চোরের মতো দরজাটা নিঃশব্দে খুলল, বাসার সকল লাইট অফ,, পাশের বাসার বাতির আলো বারান্দায় এসে পড়ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে নজরে পরেনি। পকেটে মাত্র পাঁচ শত টাকা। পরনে একটা টি শার্ট আর প্যান্ট।
রাত প্রায় এগারোটা। চৌরাস্তার মোড়ের গোল চত্বরটা একবারেই ফাঁকা। শহরের এটাই একমাত্র নির্জন স্থান যেখানে রাত গভীর হওয়ার আগেই মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে আয়ন ল্যাম্প পোষ্টটার নিচে এসে দাঁড়ালো। লাল আলোয় নিজের ছায়াটা দেখছে,, কেমন অদ্ভুদ লম্বা একটা ভূতের মতো।

পকেট থেকে ফোন বের করে ইরার কাছে কল করলো,
-- তুমি ঠিক মতো আসতে পারবে তো?
নাকি আমি আসবো?
ইরা ভীতু কন্ঠে ফিস ফিস করে উত্তর দিলো,
-- না,, তুমি এসো না। তাহলে তো সর্বনাস হয়ে যাবে। আমি আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি,, তুমি অপেক্ষা করো। আমি আসবোই।
-- আচ্ছা, ল্যাম্প পোষ্টটার নিচে চলে এসো,, আমি দাড়িয়ে আছি।
-- আচ্ছা, এখন রাখো। আমি আসছি। তুমি থেকো কিন্তু।
আজ ইরার হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয় কিন্তু সে একদম রাজি না। কথাটা তার পরিবার কিছুতেই মানতে চায়ছে না। বাধ্য হয়ে সে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ফোন কেটে আয়ন দাড়িয়ে আছে।

ইরা এই জায়গাটা চিনে আসতে অসুবিধা হবে না। কারন, রোজ বিকেল দু'জনের সময়টা এখানেই কেটে যায়,, বিকেলে বেলা ল্যাম্প পোষ্টার নিচে একটা ফুচকাওয়ালা আসে,, সব সময় তারা এখানেই ফুচকা খায়।
কেউ নেই চারপাশে,, এবারে ভূতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। মাঝে মাঝে দূরে কোথায় যেন কুকুর ঘেউ ঘেউ করে,, ভয়ে মনটা একটু দুর্বল হলেও শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকে। যা হবার হবে।
ভাগ্য যেন সহায় হলো, একটা সিএনজি আসছে মনে হয়,, মাঝ রাস্তায় দাড়িয়ে আয়ন সিএনজি -টা আটকে দিলো।
-- মামা, আমাকে একটু হেল্প করেন প্লিজ।
-- কই যাইবেন?
-- জানি না, আপনি একটু দাড়ান। আমার সাথে আরেক জন লোক আছে, সে বলতে পারবে। ভাড়ার সমস্যা নাই,, আপনি শুধু আমাদের পৌঁছে দিলেই হবে।
আয়ন কথা শুনে মনে হচ্ছে সে খুব বিপদেই আছে,, ড্রাইভার সাহায্যে জন্য দাড়ালো।

বিশ মিনিট হয়ে গেছে কিন্তু এখনো ইরার দেখা পাওয়া যায়নি। আয়ন খুব টেনশনে আছে। সে কৌতুহলি হয়ে এখান থেকে ওখানে পায়চারি করতে লাগলো।
-- কি ভাই, এখনো তো আপনার লোক আসেনি।
-- আসবে মামা আরেকটু অপেক্ষা করেন। আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দেবো।
"রাত পৌনে বারোটা"
এখনো ইরা আসেনি। ড্রাইভার একটা সিগারেট ধরিয়ে গাড়ির ভেতর বসে আছে।

আয়ন বিরক্ত হয়ে ইরাকে ফোন দিলো কিন্তু এই মুহূর্তে সুইচ অফ বলছে। সে খুব চিন্তায় পড়ে গেলো। তবে ইরা তো বলেছিলো অপেক্ষা করার জন্য সে আসবেই,, আমার কথা কখনো অমান্য করবে না। আজ পর্যন্ত কখনো আমার সাথে মিথ্যা বলেনি।
"রাত বারোটা পনেরো"
ড্রাইভার রেগে যাচ্ছে,, এতোক্ষণ সে অপেক্ষা করতে রাজি না।
-- আমি আর আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে চলে যাবো,, এতোক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে যে ভাড়া হবে তা আপনি দিতে চায়বেন না।
আয়ন দৌড়ে এসে পকেট থেকে পাঁচ'শ টাকার নোটটা ড্রাইভারের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো।
-- এইটা আপনার এতোক্ষণ দাড়িয়ে থাকার জন্য দিলাম। প্লিজ আর একটু অপেক্ষা করেন। হয়তো সে একটু সমস্যায় পড়েছে,, কিন্তু আসবে।
এভাবে রাত ১টা বেজে গেলো,, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ইরা আসেনি। হঠাৎ চোখে একটা প্রাইভেটকার চোখে পড়লো,, আয়ন দেখেই কেমন মন মরা হয়ে গেলো, একটু দ্রুত হেঁটে এখান থেকে চলে যেতে চায়ছে। কিন্তু পারেনি, গাড়িটা সোজা তার সামনে এসে দাড়ায়।

সিএনজি ড্রাইভার অভাক হয়ে ভাবছে,
যদি কেউ গাড়ি নিয়ে আসবে, তাহলে তো ছেলেটা ঐ গাড়ি দিয়েই যেতে পারে। আমাকে ডাকলো কেনো?
গাড়ির দরজা খুলে আয়নের মা, বাবা আর ছোট ভাই দ্রুত হেঁটে আয়নের হাত ধরে ফেলল,, আর জোর করে গাড়িতে উঠানোর চেষ্টা করছে। আয়ন ল্যাম্প পোষ্টার নিচে বসে পড়লো।
সেই মুহূর্তে আরেকটা সিএনজি এসে প্রথম সিএনজি চালককে বলছে,

-- কি মিয়া? আজকা তুমি ফাইস্যা গেছো?
ওনি কিছু বোঝতে পারলো না।
-- আরে মিয়া এই ছেলেটা তো পাগল,, এই রাস্তায় প্রত্যেক দিন এখানেই দাড়িয়ে থাকে,, আর সিএনজি দেখলেই দাড় করিয়ে রাখে আর বলে,
সে আসবে, আরেকটু অপেক্ষা করেন। দুই বছর ধরে একই কাহিনী দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি,, এখন আর এই এলাকার কোন সিএনজি ওরে দেখলে দাড়ায় না,, তুমি মনে হয় নতুন তাই ফেসে গেছো।

আয়নের বাসা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন,
-- চল বাবা বাসায় চল,, কালকেই তো ভালো একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। তুই খুব তাড়াতাড়িই ভালো হয়ে উঠবি। আয়ন পাগলের মতো নিচে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।
আয়নের এমন অদ্ভুদ ব্যবহার দেখে ড্রাইভারের চোখের জল টলমল করতে লাগলো। আয়নের কাঁধে হাত দিয়ে পাঁচশ টাকার নোটটা হাতে দিয়ে বলল,
দোয়া করি তাড়াতাড়িই যেন আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে তোলেন।
আয়নকে গাড়িতে তুলো ওর পরিবার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

দ্বিতীয় সিএনজি ড্রাইভার করুণ কন্ঠে বলতে লাগলো,,
শুধু মাত্র এই ল্যাম্প পোষ্টাই গত দুই বছর ধরে এই পাগলটার সব পাগলামি দেখে আসছে,, নির্বোধের মতো সব কান্না নিরবে সহ্য করে আসছে। ব্যবহার দেখলে বোঝায় যায়, ছেলেটা পাগল।

(সমাপ্ত)