তু পারছে না, ডিউটিতে আটকে আছে।যদি চাকরি না করে তাহলে পেটে পরবে কি? আর চাকরিই না থাকলে ভালোবাসা দিয়ে কি জীবন চলবে? এমনেতেই এক-দুই মাস ধরে খুব চিন্তায় আছে।হঠাৎ করে তার মা অসুস্থ হয়ে যায়।তার ভাবনার শেষ নেই কখন মা ভালো হবে।মার জন্য মাসে অনেক টাকার প্রয়োজন পরছে।তার মাঝে আবার নতুন সংসার শুরু করেছে।যখন সে ব্যাচালার ছিল, তখন খুব ভাল ছিল, কখনও এত চিন্তায় পড়তে হয়নি।
•
পকেট থেকে ফোন বের করে ফারাহকে কল দেয়।
- ক্রিং ক্রিং ক্রিং
হঠাৎ ফোনের শব্দে ফারাহ বাস্তব জগতে ফিরে আসে।ফোনের স্কিনে তাওহীদের নামটা দেখে মনে এক শান্তি অনুভব করে।
- আসসালামু আলাইকুম।কি করছেন?
- ওলাইকুম আসলাম।অফিসের কাজ শেষ করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি আর বৃষ্টি দেখছি।তুমি কি করছ?
- আমি ঘরের কাজ শেষ করে।আপনার মতই বৃষ্টি দেখছি।আচ্ছা অফিস থেকে কখন বের হবেন?
.
দু-জনের মনে একই ইচ্ছা ছিল, বৃষ্টি বিলাস করা।কিন্তু কেউ কারো মনের কথা প্রকাশ করতে পারছে না।মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না।কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাওহীদ বলে
.
- এই তো এক-দুই ঘন্টা পরেই বের হবো।কেনো বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে?
- না না কোন সমস্যা হয়নি; আপনার তাড়াহুড়ো করতে হবে না।আপনি সাবধানে আসবেন।
- ঠিক আছে, তোমার কিছু লাগবে?
- না না আমার কিছু লাগবে না।
অফিস টাইমে তাওহীদের সাথে একবার কথা বললে ফারাহর অনেক ভাল লাগে, অনেক ভালো সময় কাটে।যেটা সে বলে কখনও প্রকাশ করতে পারবে না।শুধু সেটা অনুভব করতে পারে।বিষণ্ণ মনে দু-জনেই বৃষ্টি পড়া দেখে যাচ্ছে।
•
ফারাহ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বিকলের ডুবন্ত সূর্য দেখতে থাকে।তার মনটা মনমরা হয়ে আছে।কোন কিছুই ভালো লাগছে না।মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাড়িতে কল দেয়।
- ক্রিং ক্রিং ক্রিং
তার ননদ মাওয়া ফোন রিসিভ করে।
- হ্যালো ভাবি মনি
- কেমন আছ?
- ভালো আছি।তুমি কেমন আছ?
- আমিও ভালো আছি।মার শরীরটা এখন কেমন? বাবা কেমন আছেন?
- মা ভালো আছে।বাবাও ভালো আছে।তোমরা কেমন আছ?
- হ্যাঁ আমরাও ভালো আছি।মা কি জেগে আছেন? না ঘুমিয়ে আছেন? বাবা কোথায়?
- মা ঘুমিয়ে আছে।বাবা বাহিরে আছে।
- ইফতারী তৈরি করেছ?
- না এখন করব
- ফোন রাখি? কোন অসুবিধা হলে খবর দিবে
- হ্যাঁ রাখ, ঠিক আছে।
.
এভাবে প্রতিদিনেই বাড়িতে ফোন করে খবর নেয়।কিন্তু শাশুড়ির সেবা করতে পারে না।কারণ উনার নিষেধ।কিছুদিন আগে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যান।কিন্তু উনি ফারাহকে বলেন, আমি মোটামুটি সুস্থ আছি।তোমার বাড়িতে আসতে হবে না, তুমি আমার ছেলেটাকে দেখো।যদি বেশি অসুস্থ হয়ে যায় তখন খবর দিব।ফারাহকে আর কিছু বলার সুযোগ দিতো না।
.
তাওহীদের চাকরির বয়স অনেক হয়।তারপরেও সে বিয়ে করে না।কিন্তু তার মার জুড়াজুড়িতে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে হয়।কারণ একমাত্র ছেলেকে যে শহরে কষ্ট করে থাকতে হয়।উনি ছেলের এই কষ্ট সহ্য করতে পারছিলেন না।তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দেন।তাওহীদ বাধ্য ছেলের মতো মাথা পেতে নেয়।
•
কলিং বেল বাজাতেই ফারাহ দরজা খুলে।সে ব্যাগটা নিয়ে রুমে যায়।তাওহীদ ফ্রেশ হতে বাথরুমে চলে যায়।বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে, ফারাহ মন খারাপ করে বসে আছে।কারণ তার আইসক্রীমের বক্স শেষ।কিন্তু সে তাওহীদকে বলতে পারেনি; তাকে বলতে লজ্জাবোধ করে।ফারাহ আধুনিক যুগের মেয়ে হয়েও তার মাঝে কোন আধুনিকতা নেই।তাওহীদের কাছে তার কোন চাওয়া-পাওয়া নেই।শুধু তার একটাই চাওয়া একটু ভালোবাসা পাওয়া।ফারাহকে তাওহীদ জিজ্ঞাসা করে
.
- তোমার কি মন ভালো নেই?
একটু অভিমানী সুরে সে বলে
- না মন ভালো আছে।
- আমার মনে হচ্ছে তোমার মন ভালো নেই
- ...(মনে মনে বলে, এতই যখন বুঝেন তাহলে আইসক্রীমের বক্স কেন নিয়ে আসেননি? কোন সময় তো বলতে হয় না, তার আগেই চলে আসে)
- কি হলো চুপ করে আছ যে?
- বললাম তো মন ভালো আছে
তাওহীদ ধরে ফেলেছে কেন সে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।মুচকি হেসে সে বলে
- ইফতারী তৈরি করেছ?
- না
- তাহলে চল আজ দু-জনে মিলে ইফতারী তৈরি করি
মুখ কালো করে বলে
- না আমি একাই পারবো।
তারপর দু-জনে মিলে ইফতারী তৈরি করতে থাকে।
- আচ্ছা মন খারাপের কারণটা তো এখনও বললে না!
- এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না।
- অপরাধী ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
তারপর দু-জনে মিলে ইফতার করে, নামাজ পড়ে।
.
ফারাহ বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ রাতের শহরের দিকে তাকিয়ে থাকে।তাওহীদ ওর মনের মেঘটা দূর করতে ফ্রিজ থেকে আইসক্রীমের বক্সটা নিয়ে এসে মুখের সামনে ধরে রাখে।মুহূর্তের মাঝে তার মনের মেঘটা দূর হয়ে যায়, মুখে হাসি ফুটে উঠে।এক দৃষ্টিতে দিকে তাকিয়ে থাকে।তাওহীদও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
- তাকিয়ে কি দেখছেন? খাইয়ে দিবেন না? নাকি আমার হাতে খেতে হবে?
ফারাহর কথা শুনে বাস্তবে ফিরে আসে।
- হা কর!
আবার রাগ-অভিমান এর ভাব নিয়ে ফারাহ বলে
- না আমি খাব না, আমি আইসক্রীমের বক্স ফেলে দিব!
- খাবে না কেন? ফেলে দিবে কেন?
- আমাকে এতোটা সময় কেন কষ্ট দিয়েছেন? কেন আগে বলেননি?
- আগে বললে তোমার এই রাগ মাখা মুখটা দেখতে পারতাম? গাল ফুলিয়ে থাকা মুখটা দেখতে পারতাম?
- কিহ! যান আমি খাবই না।
কথাটা বলে রাগে অন্যদিকে মুখটা ফিরিয়ে নেয়।
মুখের সামনে আইসক্রীম ধরে তাওহীদ বলে
- এই যে অভিমানী বউ রাগ করে না।স্বামী কষ্ট করে নিয়ে এসেছে, না খেয়ে থাকে না।
অভিমান করে আর থাকতে পারেনি।তাওহীদ খাইয়ে দিচ্ছে, ফারাহ ভেজা ভেজা চোখে খেয়ে যাচ্ছে।চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে
কাঁদছ কেন অভিমানী বউ! আর কেঁদো না।জানো না তুমি কাঁদলে কেউ একজন কষ্ট পায়।
- ফারাহ কি বলবে! এমন কথা শুনে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে।এক দৃষ্টিতে তাওহীদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর ফারাহ তাওহীদকে খাইয়ে দেয়, সে বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে যায়।
.
বাসর রাতে ফারাহ বলেছিল, আমার বিশেষ কোন আবদার নেই।আপনাকে একটু সেবা করতে দিয়েন।মন চাইলে ভালোবাইসেন।ফারাহর এমন কথায় অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়েই ছিল, কিছু বলতে পারেনি।আর একটা কথা আপনি আমাকে মাঝে মাঝে আইসক্রীম খাওয়াবেন।এটাই আমার আবদার।কথাটা শুনে মুচকি হেসে, মাথা নাড়িয়েছিল।তাওহীদ কথাটা মনে রেখেছিল।তারপর থেকে ফারাহর জন্য; আইসক্রীমের বক্স ফ্রিজে ফেলে রাখতো।
•
রাতের খাবার খেতে খেতে মাওয়া বলে
- মা! ও মা! ভাইয়া আর ভাবি মনি কি ঈদের সময় বাড়িতে আসবে না?
- না, তারা বাড়িতে আসবে না।
- কেন?
পাশ থেকে তাদের বাবা বলে
- আসবে না কেন? এটা কেমন কথা!
- আমি তাদেরকে আসতে না করেছি; যেহেতু সময় বেশি নেই।আর রাস্তাঘাটও তো ভাল না।এই ভীরের মাঝে এসে কি করবে? যদি কিছু হয়!
- কিন্তু মা!
- কোন কিন্তু না, আগামী ঈদের সময় ছুটি বেশি নিয়ে তারা বাড়িতে আসবে।
অভিমানী সুরে সে বলে
- তাহলে আমার কাপড় কে কিনবে?
- তোর ভাইয়াই কিনবে তারপর একটা ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিবে।
তাদের বাবা বলে
- তারা আসবে না পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে?
- এতো বেশি বুঝতে যান কেন? কোন কিছু হলে পরে তারা আমাদের দেখাশুনা করবে? না সারা বছরে আমাদের একটা খবর নিবে?
মন খারাপ করে চুপচাপ বাবা, মেয়ে খেতে থাকে।কেউ আর কোন কথা বাড়ায়নি।
.
সাহরীর সময় খেতে খেতে ফারাহ বলে
- বাড়িতে ফোন দিয়েছিলাম তারা সবাই ভালো আছে।
- তাদের কোন কিছু লাগবে? এমন কি কিছু বলেছে?
- না, তেমন কিছু বলেনি।
- ও আচ্ছা
- আচ্ছা তাদের জন্য ঈদের কিনাকাটা করবেন না?
একটু উদাস মনে সে বলে
- হ্যাঁ কিনাকাটা তো করবই; সবার জন্যই করব।
তাওহীদ এমন ভাবে কথা বলাতে ফারাহ চমকে উঠে।
- কথাটা এভাবে বললেন কেন? কোন সমস্যা হয়েছে?
- না, কোন সমস্যা হয়নি।
- ও আচ্ছা, আমি তো অনেক ভয় পেয়েছিলাম।
খেতে খেতে আরও অনেক কথা বলে।
.
অফিসে বসে চোখ বন্ধ করে তাওহীদ চিন্তা করছে, কিভাবে কি করবে? সে এক কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছে।কিভাবে সে সমস্যা থেকে উঠবে! ভেবে পাচ্ছে না।
এমন সময় এক কলিগ বলে
- তাওহীদ সাহেব! এমন কি চিন্তা করছেন? এই যে এত করে ডাকছি কোন খবর নেই!
- কোন চিন্তা করছি না তো, একটু চোখ গুলো বন্ধ করেছিলাম।
অন্য আর এক কলিগ বলে
- নতুন বিয়ে করেছে একটু সমস্যা তো হবেই; অন্য এক সময় বউ আদর করলে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
কথাটা বলে এক সাথে সকলে হেসে উঠে।
- আপনারা যে কি শুরু করেছেন না! এমন কিছুই হয়নি।
প্রেত্যেকে মুচকি মুচকি হেসে, তারপর যে যার কাজে মন দেয়।কিন্তু তাওহীদের চিন্তা শেষ হচ্ছে না।কয়েকদিন পরেই ঈদ।কিন্তু এখন তার হাতে তেমন টাকা নেই।তার কাছে যে টাকা আছে, তাতে এক-দুই ছাড়া প্রত্যেকের হয়ে যাবে।তাদের বস বলেছিল, ঈদের বোনাস দিবে।কিন্তু অফিসের এক সমস্যার জন্য; বোনাস দিতে পারছে না।বোনাসটা পেলে তার কোন সমস্যাই থাকতো না।মনে মনে বলে, যদি টাকায় না হয় তাহলে আমার ও ফারাহর জন্য বাকি রেখে দিব।এভাবে আরও নানা রকমের কথা ভাবতে থাকে।
•
কলিং বেল বাজাতেই ফারাহ দরজা খুলে।তাওহীদের মন মেজাজ দেখে, ফারাহ জিজ্ঞাসা করে
- কি হয়েছে আপনার? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
- কোন কিছু হয়নি; আমি ঠিক আছি।
- আপনার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।
- না না তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো
- কি হয়েছে বলেন না!
- আচ্ছা ফারাহ কোন বিশেষ আনন্দ মুহূর্তে, যদি তোমাকে কোন উপহার দিতে না পারি তাহলে তোমার মন খারাপ থাকবে?
- না, মন খারাপ হবে না।যদি কেউ মন থেকে দোয়া করে, ভালোবাসে।তাহলে মন খারাপ করে থাকার প্রশ্নই আসে না।কিন্তু হঠাৎ এই কথা কেন?
- ফারাহ ঈদে সবাইকে উপহার দিতে পারব না, আমার কাছে মনে হচ্ছে।এক-দুই জন বাকি পরতেও পারে।কারণ আমার হাতে তেমন টাকা নেই।ভেবেছিলাম বোনাস পাব, কিন্তু অফিসের এক সমস্যাই সেটাও হলো না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারাহ বলে
- আপনি প্রথমে বাবা-মা-বোন ও আপনার উপহার কিনে নিবেন।তারপর যদি টাকায় হয় আমাকে কিনে দিবেন।আর যদি না হয় আমার জন্য কিনতে হবে না।
- এটা তুমি কি বললে?
- হ্যাঁ যেটা বলছি সেটাই করেন।
- এমন টা আমি করতে পারব না।
- নতুন কাপড়ে ঈদ করতে হবে! এমন তো কোন কথা নেই।
- কিন্তু ফারাহ!
- আর কোন কিন্তু না।
তাওহীদ কিছু বলতে পারেনি; তার দিকে তাকিয়েই থাকে।তারপর ফ্রেশ হতে বাথরুমে চলে যায়।
•
ইফতারীর পর বাড়িতে ফোন দেয়।
- হ্যালো ভাইয়া
- কেমন আছিস? বাবা-মা কেমন আছে?
- ভালো আছি।তারাও ভালো আছে। ভাইয়া! তোমরা নাকি বাড়িতে আসবে না?
- না, মা না করেছে।
অভিমানী সুরে বলে
- আমার জন্য ঈদের কাপড় পাঠাবে না?
- দুই-তিন দিন পর পাঠিয়ে দিব।মার কাছে ফোনটা দে!
- কেমন আছিস খোকা?
- ভালো আছি তুমি কেমন আছ? বাবা কেমন আছে?
- আমি ভালো আছি।তোর বাবাও ভালো আছে।
- তোমার জন্য কি পাঠাব বল?
- এই বুড়ো বয়সে ঈদের রঙ কি আর আমার আছে? কিছু লাগব না।
- কি যে বল না! তাতে কি হয়েছে?
- না খোকা আমার কিছু লাগব না।
- বাবা কোথায়?
- নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিল এখনও আসে নাই।পরে আসলে কল দিব ঠিক আছে! তোরা ভালো থাকিস
- আচ্ছা মা তোমরাও ভালো থেকো।
ফারাহ চুপচাপ তাদের কথা শুনে যাচ্ছিল।তার মনের মাঝে এক অদ্ভুদ ভালো লাগা কাজ করছিল।
.
তাওহীদের চোখে ঘুম নেই, সে ঘুমাতে পারছে না।ফারাহকে কিছু দিতে পারবে না! এটা সে ভাবতেই পারছে না।সে ভাবছে, তাকে একটা কিছু হলেও দিবে।কিন্তু এমন কি জিনিস দিলে ফারাহ খুশি হতে পারে! ফারাহর দিকে তাকাতেই দেখে, ঘুমের মাঝেও হাসি লেগে আছে।সব সময় এই হাসিটা মুখে লেগেই থাকে।তাওহীদের প্রতি তার কোন মান-অভিমান নেই।কোন চাওয়া-পাওয়া নেই।শুধু একটাই চাওয়া একটু ভালোবাসা।এতটুকুতেই সে খুশি।ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে থাকে।
•
দু-জনে ঘুরাফেরা করতে করতে বাবা-মা-বোন এর জন্য কাপড় কিনতে থাকে।হঠাৎ ফারাহ থমকে দাঁড়ায়।এই দৃশ্যটা তাওহীদের চোখকে এড়িয়ে যেতে পারেনি।সে দেখে, ফারাহ এক দৃষ্টিতে চুড়ির দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ এক শব্দে স্মৃতি থেকে ফিরে আসে।কিন্তু তাওহীদকে কিছু বলতে পারেনি।মনে মনে তাওহীদ অনেক কষ্ট পায়।এখন তার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।এক সময় ফারাহর আড়ালে চুড়ির দোকান থেকে চুড়ি কিনে নেয়।মার্কেটিং করে মেঘে ডাকা মনে দু-জনেই বাসায় ফিরতে থাকে।
.
- কিরে কাপড় পছন্দ হয়েছে?
- খুব পছন্দ হয়েছে।কে পছন্দ করেছিল?
- কেন আমি করেছি।তোর ভাবি মনির কি পছন্দের চোখ আছে?
- কিহ! এত বড় কথা? কত কষ্ট করে পছন্দ করলাম আমি।আর এখন বলছেন আপনি পছন্দ করেছেন?
- ভাবি মনি রাগ করো না।আমি সব বুঝি জানি।কারণ ভাইটাকে তো ছোট থেকে দেখে আসছি।
মাওয়ার কথার সাথে সাথে সেও তাওহীদকে জিহবা দেখায়।
- এই কাজ সেরেছে।ভাবি আর ননদ এক হয়েছে।
তারা এক সাথে হেসে উঠে।মাওয়া বলে স্যরি বল
- আচ্ছা কি আর করব স্যরি
- হিহিহি
দূর থেকে তাদের মা খুনসুটি দেখে আর হাসে।
•
পশ্চিম আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে।চারদিকে রমজানের ঐ রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ গানটা বেজে চলেছে।ফারাহ বিষন্ন মনে ঈদের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
.
তাওহীদের বাড়িতে সবাই আনন্দে মেতে থাকে।কিন্তু তার পরিবারের কারো মনে আনন্দ নেই।মাওয়া মন খারাপ করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।এক সময় চোখের কোণে পানি চলে আসে।তাদের বাবা-মা কিছুক্ষণ পর পর রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।এই বুঝি তাদের ছেলে ও বউ-মা এসেছে।কিন্তু তারা আর আসে না।কখন যে চোখে পানি আসে বুঝতেই পারেনি।চোখের পানি মুছে মুচকি হেসে ফেলে।
.
ফারাহর গায়ে হাত পরতেই ফিরে তাওহীদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দেখে, ফারাহর চোখের কোণে জল জমে আছে।তার বুকের মাঝে ছেদ করে উঠে।ফারাহকে কিছু বলতে পারছে না।শুধু তার বুকের ব্যথাটা অনুভব করে যাচ্ছে।দু-হাত দিয়ে ফারাহর চোখের পানি মুছে দিচ্ছে, নিজের দু-চোখ থেকেও অশ্রু ঝরছে।তাওহীদের চোখের পানি মুছে দিয়ে নিজেও আবার কাঁদতে থাকে।কেউ কথা বলতে পারছে না, কেঁদেই চলেছে।কিছুক্ষণ পর তাওহীদ বলে
.
- তোমার জন্য ঈদের কাপড় কিনতে পারলাম না।ফারাহ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও!
- সে কেঁদেই চলেছে কিছু বলতে পারছে না।
- ফারাহ আমি তোমার স্বামী হওয়ার যোগ্য নয়।
তাওহীদের মুখে হাত দিয়ে সে বলে
- এমন কথা মুখেও নিবেন না।কে বলেছে আপনি আমার যোগ্য না? যদি যোগ্য না হতেন তাহলে আল্লাহ আমার জীবনে আপনাকে পাঠাত না।
- না ফারাহ আমি তোমার জন্য না।
- চুপ করেন আর কোন কথা শুনতে চাই না।
দু-জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর ফারাহ তাওহীদের বুকে মাথা রেখে ঈদের চাঁদ দেখতে থাকে।তাওহীদ পরম আদরে বুকে জড়িয়ে রাখে।
•
- ক্রিং ক্রিং ক্রিং
- হ্যালো!
- ঈদ মোবারক ভাবি মনি
- ঈদ মোবারক ননদী
- আমার ঈদের সালামি?
- বিকাশে পেয়ে যাবে।
- ঠ্যাংকু ভাবি মনি।ভাইয়া কোথায় সালামি দিবে না?
- দিবে, বাবা-মা কোথায় আছে?
- পাশেই আছে।
তারা দু-জনে এক সাথে বলে
- ঈদ মোবারক
তারাও এক সাথে বলে
- ঈদ মোবারক
প্রত্যেকের চোখের কোণে পানি চলে আসে।কিছুটা সুখের, কিছুটা দুঃখের, কিছুটা আনন্দের।
•
তাওহীদ নামাজ পড়তে ঈদ-গা মাঠে চলে যায়।ফারাহ রান্নার কাজ শেষ করে ঘর গুছাতে শুরু করে।সব কাজ শেষ করে তাওহীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।কলিং বেল বাজাতেই ফারাহ দরজা খুলে দেয়।ফারাহকে অগুছালো দেখে তাওহীদ বলে
.
- কি ব্যাপার! তুমি এখনও রেডি হওনি?
- আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
.
ফারাহ গোছল করতে বাথরুমে চলে যায়।এই সুযোগে চুড়ি গুলো বের করে, নীল কালারের একটা শাড়িও রেডি করে রাখে।ফারাহ বাথরুম থেকে বের হতেই; তাওহীদ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে।ভেজা চুলে তাকে অপূরুপ লাগছে।বিন্দু বিন্দু জল গাল বেয়ে পরছে।তাওহীদের এক দৃষ্টিতে তাকানো দেখে, ফারাহ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।খাটের উপর চোখ পরতেই; ফারাহ বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।ভাবতেই পারছে না, দোকানের চুড়ি গুলো তার চোখের সামনে ভেসে আছে।ফারাহর এই অবস্থা দেখে, তাওহীদ মুচকি মুচকি হাসছে।ফারাহ রাগ করবে! কাঁদবে! নাকি হাসবে! বুঝতে পারছে না।সে এতই খুশি হয়েছে।
.
একটু রাগ দেখিয়ে ফারাহ বলে
- এই গুলো কি? এই গুলো আনতে কে বলেছে?
মন কালো করে অসহায় লুক নিয়ে বলে
- কেউ বলেনি; আমার পছন্দ হয়েছিল তাই নিয়ে এসেছিলাম।ভেবেছিলাম তোমারও পছন্দ হবে।
- এই গুলো কোনো চুড়ি হলো! দোকানে কি আর ভালো চুড়ি ছিল না?
কথাটা শুনে তাওহীদের চোখের কোণে পানি চলে আসে
- থাক রেখে দাও পরে এক সময় দিয়ে আসব।
ওর চোখের কোণে পানি দেখে তার হৃদয়টা কেঁদে উঠে।মনে মনে বলে, মজা যে করেছি উনি বুঝেননি।মজাটা না করলেও পারতাম।
- সত্যিই আপনি একটা বোকা ছেলে! মজা করেছি কেন বুঝেননি? উল্টা কেঁদে ফেললেন।
মুখে হাসি নিয়ে
- সত্যি
- তিন সত্যিই।আপনি যেটা পছন্দ করবেন সেটা আমি পছন্দ করব না! এটা কি করে ভাবলেন?
তাওহীদ মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
- আমি নীল শাড়িটা পড়ে আসছি; আজ আপনি আমাকে সাজিয়ে দিবেন।
•
তাওহীদ সাজিয়ে দিচ্ছে, ফারাহ অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মনে মনে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করছে।মুখে একটা হাসি লেগেই আছে।তাওহীদ একটা একটা করে চুড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে, ফারাহ নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখে যাচ্ছে।সব গুলো পড়িয়ে দেওয়ার পর চুড়ি গুলো নিয়ে খেলা শুরু করে দেয়।নীল কালার শাড়ি, নীল চুড়ি, লাল চুড়ি, সবুজ চুড়ি, হলুদ চুড়িতে তাকে খুব সুন্দর লাগছে।তাওহীদ ফারাহকে নয়ন ভরে এই রুপে দেখতে থাকে।হঠাৎ ফারাহ ওর দিকে তাকিয়ে কান্না করে দেয়।তাওহীদ চোখের পানি মুছে দিতেই; ওর বুকে মুখ লুকায়।তাওহীদ পরম আদরে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে।ফারাহ তাকে আরও শক্ত করে ধরে।
.
অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে, দু-জনে এক সাথে বৃষ্টি পড়া দেখছে।মাঝে মাঝে তাদের হাত গুলো আলতু করে বৃষ্টির ফোটায় বাঁড়িয়ে দিচ্ছে।মাঝে মাঝে একে অপরকে বৃষ্টির পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে।দুজনেই হাসছে, বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচতে মিথ্যা চেষ্টা করে যাচ্ছে।আবার মাঝে মাঝে ফারাহ মাথা নাড়িয়ে, চুড়ি নাড়িয়ে, জিহবা দেখিয়ে তাওহীদকে ভিজিয়ে দিচ্ছে আর হাসছে।তাওহীদ মুগ্ধ নয়নে মন ভরে দেখতে থাকে।
•
0 Comments