কয়েকদিন থেকে আব্বাজানকে কেমন জানি উদাসীন উদাসীন লাগছে। বলতে গেলে কেউ যখন নতুন নতুন প্রেমে পরে আব্বার অবস্থা ঠিক তেমনি। রহস্যটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। আব্বাজান কি আবার প্রেমে টেমে পরলো নাকি? নাহহ! মা বেঁচে থাকতে আব্বা প্রেমতো দূরের কথা কোন মেয়ের দিকে তাকানোর সাহস পাবেনা।
.
রুমে বসে বসে ফেসবুকিং করছি। ঠিক তখন-ই রুমে আব্বার আগমন। আমি লক্ষ করলাম আব্বাকে কেমন জানি চিন্তিত মনে হচ্ছে।
.
-বাবা রুবেল কেমন আছো?
.
আব্বার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। জীবনে হারামি ছাড়া কথা বলে নাই আর আজকে বাবা! কুচ তো হে.....
.
--আব্বা কিছু বলবা?
.
-তোমার শরীর কেমন বাবা?
.
--ভালো।
.
-আচ্ছা এই নাও ৫০০ টাকা কলেজে গিয়ে নাস্তা করো।
.
আব্বার টাকা দেওয়া দেখে আমি আকাশ থেকে পরলাম। জীবনে ৫০ টাকা হাতাইছি কিনা মনে নাই আর আজকে আব্বা একবারে ৫০০ টাকার কচকচা নোট দিলো। নাকি আব্বা পাগল হইলো? নাহহ তাওতো হবার কথানা। একটা মানুষ এত তাড়াতাড়ি পাগল হবেনা। আমি ভয়ে ভয়ে আব্বাকে বললাম....
.
--আব্বা কি আমাকে ৫০০ টাকা দিলা?
.
-কেনো বাবা কম হয়েছে নাকি? কম হলে এই নাও আরো ৫০০ টাকা।
.
নিজের চোখ,কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। খুশিতে চোখ দিয়ে পানি পরা শুরু করলো। আব্বা আমার চোখে পানি দেখে বলল....
.
-কি হলো রুবেল কাঁদছো কেনো? টাকা কি কম হয়েছে? এই নাও আরো ৫০০ টাকা। মোট ১৫০০ টাকা,এখন হবে? না হলে বলো আরও দিচ্ছি।
.
আবেগে টুলুটুলু হয়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরলাম। আব্বা বলল....
.
-রুবেল শোনো?
.
--জি আব্বা বলো।
.
-আমার একটা কথা ছিলো।
.
--কি কথা...?
.
-না মানে, ঐ তোর শফিক আঙ্কেল (আব্বার কলিগ) বলছিলো ফেসবুক না টেসবুক কি কয় জানি সেইটা খোলার কথা তাই তোর কাছে আসলাম।
.
আব্বা কথাটা এমন ভাবে বলল যেন সে এখনও ফিডার খায়। যাক বাবা! এতক্ষণে বুজলাম এত আদিখেত্যার কারণ। আমি বললাম....
.
-তুমি কি ফেসবুক খুলতে চাও?
.
--না মা...মা...মানে ঐ হ্যা আরকি। তুমি যদি না করো তাহলে খুলবনা। (অভিমানী কণ্ঠে)
.
আব্বা কথাটা বলেই মুখ কালো করে ফেলল। আব্বার এ অবস্থা দেখে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিনা। আমি ভাবলাম সামান্য ফেসবুক একাউন্ট খোলার জন্য ১৫০০ টাকা দিলো, না খুলে দিলে তো বেইমানি হবে। দেই খুলে....
.
-আচ্ছা তোমার মোবাইল দাও আমি ফেসবুক খুলে দিচ্ছি।
.
--খুলবো? (চাপা আনন্দ)
.
-দেও অতো ভাব মারার দরকার নাই চান্দু।
.
--এভাবে কথা বলছো কেনো রুবেল? আমি কিন্তু ফেসবুক খুলবনা হুউউ...
.
উরিশশালা....কি অভিমানরে মাইরি। আমি আর আব্বাকে কিছু বললাম না। মোবাইল নিয়ে বললাম...
.
--আচ্ছা বলো ফেসবুকে তোমার নাম দিবে কি?
.
-দেও একটা।
.
--না তুমি বলো।
.
-"দুষ্ট বুড়ির কিউট মিষ্টি বয়ফ্রেন্ড" দিলে কেমন হয়।
.
--কিইইইই....(এক হাজার বোল্টের শকড)
.
-না মানে নামটা আমার খুব পছন্দ আরকি। (লজ্জায় টুইটুম্বর)
.
কি আর করার " দুষ্ট বুড়ির কিউট মিষ্টি বয়ফ্রেন্ড" নাম দিয়ে আব্বাকে আইডি খুলে দিলাম। নিকনেইম দিলাম 'মতিন'। আব্বার কথা অনুযায়ী রিলেশনশিপ সিঙ্গেল দিলাম। মনে মনে বললাম আম্মা যদি জানে তোমার কপালে শনি,রবি সবই আছেগো আব্বা। ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিলাম। আব্বার মুখে মুচকি হাসি। মনে হচ্ছে আজকে ঈদের দিন। আব্বাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে আমি বললাম....
.
--এই নাও সব হয়ে গেছে।
.
-আর হ্যা শোনো রুবেল তোমার মাকে কিছু বলোনা কিন্তু।
.
--আচ্ছা আব্বা বলবনা।
.
আব্বা খুশি হয়ে পকেট থেকে আবারো ৫০০ টাকার নোট দিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে আমার রুম থেকে নাচতে নাচতে বের হয়ে গেলো। চোখের সামনে আব্বার ছবি ভেসে উঠছে। আব্বাজান আর এক বুড়ি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একে অপরের হাত শক্ত করে ধরেছে। নাহহহ আর ভাবতে পারছিনা।
.
আব্বা সারাদিন মোবাইলের সাথে সুপার গ্লুর মতো লেগে থাকে। তার বেশ পরিবর্তন হয়েছে। বাসায় যতক্ষণ থাকে সবসময় আয়না সাথে রাখে। মোবাইক টেপে আর মুচকি মুচকি হাসে। মাঝে মাঝে একা একাই শিস বাঁজায়। আবার গানও গায়...
.
"কতযে তোমাকে বেসেছি ভালো...
সেকথা তুমি যদি জানতে জানতো,
এ হৃদয় চিরে যদি দেখানো যেতো...
তুমি যে আমার তুমি মানতে।
সে কথা তুমি যদি জানত..."
.
সোফায় বসে বসে টিভি দেখছি। কিন্তু আব্বা মোবাইল টেপায় ব্যস্ত। সাথে মুচকি হাসি, আয়না উয়িথ গানতো আছেই। একটু পর আম্ম আসলো , বলল....
.
-রুবেল যাতো বাজারে গিয়ে লবণ নিয়ে আয়।
.
--আমি পারবনা,তুমি বাবাকে বলো।
.
-এই শুনছো...?
.
--হুমম বলো.... (নজর মোবাইলেরর দিকে)
.
-এদিকে তাকাও।
.
--বলো তুমি আমি শুনছি।
.
-বাজারে গিয়ে লবণ নিয়ে আসো।
.
--আমি পারবনা, তুমি রুবেলকে বলো।
.
আম্মা রেগে গেলেন। বললেন....
.
-আচ্ছা কি পেয়েছো তুমি হুমমম। সবসময় শুধু মোবাইল আর মোবাইল । কি আছে মোবাইলে? দেখি মোবাইল দাওতো।
.
--আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।
.
তারপর মা চলে গেলো। আব্বা আমাকে বলল....
.
--রুবেল প্লিজ একটু বাজারে যাও,আমার লক্ষ্মী বাবা।
.
আব্বার আবেগময় কথা শুনে আমিই বাজারে গেলাম। বিনিময়ে আব্বার কাছে থেকে ১০০ টাকা পেলাম।
.
২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাই মনে হয় আব্বা ফেসবুক নিয়ে পরে থাকে। শুধু ঘুমানো বাদে। ইদানীং ফেসবুকের সাথে আরেকটা বিষয় জড়িত হয়েছে সেটা হলো কথা বলা। এখন বাবা ফোনেও কথা বলে। মাঝরাতে যখন আমি হিসু করতে বের হই তখন দেখি আব্বা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। দুই/তিন বার টয়লেটেও কথা বলছে। আর এ কয়দিনে আমারও পকেট গরম হয়ে গেছে। আব্বার কাছে যখন যে কয় টাকা চাই তাই দেয়। সবচেয়ে একটা জিনিষ বিরক্তিকর, সেটা হলো বাসায় বাবার যতো কাজ সব আমাকে করতে হয়। বাজার করা,টয়লেট পরিষ্কার করা, ঘর মোছা আর নাই বললাম।
.
সকাল থেকে মন খারাপ করে বসে আছি। কারণ একটাই আলেয়ার (আমার গার্লফ্রেন্ড) সাথে ব্রেকআপ হইছে। রাগে, দুঃখে ফেসবুক আইডি ডিয়েক্টিব করছি। এদিকে আব্বাজান ফুরতিতে পুরো বাসা মাতিয়ে রেখেছে। মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেলো। মাথায় তখন-ই শয়তানি বুদ্ধি কিলিবিলি করা শুরু করল। যেহেতু আব্বার ফেসবুক একাউন্ট আমি খুলে দিছি তাই ফোন নাম্বার, পাসওয়ার্ড সব-ই আমার জানা। টুক করে ডাটা অন করে আব্বার আইডি লগইন করলাম। লগইন করে নিউজফিডে গিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া। পুরো নিউজফিড জুরে শুধু মেয়েদের ছবি। আর সব আবাল গ্রুপের মেয়েদের পোস্ট। হে ধরণী এটা আব্বার একাউন্ট না কি মূলা খেত কিছুই বুজতে পারছিনা। কিন্তু সবচেয়ে বড় চমক যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা জানতাম না। ম্যাসেঞ্জার গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। ও আল্লাহ এসব কি দেখছি আমি! সব মেয়েদের আইডি। নাম গুলো ঠিক এমন....নুসরাত জাহান বুলবুলির বাচ্চা, আমি এক অবুজ বালিকা,আরানের বউ,ওসির বউ, বুড়ার বুড়ি,এঞ্জেল ছমিরন, কাটিং কুলুলু গার্ল, মতিনের অপেক্ষায় আমি অবুজ বালিকা জরিনা, পাট খেতের পেত্নী, লাউ গাছের মিষ্টি কুমড়ার মেয়ে পল্লবী আরো অনেক।
.
আব্বা সব মেয়েদের মেসেজ দিছে...
.
"হাই.. আই এম মতিন...
তোমরা কি হবা আমার বউয়ের সতিন।"
.
আর মেয়েদের রিপ্লে....
.
-হারামি তর মা বোন নাই।
-বেয়াদব জানি কোথাকার।
-মদ খা শা**
-তর পা*** খুদ দিয়ে মুরগির বাচ্চা লাগিয়ে দিব।
.
না আর পড়তে পারছিনা। এত্ত অপমান। আমিও পাল্টা জবাব দিলাম। লক্ষ করলাম আব্বা একজনের সাথে চ্যাটিং করছে। মেয়ের আইডির নাম..."দুষ্টু বুড়ার পিচ্চি গুলুগুলু বুড়ি"। বুড়ী আব্বাকে বলছে....
.
-এই তুমি রাতে কথা বললেনা কেনো?
.
--আসলে বুড়ি জানু রাতে আমার পড়ার খুব চাপ ছিলো। সরি বেবি...(আল্লাগো এ কথা শোনার আগে আমার মরন হলোনা কেনো,কেনো)
.
-ওক্কে বাবু, খাইছো?
.
--আমি কি কখনও তোমার আগে খেয়েছি বলো জানু....?
.
-না
.
--তাহলে বললে কেনো খাইছি নাকি, যাও তোমার সাথে কথা নেই। (অভিমানী কণ্ঠে)
.
-সরি বাবু,আর হবেনা ভুল।
.
আমি তাদের মান অভিমানময় কথা বার্তা শুনে কখনও যে কেঁদে দিছি সেদিকে খেয়াল নাই। আব্বা এখনও লেখাপড়া করে ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছে করে।
.
-আচ্ছা তুমি এত্ত সুন্দর গল্প কেমনে লিখো জানু?
.
--তোমাকে ভেবে লিখি বেবি।
.
গল্পের কথা শুনে অবাক হলাম। আব্বার আইডিতে গেলাম। ওমাআআআগো.... আইডি দেখি গল্প দিয়ে ভরা। মাগার সব গল্পই কপি করা। হে বাবা তুমিও অবশেষে কপিবাজ হয়ে গেলা। গল্পের নাম...মামাতো বোনের থাপ্পড়ের প্রতিশোধ অতঃপর বাসর রাতে বিড়াল মারা,টুকটুকি যখন সাত বাচ্চার মা হয়ে ডিভোর্সি মহিলা,আমার মনের গরে তুমি এবং শিয়াল বসবাস করে, প্রেমহীন জীবন অন্ধের মত কানা অতঃপর ভালোবাসার মিষ্টি পাপ্পি, ইত্যাদি।
.
প্রচুর রাগ হলো। নিজের রাগকে কোনমতেই কন্ট্রোল করতে পারছিনা। আব্বা এমন কাজ করবে জানলে কখনই ফেসবুক খুলে দিতামনা। এর একটা বিচার করতেই হবে। দৌড়ে আম্মার কাছে গেলাম। আব্বার সব কুকর্ম আম্মাকে দেখালাম। আম্মা রাগে আগুনের মতো ফুসছে। ১০ নাম্বার বিপদ সংকেত দেখে আমি সেখান থেকে চলে আসলাম।
.
মতি চাচার দোকানে বসে চা খাচ্ছি তখন-ই আম্মার ফোন।
.
-রুবেল কই তুই?
.
--চা খাচ্ছি।
.
-তাড়াতাড়ি থানায় আয়?
.
--ক্যান...?
.
-আসতে বলছি আয়।
.
বুজলাম আম্মা রেগে আছে। তাড়াতাড়ি চলে গেলাম থানায়। গিয়ে দেখি আব্বাকে জেলে দেওয়া হয়েছে। আব্বা জেলের শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মাজান আব্বার নামে ইভটিজিং,নারী নির্যাতনের মামলা করছে। আর তার সাক্ষী হিসেবে আমাকে সাইন করতে হয়েছে। আব্বার দিকে তাকিয়ে দেখি সে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আব্বার কাছে গেলাম। আমাকে দেখে আব্বা বলল....
.
--বাবারে বুড়ীর খেয়াল রাখিস। মাত্রতো ১২ টা বছর। দেখতে দেখতে কেঁটে যাবে।
.
এই বলে বাবা সেখান থেকে ভিতরে চলে গেলো। আমি ভাষা হারিয়ে ফেলছি, আব্বা কি বলল মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে... "বুড়ির খেয়াল রাখিস।"
.
ভালোবাসার জন্য মানুষ কতই না কি করেছে। ভালোবাসার মানুষকে কেউ কখনও ভুলতে পারেনা। আমার বাবাও পারেনি। মনে মনে বললাম....
.
" বাবা চিন্তা করোনা,বুড়ী মাকে আমি দেখে রাখব।"
.
ঠিক ১২ বছর পর তোমাদের বিবাহ হইবে।